★*★বাইঞ্চোতের একদিন★*★

লিখেছেন লিখেছেন মামুন ০৭ মে, ২০১৬, ০৯:০৮:৩১ রাত

গন্ধব্রিজ একটা জায়গার নাম। অনেকগুলো গার্মেন্টস এলাকাটিকে এক ঘনবসতিতে পরিণত করেছে। পিচ ঢালা পথ বড় রাস্তা থেকে শাখা রাস্তায় রুপ নিয়ে সাপের মত একেবেঁকে অনেক ভেতরে চলে গেছে। স্থানীয়দের বাড়ির সরুগলি গুলোও তাদের প্রভাবের সামনে নিজের 'অরিজিন' ধরে রাখতে পারেনি। সরু পিচের দৃষ্টিকটু অবয়ব নিয়ে একসময়ের ইটের সলিং কি ধুলোমাখা এলেবেলে পথ নিরন্তর ধুঁকছে। শিহাবের এমনই মনে হয়। যতবারই সে অফিস থেকে মেসে ফিরতে যেয়ে এদের বুক মাড়িয়ে যায়, কেন জানি ঠিক এমন অনুভূতি-ই ওর মনে জাগে।

মনিরের চা'র দোকানে একটু সময় বসে। প্রতিদিনের অভ্যাস। চা'র আর ধুমপানের। দুটো-ই বাজে অভ্যাস। দুধ চা বানানো হয় যে কন্ডেক্স মিল্কে, সেটাও নাকি ক্যামিকেল দিয়ে বানানো হয়। স্যাম্পল ইঞ্চার্জ সেদিন রঙ চা'র কাপে চুমুক দিতে দিতে তথ্যটি বিস্তারিত জানালেন। যারা দুধ-চা-প্রেমী, ভ্রু কুঁচকে বক্তার কথার উত্তরে কিছু না বলে শ্রেফ তাকিয়েছিল। শিহাব তাদের তাকানোর ভঙ্গি দেখে এভাবে অনুবাদ করেছিল নিজের মনে, ' হ, তোরে কইছে, তুই বেশী জানস।'

আজকাল মানুষের দৃষ্টিতে মেখে থাকা অনুচ্চারিত কথাগুলির এক সার্থক অনুবাদক হয়ে উঠেছে শিহাব। করার-ই বা কী আছে? গোলামীর জীবন... বড্ড একেলা জীবন.. কষ্টের মাঝসাগরে পড়ে থাকার মত। নিঃসঙ্গতা কাঁটার নয়। জেনেও সামান্য সময়ের জন্য সামাজিক মানুষ হবার অনুভবে প্রগলভ হয়ে উঠতে এই চা'র দোকানে কিছু সময় বসে থাকা।

একজন কথায় কথায় বলে উঠে, 'সারা রাত কারেন্ট ছিল না। বাইরে ছিল না বাতাসও। এই বিদ্যুত মন্ত্রী বাইঞ্চোতটা কে যেন? কি বাল ফালাইতাছে...'

পাশের জন পান মুখে নিয়ে ছাগলের মত চাবায় আর বলে,' বিদ্যুৎ মন্ত্রী নাই অহন.. প্রতিমন্ত্রী দিয়া কাম চালাইতাছে।'

মনিরের দোকানটি বেশ বড়। এক সাথে কয়েকটি বেঞ্চ পাতা। অনেক খদ্দের যাতে বসতে পারে, তাই এই ব্যবস্থা। যে দুজন বিদ্যুতের অভাব নিয়ে আলোচনা করছিল, তাদের মুখোমুখী আরো তিনজন বসে ছিল। দুজন নীরবে চা'র কাঁপে চুমুক দিচ্ছে, সিগ্রেটের ধুঁয়ায় নিজেদের চোখও কুঁচকে রেখে কথা শুনছিল। তৃতীয়জন তুড়ির দ্বারা হাতের সিগ্রেটের ছাই ঝেরে ঐ দুজনের প্রথম জনকে জিজ্ঞেস করে, ' তোদের সময়ে মনে হয় বিদ্যুতে দ্যাশ ভরা ছিল। কানসাটের কথা মনে আছে ? নাকি দুই টার্ম ক্ষমতায় না থাইক্যা মাথা এক্কেরে গ্যাছে, তাই আবল তাবল বকছিস। বাইঞ্চোত তোদের সময়ের বিদ্যুত প্রতিমন্ত্রী... কি যেন নাম ছিল...টুকু... হ্যা, টুকুর কথা ভুলে গেলি!!'

এভাবে সরকার দলীয় এবং বিরোধী দলীয় সমর্থকদের ভেতরে কথার পীঠে কথা চলে। হাসি-ঠাট্টায় সময় পার হয়। কখনো গোল বাঁধে। হাতাহাতি কিংবা আরো বেশীদূর পর্যন্ত গড়ায়। এসব দেখে দেখে বড্ড ত্যাক্ত-বিরক্ত শিহাব। এবার আর নিজেকে সম্বরণ করতে পারে না সে। উঠে দাঁড়ায় হঠাৎ করে। ওর দাঁড়ানোর ভঙ্গিটা এমন ছিল যে , আলোচনারত দুটি দলই নিশ্চু হয়ে ওর দিকে তাকায়। ধীরে ধীরে সবার দিকে তাকায় শিহাব। ওদের একজন এভাবে স্বল্পপরিচিত শিহাবকে তাকাতে দেখে জানতে চায়, ' কিছু বলবেন কী আপনি?'

শিহাবের ঠোঁট সামান্য বেঁকে যায়। সে ওদের সকলের উদ্দেশ্যে বলে-

'আসলে অনেকক্ষণ ধরে তোমাদের কথা শুনছিলাম। তাই নিজেকে আর স্থির রাখতে পারলাম না।'

- আপনি আমাদেরকে কিছু জানাতে চাইছেন?

'হ্যা। এই যে তোমরা একদল এখনকার সরকারের উপর সন্তুষ্ট নও, অপরদল আগের সরকারের। একজন অন্যজনের সমর্থণকৃত দলের মন্ত্রীদেরকে বাইঞ্চোত বলছ, আসলে বাইঞ্চোত কিন্তু তোমরা নিজেরা-ই।'

শিহাবের কথায় পাঁচজন সহ অন্য যারা দোকানে ছিল, তারাও টাসকি খেয়ে যায়। তবে ওরা মধ্যবয়স্ক মানুষটির মুখ থেকে এমন কথা শুনে রিয়্যাক্ট ও করতে পারে না। একজন তাই যতটুকু কোমলভাবে জিজ্ঞেস করা যায়, সে শিহাবের কাছে জানতে চায়, তবে তাঁর কথার টোনে রুক্ষ্ণতা প্রকাশ হয়েই যায়,

- আপনি সোজা কথায় বলুন কি বলতে চেয়েছেন?

শিহাব একটু হেসে নিজের বাঁকা ঠোঁটকে সোজা করে। তারপর নিরুত্তাপ কন্ঠে বলে যায়,

'তোমরা ভিন্ন ভিন্ন রাজনৈতিক সরকারের সমর্থক। একে অন্যের দিকে কাদা ছোড়াছুড়ি করছ। তোমরা কেউ-ই কোনো সময়ের সরকারের উপর সন্তষ্ট নও। তোমাদের ভাষায় তারা সবাই-ই বাইঞ্চোত। কিন্তু এবার তোমরা আমাকে উত্তর দাও তো দেখি, যখন ফখরুদ্দিন-মইনউদ্দীন এর আমলে সকলকে ভেতরে রাখা হয়েছিল, কিছু একটা পরিবর্তনের আশা দেখা দিচ্ছিল, তখন তোমরা সবাই মিলে দূর্ণীতির দায়ে আটক শীর্ষ নেতাদের মুক্তির জন্য লাফিয়েছিলে কেন? আর তাদের মুক্ত ই যখন করলে, তাদের ক্ষমতায় থাকাকালীন তবে নিজেদের অপুর্ণতার জন্য আক্ষেপ করছ কেন? এই কষ্ট..বিদ্যুতহীন নির্ঘুম রাত.. এসবই তোমাদের নিজেদের চেয়ে নেয়া কিন্তু। তাই কাউকে বাইঞ্চোত বলতে-ই হয় যদি, নিজেদেরকে বলো।'

পাঁচজনের সবাই চুপচাপ থাকে। একজন কেবল ধীর স্বরে শিহাবের কাছে জানতে চায়,

- এখন তবে আমাদের করণীয় কী?

ফস করে দিয়াশলাইয়ের কাঠি জ্বেলে আগুনের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে শিহাব। এরপর ঠোঁটে লাগানো সিগ্রেটটি জ্বালিয়ে একমুখ ধুয়া ছেড়ে ওদেরকে বলে,

' এলহন করণীয় কিছুই নেই, কেবল সকাল সন্ধ্যা দুই বেলা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে জপতে থাকবে- আমি বাইঞ্চোত- আমি-ই বাইঞ্চোত।'

মনিরের চা'র দোকানের সামনের রাস্তা কিছুদিন আগেই পিচ ঢালাই করা হয়েছে। এরই ভেতর জায়গায় জায়গায় খুবলে নষ্ট হয়েছে। এলাকার চাঁদাবাজ ও পাতি নেতাদের দিয়ে দিয়ে কন্ট্রাকটরের নিজের লাভ রেখে রাস্তার পেছনে ঢালবার মত আর কি থাকে? তাই রাস্তাটির ভেতরের রুক্ষ্ণতা সকল অন্তসার:শুণ্যতা সহ মুখ ব্যদান করে রয়েছে যেন! হেটে বাসায় ফেরার সময় ভাংগা জায়গায় শিহাবের পা বেকায়দায় পড়ে মচকে যায়। অস্ফুট যন্ত্রণায় নীল হতে হতে ওর মুখ থেকে একটা শব্দই বের হয়, ' উফ! আমি-ই বাইঞ্চোত!'

বিষয়: সাহিত্য

৯৩১ বার পঠিত, ৬ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

368313
০৭ মে ২০১৬ রাত ০৯:২০
কুয়েত থেকে লিখেছেন : ভালো লাগলো পিচ ঢালা পথ বড় রাস্তা থেকে শাখা রাস্তায় রুপ নিয়ে সাপের মত একেবেঁকে অনেক ভেতরে চলে গেছে। ধন্যবাদ
০৭ মে ২০১৬ রাত ০৯:৫৪
305711
মামুন লিখেছেন : সাথে থেকে অনুভূতি রেখে গেলেন, জাজাকাল্লাহু খাইর।
আসলে আমরা নিজেদের দু;খ-দুর্দশা যার জন্য বর্তমানে হাহাকার করছি, এর সবটাই নিজেদের চেয়ে নেয়া। তাই এখন হাহাকার করে লাভ নাই, এখন জেগে ওঠার সময়।
368349
০৭ মে ২০১৬ রাত ১১:৫৮
তোমার হৃদয় জুড়ে আমি লিখেছেন : ভালোই,, গল্পের মাধ্যমে সমাজের অসংগতি কিছুটা উঠে এসেছে .. ধন্যবাদ আপনাকে
০৮ মে ২০১৬ রাত ১২:৪৮
305722
মামুন লিখেছেন : আমি একজন অণুগল্পকার। ছোট ছোট অসংগতি এক একটি গল্পে তুলে ধরার চেষ্টা করি। পাঠক যার যার মত, অনুভবে গল্পটিকে নিজের মত বিস্তার ঘটাবেন এবং একটা মোরাল দিয়ে যাবেন।
ধন্যবাদ আপনাকে।
368365
০৮ মে ২০১৬ সকাল ০৫:৩৩
শেখের পোলা লিখেছেন : দোষ নিজেদেরই। এটা মানার লোক আসলেই খুব কম আছে। মখ্যম বলেছেন বটে।
০৮ মে ২০১৬ সকাল ১১:৩৮
305734
মামুন লিখেছেন : সহমতে থাকার জন্য ধন্যবাদ প্রিয় ভাই।
অনেক ভালো থাকুন আপনি।

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File