মানুষ সৃষ্টির উপাদান ও সৃষ্টিগতভাবে তাদের স্বভাব

লিখেছেন লিখেছেন সামসুল আলম দোয়েল ২৮ জানুয়ারি, ২০১৯, ০৯:৪৮:২৫ রাত

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম

মানুষ সৃষ্টি হয়েছে সর্বোত্তম আকৃতিতে



لَقَدْ خَلَقْنَا الْإِنْسَانَ فِي أَحْسَنِ تَقْوِيمٍ

আমি তো সৃষ্টি করেছি মানুষকে সুন্দরতম গঠনে। ( সূরা ত্বীন, ৯৫:৪)

আল্লাহ তাআলা প্রতিটি প্রাণীকে সৃষ্টি করেছেন নিচুমুখী করে। কেবলমাত্র মানুষকে সৃষ্টি করেছেন আলম্বিত দেহ সোজা করে। তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে যথোপযোগী বানিয়েছেন। তাতে পশুর মত বেমানান ও অসামঞ্জস্য নেই। তাতে বাকশক্তি, বিবেক-বুদ্ধি, চিন্তা-চেতনা, বোধশক্তি, প্রজ্ঞা, শ্রবণ ও দৃষ্টিশক্তি দান করেছেন। যার ফলে মানুষ আসলে তাঁর কুদরতের প্রকাশস্থল এবং তাঁর শক্তিমত্তার প্রতিবিম্ব।

অপর আয়াতে আল্লাহ বলেন-

'যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন, অতঃপর তোমাকে সুঠাম করেছেন এবং তারপর সুসমঞ্জস করেছেন।' ( সূরা ইনফিতার, ৮২:৭)



আল্লাহ আরো বলেন-

"নিশ্চয়ই আমি মানুষকে সৃষ্টি করেছি মিলিত শুক্রবিন্দু হতে, যাতে আমি তাকে পরীক্ষা করি, এই জন্য আমি তাকে করেছি শ্রবণ ও দৃষ্টিশক্তিসম্পন্ন"। (সূরা ইনসান, ৭৬:২)



মানুষ সর্বোত্তম গঠন ও সুন্দর আকৃতিতে সৃষ্টি হয়েছে, তেমনি আল্লাহ সমস্ত সৃষ্টিকুল উত্তমরূপে সৃষ্টি করেছেন। "যিনি তাঁর প্রত্যেকটি সৃষ্টিকে উত্তমরূপে সৃজন করেছেন এবং মাটি হতে মানব-সৃষ্টির সূচনা করেছেন।" ( সূরা সাজদা, ৩২:৭)

মানুষ সৃষ্টির উপাদান:



"নিশ্চয়ই আমি মানুষকে সৃষ্টি করেছি কালো পচা শুষ্ক ঠনঠনে মাটি হতে।" ( সূরা হিজর, ১৫:২৬)

এখানে মহান আল্লাহ মানুষের সৃষ্টির সুচনা কথা যেভাবে বর্ণনা করেছেন তাতে মনে হয় যে, আদমের দেহ প্রথমে দুর্গন্ধযুক্ত কাদামাটি দিয়ে তৈরী করেছিলেন এবং যখন তা শুকিয়ে তা থেকে ঠনঠন্ শব্দ বের হতে শুরু করল, তখন তার মধ্যে জীবন দান করেছিলেন। অপর আযাতে এসেছে-

"মানুষকে তিনি সৃষ্টি করেছেন পোড়া মাটির মত শুষ্ক মাটি থেকে।" (সূরা রাহমান, ৫৫:১৪)

এখানে মানুষ বলতে আদম (আঃ)-কে বুঝানো হয়েছে। যাঁর প্রথমে মাটি থেকে (মানুষের) আকার তৈরী করা হয়। অতঃপর আল্লাহ তাতে ‘রূহ’ ফুঁকেন (আত্মাদান করেন)। তারপর আদম (আঃ)-এর বাম পাঁজরের হাড় থেকে হাওয়াকে সৃষ্টি করেন এবং এর পর থেকে তাঁদের উভয়ের মাধ্যমে (নারী-পুরুষ থেকে নির্গত ডিম্বাণু ও শুক্রাণুর দ্বারা) মানুষ সৃষ্টির ধারাবাহিকতা চলতে থাকে। আল্লাহ বলেন-

"নিশ্চয়ই আমি মানুষকে সৃষ্টি করেছি মাটির উপাদান হতে।অতঃপর আমি ওকে শুক্রবিন্দু রূপে স্থাপন করি এক নিরাপদ আধারে । পরে আমি শুক্রবিন্দুকে পরিণত করি রক্তপিন্ডে, অতঃপর রক্তপিন্ডকে পরিণত করি গোশতপিন্ডে এবং গোশতপিন্ডকে পরিণত করি অস্থিপঞ্জরে; অতঃপর অস্থি-পঞ্জরকে ঢেকে দিই গোশত দ্বারা; অবশেষে ওকে গড়ে তুলি অন্য এক সৃষ্টিরূপে; অতএব সর্বোত্তম স্রষ্টা আল্লাহ কত মহান! (সূরা মুমিনুন, ২৩: ১২-১৪)



"তিনি মানুষকে বীর্য হতে সৃষ্টি করেছেন; পরে সে প্রকাশ্য বিতন্ডাকারী হয়ে বসল!" ( সূরা নাহল, ১৬:৪)

তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে এক শুক্রবিন্দু থেকে যা জীবন্ত দেহ থেকে নির্গত হয়, যাকে বীর্য বলা হয়। তাকে বিভিন্ন পর্যায়ে পার করার পর এক পূর্ণ আকার দান করা হয়। তারপর তাতে (রূহ, বিশেষ) জীবন দান করা হয়। এরপর মায়ের পেট হতে পৃথিবীতে আনা হয়। পৃথিবীতে সে জীবন যাপন করতে করতে যখন জ্ঞানপ্রাপ্ত হয়, তখন সে তার প্রতিপালক আল্লাহর ব্যাপারে বিতর্ক করে, তাঁকে অস্বীকার করে বা তাঁর সাথে অন্যকে শরীক করে।

"তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে সবেগে স্খলিত পানি থেকে। এটা নির্গত হয় মেরুদন্ড ও পঞ্জরাস্থির মধ্য হতে, ( সূরা ত্বরিক, ৮৬:৬-৭)



পুরুষের পৃষ্ঠদেশ ও নারীর বক্ষস্থল থেকে নির্গত উভয়ের পানি হতে মানুষের সৃষ্টি হয়। যা শুক্রাণু ও ডিম্বাণু নামে পরিচিত। কিন্তু উভয় শ্রেণীর পানিকে একই পানি এই জন্য বলা হয়েছে যে, উভয়ের পানি মিলে এক হয়ে যায় তাই।

মানুষ সৃষ্টিগতভাবে দুর্বল:



يُرِيدُ اللَّهُ أَنْ يُخَفِّفَ عَنْكُمْ ۚ وَخُلِقَ الْإِنْسَانُ ضَعِيفًا

আল্লাহ তোমাদের ভার লঘু করতে চান। আর মানুষ সৃষ্টিগতভাবেই দুর্বল। (সূরা নিসা ৪:২৮)



মানুষ জন্মগতভাবে দুর্বল, তার আকাঙ্খা ও প্রবৃত্তিও দুর্বল। যেহেতু মানুষ সৃষ্টিগতভাবেই দুর্বল তাই তারা দৈহিক ও স্বভাবগতভাবেও দুর্বল। তাই আল্লাহ তাদের জন্য শরীয়াতের আহকামকে করেছেন সহজ-সাধারণ, কোনো কাঠিন্য রাখেন নি। যেমন- উম্মাতে মুহাম্মাদীর জন্য ৫০ ওয়াক্তের স্থলে ৫ ওয়াক্ত সালাতকে ফরয করা হয়েছে এবং এতে ৫০ ওয়াক্ত সালাতের ফযিলত বিদ্যমান।

ইবনে আবি হাতেম তার তাফসীরে বলেন- মানুষের এই দুর্বলতা নারীদের ক্ষেত্রে, মহিলার ব্যাপারে পুরুষ নিতান্তই দুর্বল। এই কারণে নারীদের সংস্পর্শে এলে তাদের বুদ্ধি লোপ পায়, সহজেই তাদের জালে আটকা পড়ে।

(দ্রষ্টব্য: তাফসীরে তাবারী, ইবনে কাসীর)

মানুষকে সৃষ্টিগতভাবে তাড়াহুড়োপ্রবণ:



خُلِقَ الْإِنْسَانُ مِنْ عَجَلٍ

মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে ত্বরা-প্রবণ করে। ( সূরা ২১ আম্বিয়া: ৩৭)



পুন্শ্চ: আয়াতের দুটি ব্যাখ্যা, প্রথমত আদম (আ.)কে সৃষ্টি করা হয়েছে দিনের শেষ প্রহরে তাড়াতাড়ি করে এবং তিনি সৃষ্টিগত ভাবে তাড়াহুড়ো প্রবণ। তাই মানুষের প্রকৃতিই হল জলদি ও তাড়াহুড়ো করা।

যেমন অপর আয়াতে এসেছে-

وَيَدْعُ الْإِنْسَانُ بِالشَّرِّ دُعَاءَهُ بِالْخَيْرِ ۖ وَكَانَ الْإِنْسَانُ عَجُولًا

"মানুষ যেভাবে কল্যাণ কামনা করে, সেভাবেই অকল্যাণ কামনা করে; বস্তুতঃ মানুষ শীঘ্রতা-প্রিয়।" ( সূরা ১৭ ইসরা: ১১)



মানুষ অস্থিরপ্রবণ:



إِنَّ الْإِنْسَانَ خُلِقَ هَلُوعًا

মানুষ তো সৃজিত হয়েছে অতিশয় অস্থিরচিত্তরূপে। ( সূরা মাআরিজ, ৭০:১৯)



অর্থ্যাৎ তারা অল্পতেই ভেঙ্গে পড়ে, তাদের চিত্ত খুবই দুর্বল। অত্যধিক লোভী এবং বেশী হা-হুতাশকারীকে هَلُوعٌ বলা হয়। কেননা, এমন ব্যক্তিই কৃপণ ও লোভী হয় এবং খুব বেশী হা-হুতাশ করে। যেমন, পরের আয়াতে বলা হয়েছে-

"যখন তাকে বিপদ স্পর্শ করে, তখন সে হয় হা-হুতাশকারী।আর যখন তাকে কল্যাণ স্পর্শ করে, তখন সে হয় অতি কৃপণ।" (সূরা মা'আরিজ, ৭০:২০-২১)



যেহেতু মানুষ স্বভাগতভাবে ও চরিত্রগতভাবে দুর্বল, তাদের চিত্ত অস্থিরপ্রবণ, তাই তারা অল্প বিপদেই ভেঙ্গে পড়ে এবং তাদের স্বচ্ছ্বল অবস্থায় তারা বিপদের কথা ভুলে যায়। তবে এই স্বভাবকে জয় করতে পারে মুমিনরা যারা সালাতকে প্রতিষ্ঠা করে। পরবর্তী আয়াত সমূহে সেই সব গুণাবলী বর্ণনা হয়েছে। যারা শরীয়াতের বিধান পুরোপুরিভাবে মেনে চলে তাদের চিত্ত দুর্বল নয়।

মানুষ সৃষ্টি হয়েছে বিপদ-কষ্টের ভিতর



لَقَدْ خَلَقْنَا الْإِنْسَانَ فِي كَبَدٍ

অবশ্যই আমি মানুষকে সৃষ্টি করেছি বিপদ-কষ্টের মধ্যে। (সূরা বালাদ, ৯০:০৪)



পুনশ্চ: এই আয়াতের তাফসীরে বিদ্বানরা দুই ধরণের অর্থ গ্রহণ করেছেন। প্রথমতঃ মানুষের সৃষ্টি হয় (মায়ের) কষ্ট ও ক্লেশের মধ্য দিয়ে। যেমন আল্লাহ বলেন- "তার মাতা তাকে গর্ভে ধারণ করে কষ্টের সাথে এবং প্রসব করে কষ্টের সাথে,...." ( সূরা আহকাফ, ৪৬:১৫) আর দ্বিতীয়ত মানুষের জীবন পরিশ্রম ও দুঃখ-কষ্টে পরিপূর্ণ। নানা সময় তাদের উপর বিপদাপদ, কষ্ট-ক্লেশ আপতিত হয়। মূলত মানুষকে বিপদাপদ দিয়ে পরীক্ষা করা হয়- কে বিপদে পড়ে ধৈর্য ধারণ করে একমাত্র তার উপরই ভরসা করে এবং বিপদ থেকে মুক্ত হয়ে তার কৃতজ্ঞতা আদায় করে।

‘নিশ্চয়ই আমি তোমাদেরকে কিছু ভয় ও ক্ষুধা দ্বারা, ধন-সম্পদের ক্ষতি ও প্রাণহানি এবং ফল-ফসলের ক্ষতি দ্বারা পরীক্ষা করব। আর তুমি ধৈর্যশীলদের সুসংবাদ দাও।’ (সুরা বাক্বারা, ২ : ১৫৫)



হাদীসে এসেছে- রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আল্লাহ যার কল্যাণ চান তাকে বিপদে আক্রান্ত করেন। (সহীহ বুখারী: ৫৬৪৫)

সংকলন ও সম্পাদনায়: সামসুল আলম

বিষয়: সাহিত্য

৬৩০ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File