আশুরায় উদযাপিত কিছু বিদআত
লিখেছেন লিখেছেন মিশু ১১ অক্টোবর, ২০১৫, ০৮:০৭:১৯ সকাল
আশুরায় উদযাপিত কিছু বিদআত
আশুরার দিন লোকেরা সুরমা লাগানো, গোসল করা, মেহেদি লাগানো, মুসাফাহা করা, খিচুড়ি রান্না করা, আনন্দ উৎসবসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানাদির আয়োজন করে থাকে এ সম্বন্ধে শায়খুল ইসলাম ইবনু তাইমিয়া রহ. কে প্রশ্ন করা হল, এর কোনো ভিত্তি আছে কি না?
জবাবে তিনি বললেন, এসব অনুষ্ঠানাদি উদযাপন প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে সহিহ কোনো হাদিস বর্ণিত হয়নি এবং সাহাবাদের থেকেও না। চার ইমামসহ নির্ভরযোগ্য কোনো আলেমও এসব কাজকে সমর্থন করেননি। কোনো মুহাদ্দিস এ ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ ও সাহাবাদের থেকে কোনো সহিহ কিংবা জয়িফ হাদিসও বর্ণনা করেননি। তাবিয়ীদের থেকেও কোনো আছর পাওয়া যায়নি।
যদি আমাদের আমলগুলো শরীয়ত সম্মত হয় তা হলে তা দ্বারা আমরা আল্লাহ তায়ালার নৈকট্য ও সওয়াব লাভ করতে পারব। আর যদি আমলগুলো শরীয়ত সমর্থিত না হয়, বিদ'আত হয়, তাহলে তা পালন করার কারণে আমরা গুনাহগার হবো। আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের পরিবর্তে তার থেকে দূরে সরে পড়ব।
আমাদের সর্বদা ভাল করে মনে রাখতে হবে যে, যে কোন আমল আল্লাহ তায়ালার কাছে কবুল হওয়ার জন্য দুটো শর্ত রয়েছে।
একটি হল : আমলটি আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য করতে হবে।
দ্বিতীয়টি হল : আমলটি অবশ্যই আল্লাহর রসূল (সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর নির্দেশিত পদ্ধতিতে হতে হবে। সোজা কথায় রাসূলের তরীকায় হতে হবে।
যদি আমরা আশুরার অতীত ও বর্তমানের প্রচলিত কাজ-কর্মের দিকে তাকাই তাহলে দেখব যে, এ সকল কার্যাবলী ও অনুষ্ঠানাদি দু ভাগে বিভক্ত।
১। প্রচলিত আমলগুলো ইবাদত হিসেবে স্বীকৃত কিন্তু সেগুলো এ দিনের সাথে খাছ (যুক্ত বা সংশ্লিষ্ট) নয়। যেমন রাতে জাগ্রত থেকে নফল সালাত আদায় করা, কবর যিয়ারত করা, দান-ছদকাহ করা, ফরজ যাকাত আদায় করা, খিচুরী বা বিরিয়ানী পাক করে মানুষদের মাঝে বিলি করা, রাস্তা-ঘাটে মানুষকে পানী পান করতে দেয়া ইত্যাদি। যদিও এ কাজগুলো স্বতন্ত্রভাবে বিদ'আত নয় কিন্তু এগুলো আশুরার দিনের সাথে খাছ করা বিদ'আত।
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বা তাঁর রসূল (সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অথবা সাহাবায়ে কেরাম রা. এ কাজগুলো আশুরার দিনের সাথে খাছ করেননি।
২। যে সকল কাজ ইবাদত নয়, মানুষের অভ্যাসের অন্তর্গত। যেমন এ দিনে গোসল করা,সুরমা ব্যবহার করা, উন্নত মানের খাবার-দাবার আয়োজন করা, গরু-ছাগল জবেহ করা, মেলার আয়োজন করা ইত্যাদি। এগুলো শিয়া ও রাফেজী সম্প্রদায়ের কার্যকলাপ থেকে এসেছে। তারা হুসাইন রা. এর শাহাদাত স্মরণে শোক প্রকাশ ও মাতম করে থাকে।
তারা আশুরা উপলক্ষে এমন কিছু আচার অনুষ্ঠান যোগ করেছে যা ইসলাম ধর্মে নেই। বরং এগুলো ইহুদী ও মুশরিকদের উৎসবের অনুকরণ।
কারবালার ঘটনাকে কেন্দ্র করে যে সমস্ত ধারণা ঠিক নয়:
হোসাইন ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের মৃত্যুতে আকাশ থেকে রক্তের বৃষ্টি হওয়া, সেখানের কোন পাথর উঠালেই তার নীচ থেকে রক্ত প্রবাহিত হওয়া এবং কোন উট জবাই করলেই তা রক্তে পরিণত হয়ে যাওয়ার ধারণা মিথ্যা ও বানোয়াট। মুসলমানদের আবেক ও অনুভূতিকে জাগিয়ে তুলে তাদেরকে বিভ্রান্ত করার জন্যই এ সমস্ত বানোয়াট ঘটনা বলা হয়ে থাকে। এগুলোর কোন সহীহ সনদ নেই।
ইমাম ইবনে কাসীর র. বলেন: হোসাইনের মৃত্যুর ঘটনায় লোকেরা উল্লেখ করে থাকে যে, সে দিন কোন পাথর উল্টালেই রক্ত বের হত, সে দিন সূর্যগ্রহণ হয়েছিল, আকাশের দিগন্ত লাল হয়ে গিয়েছিল এবং আকাশ থেকে পাথর বর্ষিত হয়েছিল। এসব কথা সন্দেহ মূলক। প্রকৃত কথা হচ্ছে, এগুলো বিশেষ একটি গোষ্ঠীর বানোয়াট ও মিথ্যা কাহিনী ছাড়া আর কিছুই নয়। তারা বিষয়টিকে বড় করার জন্য এগুলো রচনা করেছে।
কোন সন্দেহ নেই যে, কারবালার ময়দানে সপরিবারে হোসাইনের শাহাদাত বরণ একটি বিরাট ঘটনা। কিন্তু তারা এটিকে কেন্দ্র করে যে মিথ্যা রচনা করেছে, তার কোনটিই সংঘটিত হয় নি।
ইসলামের ইতিহাসে হোসাইনের মৃত্যুর চেয়ে অধিক ভয়াবহ ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। সে সমস্ত ঘটনায় উপরোক্ত বিষয়গুলোর কোনটিই সংঘটিত হয় নি।
হোসাইনের পিতা আলী রা. আব্দুর রাহমান মুলজিম খারেজীর হাতে নির্মম ভাবে নিহত হন। সকল আলেমের ঐকমতে হুসাইনের চেয়ে আলী রা. অধিক শ্রেষ্ঠ ও সম্মানিত ছিলেন। তার শাহাদাতের দিন কোন পাথর উল্টালেই রক্ত বের হয় নি, সে দিন সূর্যগ্রহণ হয় নি, আকাশের দিগন্ত লাল হয়ে যায় নি এবং আকাশ থেকে পাথরও বর্ষিত হওয়ারও কোন প্রমাণ নেই।
উসমান বিন আফফান রা.এর বাড়ি ঘেরাও করে বিদ্রোহীরা তাঁকে হত্যা করে। তিনি মজলুম অবস্থায় শাহাদাত বরণ করেন। তাঁর মৃত্যুতে এসবের কোনটিই সংঘটিত হয় নি।
উসমান রা.এর পূর্বে খলীফাতুল মুসলিমীন উমর ইবনুল খাত্তাব ফজরের নামাযে দাঁড়ানোর সময় নির্মমভাবে নিহত হন। এই ঘটনায় মুসলিমগণ এমন মুসীবতে পড়েছিলেন, যা ইতিপূর্বে কখনও পড়েন নি। তাতে উপরোক্ত লক্ষণগুলো দেখা যায় নি।
আল্লাহর সর্বশেষ্ঠ বান্দা সমগ্র নবী-রাসূলের সরদার রাহমাতুল লিল আলামীন মৃত্যু বরণ করেছেন। তাঁর মৃত্যুতে এমন কিছু সংঘটিত হয় নি।
যেদিন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শিশু পুত্র ইবরাহীম মৃত্যু বরণ করেন, সেদিন সূর্যগ্রহণ লেগেছিল। লোকেরা বলতে লাগল: ইবরাহীমের মৃত্যুতে আজ সূর্যগ্রহণ হয়েছে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সূর্যগ্রহণের নামায আদায় করলেন এবং খুতবা প্রদান করলেন। খুতবায় তিনি বর্ণনা করলেন যে, সূর্য এবং চন্দ্র কারও মৃত্যু বা জন্ম গ্রহণের কারণে আলোহীন হয় না।
এগুলো আল্লাহর নিদর্শন। তিনি এগুলোর মাধ্যমে তাঁর বান্দাদেরকে ভয় দেখিয়ে থাকেন।
যে মুসলিম আল্লাহকে ভয় করে তার জন্য হুসাইনের নিহত হওয়ার ঘটনা স্মরণ করে বিলাপ করা, শরীর জখম করা, গাল, মাথা ও বুক থাবড়ানো বা এ রকম অন্য কিছু করা জায়েজ নেই।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:
“যে ব্যক্তি মুসীবতে পড়ে নিজ গালে চপেটাঘাত করল এবং শরীরের কাপড় ছিঁড়ল, সে আমাদের দলের নয়।” (বুখারী)
তিনি আরও বলেন:
“মুসীবতে পড়ে বিলাপকারী, মাথা মুন্ডনকারী এবং কাপড় ও শরীর কর্তনকারীর সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই।”
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরও বলেন:
“মৃত ব্যক্তির উপর বিলাপকারী যদি তওবা না করে মারা যায়, তাকে কিয়ামতের দিন খাঁজলীযুক্ত (লোহার কাঁটাযুক্ত) কোর্তা পড়ানো হবে এবং আলকাতরার প্রলেপ লাগানো পায়জামা পড়ানো হবে।” (মুসলিম)
তিনি আরও বলেন:
“আমার উম্মতের মধ্যে জাহেলী যুগের চারটি স্বভাব বিদ্যমান রয়েছে। তারা তা ছাড়তে পারবে না।
(১) বংশ মর্যাদা নিয়ে গর্ব করা,
(২) মানুষের বংশের নাম তুলে দুর্নাম করা,
(৩) তারকারাজির মাধ্যমে বৃষ্টি প্রার্থনা করা এবং
(৪) মৃত ব্যক্তির উপর বিলাপ করা। তিনি আরও বলেন: মানুষের মাঝে দুটি জিনিষ রয়েছে, যা কুফরীর অন্তর্ভুক্ত। মানুষের বংশের বদনাম করা এবং মৃত ব্যক্তির উপর বিলাপ করা।” (মুসলিম)
তিনি আরও বলেন:
“মৃত ব্যক্তির উপর বিলাপ করা জাহেলিয়াতের অন্তর্ভুক্ত। বিলাপকারী যদি তওবা না করে মারা যায়, তাকে কিয়ামতের দিন আল্লাহ আলকাতরার প্রলেপ লাগানো জামা পড়াবেন এবং অগ্নি শিখা দ্বারা নির্মিত কোর্তা পরাবেন।” (ইবনে মাজাহ)
একজন বিবেকবান মুসলিমের উপর আবশ্যক হচ্ছে সে এ ধরণের মুসীবতের সময় আল্লাহর নির্দেশিত কথা বলবে।
আল্লাহ্ তায়ালা বলেন:
“যখন তাঁরা বিপদে পতিত হয়, তখন বলে, নিশ্চয়ই আমরা সবাই আল্লাহর জন্য এবং আমরা সবাই তারই সান্নিধ্যে ফিরে যাবো।” (সূরা বাকারাঃ ১৫৬)
হুসাইনের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র আলী বিন হুসাইন, মুহাম্মাদ এবং জাফর জীবিত ছিলেন। তাদের কেউ হুসাইনের মৃত্যুতে মাতম করেছেন বলে প্রমাণ পাওয়া যায় না। তারা ছিলেন আমাদের হেদায়েতের ইমাম ও আদর্শ।
বিলাপ করা, গাল ও বুকে চপেটাঘাত করা বা এ জাতীয় অন্য কোন কাজ কখনই এবাদত হতে পারে না। আশুরার দিনে ক্রন্দনের ফজিলতে যে সমস্ত বর্ণনা উল্লেখ করা হয় তার কোনটিই বিশুদ্ধ নয়।
বিলাপ করা জাহেলী জামানার আচরণ বলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদেরকে তা থেকে বিরত থাকার আদেশ দিয়েছেন।
বিষয়: বিবিধ
১২২৭ বার পঠিত, ৪ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
যথার্থ বলেছেন,
আপনাকে অনেক ধন্যবাদ, জাযাকাল্লাহ
ওয়া আলাইকুম আসসালাম ওয়া রাহমাতুল্লাহ ওয়া বারাকাতুহ..
জাযাকাল্লাহী খাইরান।
মন্তব্য করতে লগইন করুন