পবিত্র মক্কা মদিনার দিনগুলি: (পর্ব ৫)
লিখেছেন লিখেছেন মোহাম্মদ মুজিবুল হক ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৫, ০৪:২৮:১৯ বিকাল
পবিত্র আরাফাত ময়দানে .
আজ ৯ই জিলহজ্ব ২৫শে অক্টোবর ২০১২ বৃহস্পতিবার. আজ পবিত্র আরাফাত দিবস সারাটা জীবন এই দিনটির অপেক্ষায় ছিলাম. মহান আল্লাহর অশেষ শুকরিয়া আদায় করতে করতে আবেগে চোখে পানি এসে গেল সকল হাজীদের একই অবস্হা. মায়ের সাথে দেখা করে ছাউনির বাইরে রাস্তায় এলাম হাজার হাজার নিম গাছ আরাফাত প্রান্তরে হাজীদের সুশীতল ছায়া দিচ্ছে, প্রসঙ্গক্রমে জানতে পারলাম ১৯৭৯ সালে বাংলাদেশের তৎকালীন রাস্ট্রপতি শহীদ জিয়াউর রহমান বাংলাদেশ থেকে কয়েকশ গাছ নিয়ে পরীক্ষামুলক ভাবে লাগিয়েছিলেন সেই গাছগুলি এখন বিশাল মহীরূহ আর পুরো আরাফাত ময়দান এখন কয়েক লাখ নিম গাছে আচ্ছদিত হয়ে সবুজ রূপ ধারণ করেছে .
পবিত্র আরাফাত ময়দানে
গাছগুলি স্হানীয়ভাবে "জিয়া" গাছ নামে পরিচিত. শ্বেত শুভ্র এহরাম পরিহিত কয়েক মিলিয়ন আল্লাহর মেহমানরা অনবরত পাঠ করছে "লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক" হে আল্লাহ আমি হাজির, আমি হাজির. আগের মতোই ফরিদ ও ইসমাইলকে সাথে নিয়ে চলছি গন্তব্য মসজিদে নামিরা যে মসজিদে হজ্বের খুতবা পাঠ করা হয়. অতি ভীড়ের কারনে মসজিদে নামিরার আশে পাশেও যাওয়া সম্ভব নয় এ ধারণা মনে পাকাপোক্ত ছিল তা ছাড়া দলছুট কিংবা ছাউনির দিক হারিয়ে ফেললে অসুবিধায় পড়ে যাব এ ছাড়া তাঁবুতে সরাসরি খুতবা শোনার ব্যবস্হা আছে. আমরা আমাদের ছাউনির নিশানা ঠিক রেখে আশেপাশে ঘুরতে লাগলাম. এখনো খুতবা পাঠ করা শুরু হয়নি. আমরা যেখানেই যাচ্ছি সেখানে বিশাল বিশাল ফ্রোজেন লরীর লম্বা সারি চোখে পড়ছে এসব লরী হতে সম্মানিত হাজীদের বিনামূল্যে খাবার, পানীয়, ঔষধ, জায়নামাজ, ছাতা, ব্যাগ, টুপি সহ নানা ধরনের প্রয়োজনীয় জিনিস বিতরন করা হচ্ছে শুধুমাত্র সওয়াবের আশায়. আরবের ধনী ব্যাক্তি স্হানীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এই মহৎ কাজ করে চলেছে যুগের পর যুগ . সবাই হাঁক দিয়ে বলছে "আহলান ইয়া হাজী ছাবিল ছাবিল, তোহ্ফা তোহ্ফা" অর্থাৎ স্বাগতম হে আল্লাহর মেহমান আসুন বিনামূল্যে উপহার গ্রহণ করুন. হেঁটে চলার সময় দুহাত বাড়িয়ে পণ্য ধরিয়ে দিচ্ছেন আবার কেউ নিতে না চাইলেও জোরপূর্বক গছিয়ে দেয়া হচ্ছে. একজন ডানে টানেন তো আর দুই জন টানেন বামে. পবিত্র মিনার মত এখানেও আকাশে হেলিকপ্টার খুব নীচু দিয়ে অনবরত চক্কর দিচ্ছে তবে আজ সংখ্যায় বেশি মনে হচ্ছে ছাউনিতে ফিরে এসে খুতবা শোনার প্রস্তুতি নিলাম আল্লাহর অশেষ রহমতে সবকিছুই ঠিকঠাক আছে . পবিত্র মিনার মত মত এখানেও পবিত্র জমজমের পানির সুব্যবস্হা আছে সৌদি প্রধান মোয়াল্লেম ওয়াকিটকি হাতে নিয়ে সদা তৎপর তিনি প্রতিজন হাজীর সাথে কথা বলে খোঁজ খবর নিচ্ছেন এবং কর্তব্যরত ব্যক্তিদের প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিচ্ছেন. দুপুর ১২টার কিছু পর খুতবা পাঠ শুরু হলো খুতবা পাঠ করছেন সৌদি আরবের গ্র্যান্ড মুফতী "আবদুল আজিজ আল শায়খ". প্রায় অর্ধকোটি হাজীর সমাগম স্হল পবিত্র আরাফাত ময়দানে তখন পিন পতন নীরবতা..
পবিত্র আরাফাত ময়দানের মসজিদে নামিরা, যেখান হতে হজ্বের খুতবা পাঠ করা হয়
দৃষ্টি শক্তিহীন প্রবীণ এই ইমাম প্রায় এক ঘন্টারও বেশি সময় খুতবা পাঠ করার পর মানব জীবন, দৈনন্দিন জীবন, রাস্ট্রীয় জীবন ও ধর্মীয় জীবন সম্পর্কে বয়ান করলেন এবং উপস্হিত সকল হাজীদের অত্যন্ত সৌভাগ্যবান বলে অভিহিত করলেন এরপর সুদীর্ঘ মুনাজাতে সমগ্র মুসলিম উম্মাহ ও বিশ্ববাসীর জন্য দোয়া করলেন বিশেষ ভাবে দোয়া করলেন ফিলিস্তিন, সিরিয়া, চেচেন, ভারত ও বার্মার মুসলিমদের জন্য . বাদ গেলনা বাংলাদেশ পাকিস্তান আফগানিস্তান ইরাক ও ইরানের নামও . সর্বশেষে সবার সুস্বাস্থ্য কামনা করে মুনাজাত সম্পন্ন করলেন আমরা ছাউনিতে বসে মুনাজাতে অংশ নিই.. বেলা তিনটা হয়ে কয়েক মিনিটে জোহরাইন অর্থাৎ জোহর ও আছরের নামাজের আজান দেয়া হলো আজান একটি একামত দুইটি আমরা আমাদের ছাউনিতে জামাতে প্রথমে জোহর এবং এর পর পরই আছরের নামাজ আদায় করলাম. এরপর আবার বাইরে এসে বিভিন্ন দেশের হাজীদের সাথে কথা বললাম...
এরপর ছাবিল অর্থাৎ উপহার দান কারী লরী হতে ছাউনির সকল হাজীদের জন্য কয়েক কার্টন শুকনা খাবার ( বিষ্কুট কেক বোতলজাত পানি ও জুসের বোতল) সংগ্রহ করে ছাউনিতে পাঠিয়ে দিলাম. বেলা প্রায় সাড়ে চারটায় আমাদের কাফেলা প্রধান জনাব মোহাম্মদ আলী আনসারী সাহেব আমাদের হজ্বের তৃতীয় ধাপ পবিত্র মুজদালিফার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হবার প্রস্তুতি নিতে বললেন. সূর্যাস্তের পূর্বে আরাফাতের সীমানা হতে বাহির হওয়া নিষেধ. রাত যতই হোক পবিত্র মুজদালিফায় পৌঁছে মাগরিবাইন অর্থাৎ মাগরিব ও এশার নামাজ আদায় করতে হয়. আমরা গাড়ীতে উঠে বসলাম. সূর্যাস্তের পর পরই অর্থাৎ সন্ধ্যা প্রায় ৬টায় গাড়ী ছাড়ল. গন্তব্য এখন ১০ কিলোমিটার দূরে পবিত্র মুজদালিফা. কষ্ট ও ধৈর্য্যের মানসিকতা নিয়েই সবাইকে এই ১০ কিলোমিটার পথ চলার আহবান জানানো হলো. গাড়ী ধীরে ধীরে দুই মিনিট চলে তো দশ মিনিট দাড়িয়ে থাকে. প্রায় দুই কিলোমিটার আসার পর গাড়ী আর চলেনা. বাসের সামনে ও পিছনে হাজার হাজার বাস দাড়িয়ে আছে ....
পবিত্র আরাফাত টু মুজ্দালিফা - মিনা - জামারার রেল সার্ভিস
আর রাস্তার ডান পার্শ্বে দেখছি সদ্য চালু হওয়া বৈদ্যুতিক ট্রেন প্রতি তিন মিনিটে আসছে আর যাচ্ছে যার গন্তব্যও একি. এই বৈদ্যুতিক ট্রেন ২০১০ সালে চালু হয়. আরাফাত হতে মুজদালিফা হয়ে জামারাহ পর্যন্ত এই রুটের পরিধি.
পবিত্র আরাফাত টু মুজ্দালিফা - মিনা - জামারার রেল সার্ভিস
আজ অবশ্য আরাফাত হতে মুজদালিফা পর্যন্তই যাবে. মূলত হজ্বযাত্রীদের যাতায়াতের সুবিধার্থে এই ট্রেন সার্ভিস চালু করার হয়েছে. এর ভাড়া অত্যন্ত ব্যায়বহুল...
পবিত্র আরাফাত টু মুজ্দালিফা - মিনা - জামারার রেল সার্ভিস
প্রায় ২০ কিলোমিটারের এই রেল পথে ৯টি স্টেশন রয়েছে আরাফাতে ৩টি মুজদালিফায় ৩টি ও মিনায় ৩টি. এই রেল পথের নাম "আল মাশায়ের আল মোগাদ্দাস মেট্রো প্রজেক্ট"...
পবিত্র আরাফাত টু মুজ্দালিফা - মিনা - জামারার রেল সার্ভিস
ওসমানীয় শাসনামলে পবিত্র মদিনা হতে তুরস্কের ইস্তাম্বুল পর্যন্ত রেল যোগাযোগ ছিল. পবিত্র মদিনায় পুরাতন রেল স্টেশনটি এখনো আছে. ..
পবিত্র আরাফাত টু মুজ্দালিফা - মিনা - জামারার রেল সার্ভিস
আর সৌদি সরকার পবিত্র মক্কা হতে জেদ্দা হয়ে পবিত্র মদিনা পর্যন্ত নতুন রেল লাইন নির্মান করছে যা উদ্বোধন করা হবে ২০১৭ সালে. পবিত্র আরাফাত হতে আমাদের গাড়ী ছেড়েছিল সন্ধ্যা ৬টায় আর এখন রাত ১২টা কত পথ এসেছি আর কত পথ বাকী আছে বুঝতে পারছিনা.. হঠাৎ বাইরে দেখলাম অতি পূরানো মডেলের হজ্বযাত্রী বাহী একটি ছাদ বিহীন বাস. ইরানী অথবা শিয়া হাজীরা এহরাম পরা অবস্হায় নাকি কোন ছাদ কিংবা ছাউনির নিচে অবস্হান করেনা তাই তাদের জন্য এই ভিন্ন ব্যবস্হা..
আমাদের গাড়ীতে বয়োবৃদ্ধ ও মহিলা হাজীরা গাড়ীর আসনে বসে আছেন আর আমরা যারা অপেক্ষাকৃত কম বয়সী যুবক হাজী তারা সবাই দাড়িয়ে আছি কিছুক্ষণ পর পর মায়ের মুখের দিকে তাকাচ্ছি বুঝা যাচ্ছে সবার মত তিনিও ক্লান্ত. মায়ের পিছনে বসা এক মহিলা হাজী বেশ অসুস্থতা অনূভব করছেন উনার স্বামী উনাকে সেবা যত্ন করছেন আর অভয় দেয়ার চেষ্টা করছেন. সবাই এত কষ্ট সহ্য করছে অথছ কারো মুখে বিরক্তির লেশ মাত্র নাই আমি একটু বিরক্ত প্রকাশ করেছিলাম তবে হজ্বের কথা ভেবে ও মায়ের হালকা ধমকে চুপসে যাই. পবিত্র মক্কা থেকে পবিত্র মিনা... পবিত্র মিনা থেকে পবিত্র আরাফাত এবং পবিত্র আরাফাত থেকে পবিত্র মুজদালিফার এই ভয়াবহ যানজট থেকে মুক্তি পেতে বিগত অর্ধশতাব্দী ধরে সৌদি সরকার গবেষণা করেই চলেছে. বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার খরছ করে একের পর এক প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে তবুও মুক্তি মিলছে না আশা করা হচ্ছে সঠিক রূপরেখা অনুসরণে জামারাহ'র পাথর নিক্ষেপের স্হানে এখন যে ভাবে শৃংখলা ফিরে এসেছে একই রূপরেখা অনুসরণে এই ভয়াবহ যানজট থেকে মুক্তি মিলবে সহসাই.. . রাত ৩টায় অর্থাৎ ৯ ঘন্টা পর আমরা পবিত্র মুজদালিফায় পৌঁছালাম একে একে সবাই গাড়ী থেকে নামলাম মাগরিবাইন নামাজ পড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি হঠাৎ কান্নার শব্দ শুনে সবাই ছুটে গেলাম গাড়ীতে যে মহিলা হাজী সাহেবান অসুস্থতা অনূভব করছিলেন তিনি পবিত্র মুজদালিফায় নেমেই উনার স্বামীর হাতে মাথা রেখে ইন্তেকাল করলেন (ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্নাইলাহে রাজিউন). আমাদের সবাই এক যোগে কাঁদছিলাম. এমন জান্নাতী মৃত্যু কয় জনের ভাগ্যে হয় ? সাথেই পুলিশ এলো সবাইকে মরহুমার পাশ থেকে সরিয়ে দিলো এর পর হেলালে আহমার (রেড ক্রিসেন্ট) এর গাড়ী এসে পরীক্ষা নিরীক্ষা করে মরহুমা হাজী সাহেবানকে নিয়ে গেল. মরহুমা হাজী সাহেবানের নাম সখিনা খাতুন স্বামীর নাম রফিক আহমদ কাতার প্রবাসী বাড়ী চট্টগ্রামের হাটহাজারী অথবা রাউজানে উনি বিলাপ করে কাঁদছেন আর বলছেন আমার সন্তানদের আমি কি জবাব দেব উনাকে সান্তনা দিয়ে উনি সহ সবাই মাগরিবাইন নামাজ আদায় করলাম. এক সময় ফজরের আজান হলো সবাই জামাতে ফজরের নামাজ আদায় করে শয়তানকে নিক্ষেপের উদ্দেশ্যে পাথর সংগ্রহ করি. সূর্যোদয়ের পর সকাল সাড়ে ৬টায় আমরা পবিত্র মুজদালিফা হতে বিদায় নিয়ে পুনরায় পবিত্র মিনার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম.মাত্র আধাঘন্টারও কম সময়ে আমরা পবিত্র মিনার তাঁবুর সামনে পৌঁছে গেলাম...
বিষয়: বিবিধ
১২৩৩ বার পঠিত, ৫ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন