পবিত্র মক্কা মদিনার দিনগুলি: (পর্ব ৬)
লিখেছেন লিখেছেন মোহাম্মদ মুজিবুল হক ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৫, ০৬:০৪:৪৭ সন্ধ্যা
আজ ১০ই জিলহজ্ব ২৬শে অক্টোবর ২০১২ শুক্রবার..... তাঁবুতে ফিরে নাশতা গ্রহণের পর কুরবানীর খবরের অপেক্ষায় থাকি,. ইতিমধ্যে তাঁবুর বাইরে এসে মস্তক মুন্ডন কৃত কয়েক জন হাজীর দেখা পেলাম বুঝতে পারলাম তাদের কুরবানী সম্পন্ন হয়েছে. আজ জুমাবার তবে মিনায় অবস্হান রত হাজীদের জন্য জুমা বাধ্যতামূলক নয় বিধায় জোহর নামাজই পড়বেন. বেলা ১২টার কিছু পর আমাদের কুরবানী সম্পন্ন হবার খবর আসে. মায়ের কাছ থেকে মায়ের পাথরগুলি নিয়ে ইসমাইল ও ফরিদের সাথে পাথর নিক্ষেপের জন্য রওয়ানা হই জামারাহ'র উদ্দেশ্যে. আমাদের মায়েরা আমাদের মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে অনেকটা শেষ বিদায়ের মতই বিদায় দিলেন. জামারাহ'র প্রবেশ পথ আমাদের তাঁবুর কাছেই.
মিনা হতে জামারার উদ্দেশ্যে যাত্রা
পাথরের পাহাড়ের নীচ দিয়ে কাটা তিনটি বিশাল সুড়ঙ্গ পথ অথবা ট্যনেল পেরিয়ে জামারাহ'য় যেতে হয়
মিনা হতে জামারার উদ্দেশ্যে যাত্রা
প্রতিটি সুড়ঙ্গ পথ অথবা ট্যনেলের দৈর্ঘ্য এক কিলোমিটারের বেশি মাথার উপর বিকট শব্দে চলছে বিশাল আকারের একজষ্ট ফ্যান.
মিনা হতে জামারার উদ্দেশ্যে যাত্রা
পাঁচটি ভিন্ন মাত্রার বৈদ্যুতিক লাইন দিয়ে আলোকিত করা হয়েছে সুড়ঙ্গ পথ অথবা ট্যনেল. যার মধ্যে তিনটি আলাদা আলাদা গ্রীডের বৈদ্যুতিক লাইনের সংযোগ
মিনা হতে জামারার উদ্দেশ্যে যাত্রা
একটি জেনারেটরের অন্যটি সোলার অথবা সৌর বিদ্যুত সংযোগ. ২০০৬ সালে র আগে সুড়ঙ্গ পথে প্রায় বিদ্যুত সংযোগে বিপর্যয় ঘটতো এবং অন্ধকারে পদদলিত হয়ে অনেক হাজী প্রাণ হারাতেন তাই এই বহুমাত্রিক বিদ্যুত ব্যবস্হা
মিনা হতে জামারার উদ্দেশ্যে যাত্রা
হাজী সাহেবানরা এহরাম পরে লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক পাঠ করা অবস্হায় ধীর পায়ে জামারাহ'র উদ্দেশ্যে এগোচ্ছেন আজ শুধুবড় শয়তানকে পাথর মারা হবে.
জামারায় বড় শয়তানের উদ্দেশ্যে পাথর নিক্ষেপ
১১ই জিলহজ্ব ও ১২ই জিলহজ্ব প্রতীকী বড় মেজ ও ছোট তিন শয়তানকেই সাতটি করে পাথর মারতে হবে. আমরা জামারাহ'তে পৌঁছে প্রতীকী বড় শয়তানের দিকে পাথর ছুড়লাম প্রথমে নিজেরটা মারলাম পরে মায়েরটা মেরে প্রথম দিনের মত পাথর ছোড়া সম্পন্ন করলাম.
জামারায় বড় শয়তানের উদ্দেশ্যে পাথর নিক্ষেপ
নিরাপত্তা ব্যবস্হা অত্যন্ত মজবুত. মূল স্তম্ভের চার পাশে মোটা ফোম লাগানো যাতে চাপে কেউ আঘাত না পায়. একটু ভীড় হলেই নিরাপত্তা কর্মীরা তা সহজেই সামাল দিচ্ছেন আগে এখানে ভীড়ের চাপে বহু হাজী মারা যেত এখন জামারাহ'কে কয়েক ফ্লোরে ভাগ করায় আর দূর্ঘটনা হয়না.
মিনা হতে জামারার উদ্দেশ্যে যাত্রা
বেশ কয়েকটি হেলিকপ্টার স্ট্যান্ড বাই দেখা গেল. আমরা ধীরে সুস্থে পাথর মেরে তাঁবুতে ফিরে এলাম.আমরা যারা কুরবানী সম্পন্ন করে জামারাহয় পাথর ছুড়ে এসেছি তাদের মস্তক মুন্ডন করে এহরাম ছাড়তে আর কোন বাধা নাই. তবুও আমাদের কাফেলা প্রধানের অপেক্ষায় রইলাম জোহরের নামাজ আদায় করে ক্যাম্পের বাইরে এসে দেখলাম খুলনার এক মহিলা হাজী সাহেবান পথ হারিয়ে নিজের তাঁবুতে ফিরতে পারছেন না উনাকে যথাসাধ্য সহযোগিতা করে উনার তাঁবুতে পৌঁছানোর ব্যবস্হা করলাম.
জামারায় বড় শয়তানের উদ্দেশ্যে পাথর নিক্ষেপ
আছরের নামাজ শেষে লক্ষ্য করলাম বেশির ভাগ হাজী স্বউদ্যোগে পবিত্র মিনার তাঁবু হতে পবিত্র মক্কার হোটেলে চলে যাচ্ছে আমরা কয়েকজন আজই মিনার তাঁবু ছেড়ে পবিত্র মক্কার হোটেলে চলে যাবার সিদ্ধান্ত নিই আর হজ্বের নিয়ম অনুযায়ী এতে কোন বাধা নেই আমাদের কাফেলা প্রধানের সাথে এবিষয়ে আলাপ করলে তিনি বলেন আপনারা যেতে পারেন তবে কাফেলার পূর্ণ টিম পবিত্র মক্কায় না পৌঁছা পর্যন্ত নিজ উদ্যোগেই খাবারের ব্যবস্থা করতে হবে. আমরা প্রায় ৩০জন ওনার কথা মেনে হাসিমুখে উনি সহ অন্য হাজী সাহেবান দের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে পবিত্র মক্কার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম.
জামারায় বড় শয়তানের উদ্দেশ্যে পাথর নিক্ষেপ
আমরা চার ছায়াসঙ্গী যথাক্রমে আমি ইসমাইল ইমতিয়াজ ও ফরিদ এবং সবার মা সহ অন্যান্য হাজীদের সাথে যাত্রা শুরু করি. সূর্যাস্তের সময় হয়ে এসেছে আমরা বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর তুরস্কের হাজী পরিবহন কারী একটি বাসে উঠে পড়লাম. ভাড়া জন্ প্রতি ২০ রিয়াল ...................
মিনা হতে জামারার উদ্দেশ্যে যাত্রা
বাস তো নয় যেন আলিশান বিমান. বাসটি কোন এক কাজে পবিত্র মক্কার দিকে যাচ্ছে এই সুযোগে পয়সাও কামাই করে নিচ্ছে গাড়ী থেকেই দেশে ফোন করে কথা বললাম এর আগে গত তিনদিন ছাড়া প্রতিদিন দেশে কথা বলেছি মাত্র ১৫ মিনিটের মধ্যে হোটেলে পৌঁছে গেলাম আমরা এখানে আসার আগেই আমাদের কাফেলা প্রধান জনাব মোহাম্মদ আলী আনসারী সাহেব হোটেলে এসে পবিত্র মিনা হতে আগত হাজী সাহেবানদের খাওয়া দাওয়া ও দেখভালের নির্দেশনা দিয়ে পূনরায় পবিত্র মিনা চলে গেলেন. মাগরিবের নামাজ আদায় করে আমরা চার জন মাথা মুন্ডন করতে বের হলাম. সব সেলুনেই দীর্ঘ লাইন. এখানকার প্রায় সব সেলুনই পাকিস্তানিদের. হাতে গোনা কয়েকটি মিশরীয় সেলুনও আছে. অবশেষে মাথা মুন্ডন করে হোটেলে ফিরে আসলাম. অন্যান্য সময় মাথা মুন্ডন করা ৫ রিয়াল হলেও আজ নিল ২০ রিয়াল বাংলাদেশী মুদ্রায় মাত্র ৪৩০ টাকা. একে একে সবাই গোসল শেষে এহরাম ছেড়ে সাধারণ কাপড় পরিধান করলাম এশার নামাজ পড়ে জেদ্দায় অবস্হানরত ফরিদের ভগ্নিপতির নিয়ে আসা খাবার খাই. ইতিমধ্যে জেদ্দার অদূরে বাহারা নামক স্হান হতে আমার মামাতো বোনের স্বামী সালাহউদ্দিন ও এসে হাজির হয়েছে. অতএব আমরা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি যে রাত ১২টায় আমরা ফরজ তাওয়াফের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হব. ঠিক যথা সময়েই আমরা পবিত্র বায়তুল্লাহর সামনে হাজির হয়ে তাওয়াফ শুরু করি. খুব ভিড় ছিল তবে তা গা সওয়া ব্যাপার হয়ে
গেছে. আমার মামাতো বোনের স্বামী সালাহউদ্দিন আমাদের শিখিয়ে দিল কিভাবে সহজে ও স্বল্প সময়ে তাওয়াফ করা হয় . ফরিদ ইমতিয়াজ ও ইসমাইলরা আলাদা আলাদা ভাবে তাওয়াফ ও সাঁই করে সবাই কোন জায়গায় একত্রিত হব তা বলে দেয়া আছে. এত ভীড়ের মধ্যেও আমরা খুব স্বল্প সময়ে মাত্র ৪০ মিনিটে পবিত্র কাবা তাওয়াফ সম্পন্ন করলাম. পবিত্র কাবা তাওয়াফ করার সময় মহান আল্লাহর কুদরত স্বরূপ যা যা আমাদের চোখে পড়েছে তা প্রকাশ না করে আমাদের মনেই রেখে দিলাম. এরপর সালাতে মাকামে ইব্রাহীম আদায় করে পবিত্র জমজমের পানি পান করে পবিত্র সাফা মারওয়া সাঁই করা সম্পন্ন করি. তাওয়াফ ও সাঁই করা শেষে সম্মানিত হাজী সাহেবান দের চেহারা দেখে মনে হলো এরা মানুষ না বেহেশত থেকে আসা ফেরেশতা. কালো তামাটে ও ফর্সা সকল হাজী সাহেবানদের চেহারা থেকে যেন নূর ঝরে পড়ছিল আমরা অসামান্য পরিতৃপ্ত হয়ে হোটেলে ফিরলাম.একটা বিষয় উল্লেখ না করে পারছি না. ৭ই জিলহজ্ব ৮ই জিলহজ্ব ও ৯ই জিলহজ্ব এবং আজ ১০ই জিলহজ্ব একটানা চার রাত ও তিন দিন এক সেকেন্ডের জন্যও আমরা কেউ ঘুমাইনি তার উপর ছিল দীর্ঘ সময়ের কষ্টকর গাড়ী ভ্রমণ ও প্রচন্ড ভীড়ের দীর্ঘ পদযাত্রা. এর পরেও ক্লান্তি দূর্বলতা কিংবা বিরক্ত কারো মুখে মনে দেহে একটুও স্পর্শ করতে পারেনি. সুস্থ দেহে সুষ্ঠ ও সূচারু ভাবে হজ্ব সম্পন্ন হওয়ায় মহান আল্লাহর দরবারে অশেষ শুকরিয়া আদায় করে আগামী কাল ও আগামী পরশু অর্থাৎ ১১ই জিলহজ্ব ও ১২ই জিলহজ্ব জামারাহ'য় পাথর নিক্ষেপের কথা মাথায় রেখে ঘুমাতে গেলাম...
বিষয়: বিবিধ
১০২৫ বার পঠিত, ৪ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন