কুরআন অবমাননা- কারন ও প্রতিকার- মাহমুদুল হাসান নুমান
লিখেছেন লিখেছেন নকীব আরসালান২ ১৯ অক্টোবর, ২০২৫, ০৯:২২:৩১ রাত
দেশে একের পর এক কোরআনের অবমাননা ঘটেই চলছে। আর অবমাননাকারীদের মধ্যে অধিকাংশই মুসলিম। এখন প্রশ্ন হল, পৃথিবীতে অনেক ধর্মগ্রন্থ আছে। যেমন বেদ, বেদান্ত, পুরান, বাইবেল, ত্রিপিটক, জেন্দাবেস্তা ইত্যাদি ধর্মগ্রন্থ অবমাননা করা হয় না, শুধু কোরআন অবমাননা করা হচ্ছে কেন? আবার একটা মুসলিম দেশে শুধু অমুসলিমরা নয় মুসলমানের সন্তানরাও কুরআন অবমাননার করছে- এর কারণ কি? উত্তর হল- আল্লাহর গজব অর্থাৎ, মুসলিম জাতির উপর আল্লাহর গজব চলছে
কোরআন ও অন্যান্য ধর্মগ্রন্থের তুলনা
ধর্ম ও ধর্মগ্রন্থের উদ্দেশ্য মূলত দুটি- স্রষ্টার অধিকার এবং মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু একমাত্র কুরআন ব্যতীত অন্যান্য ধর্মগ্রন্থে স্রষ্টার অধিকার, স্রষ্টার আনুগত্য, স্রষ্টার এককত্ব সম্পর্কে তেমন কোন ধারনা পাওয়া যায় না এবং মানবাধিকার সম্পর্কেও কোন বিধি-বিধান নাই। তবে বাইবেলে দান-দক্ষিণার কিছু উপদেশ আছে বাধ্যতামূলক কোনো বিষয় নয়। কিন্তু অন্যান্য ধর্মগ্রন্থে স্রষ্টার অধিকার ও মানবাধিকার সংক্রান্ত কিছু না থাকলেও বিভিন্ন কল্প কাহিনী, রগরগে যৌনতা ও অশ্লীল বর্ণনায় ভরপুর। এখানে আমি পৃথিবীর প্রধান তিনটি ধর্মের অনুসৃত ধর্মগ্রন্থের তুলনামূলক আলোচনা পেশ করছি।
হিন্দু ধর্ম গ্রন্থঃ হিন্দু ধর্মের কোন কোন গ্রন্থ দেব-দেবীদের অজাচার ও অশ্লীল যৌনতার বর্ণনায় ভরপুর। যৌনতা সম্পর্কে এসব গ্রন্থের বিবরণ এতটাই অশ্লীল যে, এগুলো আলোচনা করা বা উল্লেখ করা নূন্যতম রুচিবোধের খেলাফ। এখানে উদাহরণ হিসেবে শুধু একটি বর্ণনা তুলে ধরা হলো ।
আর মহাদেব যেহেতু লিঙ্গ কাটার পর পার্বতীর যৌন চাহিদা পুরা করতে পারত না তাই পার্বতী অন্যান্য ভগবানদের সাথে ব্যভিচারে লিপ্ত হতো। একদিন পার্বতী ভগবান বিষ্ণুর সাথে ব্যভিচারে লিপ্ত হয়েছে- ঠিক এমন সময় সেখানে গণেশ এসে হাজির হয়। গণেশ ছিল পার্বতীর সন্তান। তখন পার্বতী গণেশের থেকে নিজেকে লুকানোর জন্য নিজ চেহারা তুলসির চেহারায় পরিবর্তন করে ফেলে। তুলসীর সাথে গণেশের পূর্ব থেকে যৌন সম্পর্ক ছিল। তখন গণেশ নিজের মা পার্বতীকে তুলসী ভেবে তার সাথে ব্যভিচারে লিপ্ত হয়। পরবর্তীতে এই ঘটনা মহাদেব জানতে পেরে অভিশাপ দিয়ে নিজ ছেলে গণেশের মাথা হাতির মাথায় পরিবর্তন করে দেয়। (স্কন্ধ পুরাণ, নাগর খন্ড-৪৪৪১, পৃষ্ঠা- ১ থেকে ১৬) হিন্দু ধর্ম গ্রন্থগুলোতে এ জাতীয় প্রচুর অশ্লীল ও অযাচার মূলক বর্ণনা রয়েছে।
বাইবেলঃ বাইবেল ওল্ড টেস্টামেন্টে অনেক অজাচার ও অশ্লীল বর্ণনা রয়েছে। যেমন, নূহ আঃ মদ খেয়ে বেহুশ হয়ে উলঙ্গ অবস্থায় পরেছিলেন। লুত আঃ নিজের দু’কন্যাকে গর্ভবতী করেছিলেন। হুদ আঃ তার পুত্রবধূর সাথে সঙ্গম করে যমজ পুত্র সন্তান জন্ম দিয়েছিলেন। একদিন দাউদ আঃ প্রাসাদের ছাদে ওঠে উড়িয়া হিত্তিয়ার স্ত্রীকে গোসলরত অবস্থায় দেখে কামাতুর হয়ে উঠলেন এবং তাকে প্রাসাদে এনে মিলিত হলেন। ফলে মহিলা গর্ভবতী হয়ে গেলেন। তখন দাউদ আঃ আমালেকাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত উড়িয়াকে হত্যার জন্য প্রধান সেনাপতিকে হুকুম দিয়ে পাঠালেন। তারপর সেই মহিলাকে বিয়ে করলেন। কিন্তু অবৈধ ভ্রুনটি গর্ভপাত হয়ে যায়, পরবর্তী গর্ভের সন্তান হলেন সোলায়মান আঃ। বাইবেলে ‘সলোমনের পরমগীত’ অধ্যায়ে সোলায়মানের নামে অশ্লীল কদর্য কাব্য রচনা করে রাখা হয়েছে।
কোরআনঃ কোরআন হলো পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান- কোরআনে হক্কুল্লাহ ও হক্কুল ইবাদ সংক্রান্ত পূর্ণাঙ্গ বিধান দেওয়া হয়েছে। কাজেই কোরআনের সামনে অন্যান্য ধর্মগ্রন্থ সূর্যের সামনে মাটির প্রদীপের ন্যায়। যেমন,
হক্কুল্লাহ বা আল্লাহর অধিকারঃ সূরা ইখলাসে তাওহীদের পূর্ণাঙ্গ সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। তদুপরি আল্লাহর নির্দেশ হলো- তিনি সকল গুনাহ মাফ করবেন কিন্তু তার সাথে শিরক মাফ করবেন না (নিসা-৪৮)। আর নামাজ রোজার মাধ্যমে তার ইবাদত ও আনুগত্যের পূর্ণাঙ্গ বিধান দেয়া হয়েছে।
মানবাধিকারঃ হক্কুল ইবাদ বা মানবাধিকারের ক্ষেত্রে ইসলাম এতটাই পূর্ণাঙ্গ বিধান দিয়েছে যে, পৃথিবীর কোন ধর্ম বা মতবাদ এর ধারে কাছেও ঘেষতে পারেনি। এ বিষয়টা ‘মানবাধিকার প্রশ্নে ইসলাম ও জাতিসংঘ সনদ’ গ্রন্থে প্রমাণ করা হয়েছে। কিন্তু এসব বিধান ইসলাম তথা মাদ্রাসা সিলেবাস ও সকল ফিরকার সিলেবাস থেকে বাদ দিয়ে ইসলামকে উল্টে দেয়া হয়েছে। কারণ ইসলামী বিধান হল-
১। জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে দরিদ্র অক্ষম শ্রেণীকে পুনর্বাসন করা ও ভাতা দেয়া। কিন্তু এ দায়িত্ব পালন না করে আমরা আলেমরা উল্টো দরিদ্রের হক দান সদকা নিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছি। দেশে নামাজ আদায়ের জন্য চার লক্ষ মসজিদ থাকলেও যাকাত আদায়ের কোন কেন্দ্র নাই।
২। আহত ও নিহতের পরিবারকে দিয়ত (ক্ষতিপূরণ) দেয়া ফরজ। কিন্তু উল্টো আমরা আলেমরা তাদের বাড়িতে দাওয়াত খাচ্ছি ও খতম পড়ে টাকা আনছি।
৩। মুসলমানদের মধ্যে ফিরকা বিভক্তি হারাম। কিন্তু উল্টো আমরা নিজ নিজ ফিরকার প্রবর্তক মুরুব্বি ও সিলেবাসের অনুসরণ করতে গিয়ে মূলত রাসূলের সুন্নাহ বাদ দিয়ে মুরুব্বির সুন্নাহ অনুসরণ করে প্রকারান্তরে বিদআতের অনুসরণ করছি। তারপর এ বিদআতকে আকিদার দোহাই দিয়ে উম্মাহকে বিভক্ত করার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছি।
৪। অন্যায় জুলুম নির্যাতনের বিরুদ্ধে জিহাদ করা ফরজ। যেমন সুদ ঘুষ দুর্নীতি লুটপাট অর্থপাচার নারী নির্যাতন রাজনৈতিক হত্যাকান্ড ইত্যাদির বিরুদ্ধে জিহাদ ফরজ ছিল। কিন্তু উল্টো আমরা নীরবতা অবলম্বন করে দুষ্কৃতিকারীদের সহযোগিতা করছি আর তাদের থেকে মসজিদ মাদ্রাসার জন্য চাঁদা ভিক্ষা করছি।
৫। মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে দুনিয়ার মজলুম মানব গোষ্ঠীর পক্ষে জিহাদ করে তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা ফরজ ছিল। কিন্তু আমরা নীরবতা অবলম্বন করে অভিশপ্ত ইহুদী ও পশ্চিমাদের সহযোগিতা করছি।
৬। রাসুল সাঃ দুনিয়ার দরিদ্র অক্ষম দুর্বল মজলুম শ্রেণির আর্থিক ও বিচারিক অধিকার প্রতিষ্ঠার বিধান দিয়ে গেছেন। আর এসব অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য জিহাদের বিধান দিয়েছেন বিধায় তিনি শ্রেষ্ঠ মহামানব। জিহাদের বিধান দিয়ে তিনি মূলত মানবজাতির ত্রাণকর্তার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন অথচ উল্টো তাকে সন্ত্রাসের জনক বলে প্রচার করা হচ্ছে।
প্রমাণিত হল, ইসলাম যে মানবাধিকার দিয়েছে পৃথিবীর কোন ধর্ম বা মতবাদ তা দিতে পারেনি। কাজেই কোরআন হলো বিশ্ব মানবাধিকারের শ্রেষ্ঠ সনদ। অতএব কুরআন পুড়ানো বা অবমাননার অর্থ হল বিশ্ব মানবাধিকার সনদ পুড়িয়ে ফেলা বা অবমাননা করা। কাজেই যারা এ কাজ করে মানবতার শত্রু হিসেবে তাদেরকে কঠোর শাস্তি প্রদান করা উচিত।
বস্তুত এ অবমাননার কারণ হল, রাষ্ট্র রাজনীতি ও মানবাধিকার সংক্রান্ত সকল বিষয় মাদ্রাসা সিলেবাস ও সকল ফিরকার সিলেবাস থেকে বাদ দিয়ে ইসলামকে উল্টে দেয়া হয়েছে। এখন ইসলাম হল একটা মানবাধিকার বিহীন আচার অনুষ্ঠান সর্বস্ব ভিক্ষার ধর্ম, বিকল ধর্ম। আর যে ধর্ম রাষ্ট্র রাজনীতি ও মানবাধিকার বিষয়ে কিছু বলে না- সে ধর্ম অকেজো নিষ্প্রভ, সে ধর্মের প্রতি মানুষ শ্রদ্ধা পোষণ করে না। এটাই কোরআন অবমাননার মূল কারণ।
এখন প্রশ্ন হল, পৃথিবীর অন্যান্য ধর্মও তো রাষ্ট্র-রাজনীতি ও মানবাধিকার সম্পর্কে কিছু বলে না অথচ তাদের ধর্মগ্রন্থ নিয়ে কেউ তো সমালোচনা করে না, অবমাননা করে না। তাহলে কুরআন নিয়ে এত সমালোচনা ও অবমাননা কেন?
এর উত্তরটা খালি চোখেই দেখা যায় অর্থাৎ, মুসলিম জাতির উপর আল্লাহর গজব চলছে। আর এ গজবের কারণ হলো মুসলমানরা নামাজ-রোজার শ’খানেক আয়াত ব্যতীত বাকি কুরআন সুন্নাহ বর্জন করেছে, রাসুল সাঃ এবং সাহাবায়ে কেরামের সুন্নাহ (কর্মপদ্ধতি) বর্জন করেছে। কারণ তারা নামাজ রোজা ব্যতীত জীবনের বাকি সময় কর্মকান্ড ফরমান চিঠিপত্র জিহাদ সবই করেছেন মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য অর্থাৎ মানুষের আর্থিক ও বিচারিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য। কিন্তু আমরা রাসূলের সুন্নাহ বর্জন করে ফিরকার প্রবর্তক মুরুব্বির সুন্নাহ (কর্মপদ্ধতি) অনুসরণ করছি অর্থাৎ বিদআতের অনুসরণ করছি। আর কোরআন সুন্নাহ বাদ দিয়ে নিজ নিজ ফিরকার সিলেবাসকে ইসলাম হিসাবে গ্রহন করেছি।
উল্লেখিত কারণে মুসলিম জাতি এখন পরাজিত জাতি-দাস জাতি। আর দাসের যত মূল্যবান বস্তুই থাকুক মানুষ তার প্রতি শ্রদ্ধা পোষণ করে না। সঙ্গত কারণেই পৃথিবীর অন্যান্য জাতি কোরআনকে শ্রদ্ধা না করে অবমাননা করে চলছে। এই হলো আল্লাহর গজবের কারণ। আর এই গজবের নিদর্শন হলো বিশ্বময় মুসলিম জাতির উপর কেয়ামতের বিভীষিকা বয়ে যাচ্ছে আর বৈশ্বিক মানবাধিকারের মহাসনদ কোরআনকে অবমাননা করা হচ্ছে, এমনকি মুসলমানের সন্তানরাই কোরআন অবমাননা করছে, প্রত্যাখ্যান করছে। কাজেই এখন এই গজব থেকে মুক্তির একমাত্র পথ হলো কোরআন হাদিসে ফিরে আসা অর্থাৎ, ইসলাম প্রদত্ত মানবাধিকার সর্বত্র প্রচার ও প্রতিষ্ঠার ব্যবস্থা করা। তাহলেই ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণিত হবে এবং মানব জাতি কোরআনকে মুক্তির সংবিধান হিসেবে গ্রহণ করবে।
এখন কোরআন অবমাননাকারীদের কাছে প্রশ্ন, পৃথিবীতে অনেক ধর্মগ্রন্থ রয়েছে- সেসব গ্রন্থে স্রষ্টা ও সৃষ্টির অধিকার সম্পর্কে কিছুই নাই, শুধু অশ্লীল ও কাল্পনিক কিচ্ছা কাহিনীতে ভরপুর। অথচ এসব ধর্মগ্রন্থের বিরুদ্ধে কেউ কিছু বলে না, অবমাননা করে না। কিন্তু বৈশ্বিক মানবাধিকারের শাশ্বত দলিল কুরআনের বিরুদ্ধে বিষোদগার করা হয়, অবমাননা করা হয়। কাজেই এ জাতীয় লোকগুলি দুস্কৃতিকারি, মানবতার শত্রু এবং শয়তানের প্রতিনিধি কিনা? আর শয়তানের প্রতিনিধি হিসেবে তাদের বিচার আবশ্যক কিনা?
বিষয়: বিবিধ
৩ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন