পেন্সিলে লিখা বাবার ডায়েরি (ধারাবাহিক উপন্যাসঃ পর্ব-২৮)
লিখেছেন লিখেছেন মামুন ০৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৫, ০৭:৩৪:৪৭ সন্ধ্যা
মিথিলা বাবু!
একাডেমিক পড়ালিখার পাশাপাশি অতিরিক্ত আরো কিছু বেশী সময় দিতে লাগলাম বিপ্লব সংক্রান্ত লিখাগুলোয়। যেখানে যত বই পেলাম, সব ধীরে ধীরে পড়ে যেতে থাকলাম। একটা পরিষ্কার ধারণা লাভ করতে চাইছিলাম আসলে এই শ্রেণিবিপ্লব সম্পর্কে।
কিন্তু আমার চোখের সামনে আমি যা দেখছিলাম, তাতে ঐ তাত্ত্বিকদের লিখে যাওয়া কালো অক্ষরগুলো আরো নিকশ কালো হয়ে আমাকে বিভ্রান্ত করে দিচ্ছিল।
একজনের লিখা পড়লাম।
সেখানে আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতের সাথে আমাদের দেশের গোপন দলগুলোর সাদৃশ্য এবং বৈসাদৃশ্য দেখানো হয়েছে। যদিও অনেক পয়েন্টেই আমি মতের মিল রাখতে পারলাম না। তবুও একটা যায়গায় গিয়ে ভালো লাগলো। সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে, ওপাড়ের মানে ভারতে শ্রেণিবিল্পব জনগণকে সম্পৃক্ত রেখেই করা হচ্ছে। তাই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কিছু জীবন বলি হলেও বৃহৎ সার্থের কথা চিন্তা করে জনগন তাদের সাথে থাকে। যেটা আমাদের দেশে অনুপস্থিত। আমাদের দেশে শুধুমাত্র পার্টি ফান্ডের জন্য চাঁদা তোলাটাই মূখ্য হয়ে দাঁড়ায়।
যারা তরুন তারা তাত্ত্বিকদের নিরদেশে দলে ঢোকে তো ঠিকই, কিন্তু তারাও জানে তারা আর ফিরতে পারবে না, তারা মারা যাবে। এটা জেনেও তারা হাসি-কান্না আনন্দ-বেদনায় আপ্লুত হয়। এক সময় জীবনের সব আশা ফুরায়...খুব অল্পতেই এরা তারা হয়ে মিশে যায়। তাদের শূন্যস্থান যারা নিতে আসে, তারাও ঐ একই অনুভূতিতে প্রগলভ হয়েই দলে আসে। এভাবে একটা পৌনঃপুনিক আসা আর যাওয়ার মাঝেই সীমাবদ্ধ আমাদের দেশের শ্রেণি সংগ্রামের রাজনীতি।
বাবা যদিও গ্রামের বাড়িতে যান না। কিন্তু সেখানের খবরাখবর দাদীর মারফতে মায়ের কাছে আসে। মা সব বাবাকে বলেন। আর বাবা নিজের মনে হজম করে রাখেন। কিন্তু বাতাসে ইথারে ভেসে বেড়ানো কথাও তো মানুষের কানে আসে। বাদলের দ্বারা এমন কিছু কথা আমার কানে এলো যা শুনে আমিও নিজেকে সামলে রাখতে পারলাম না।
তবে সমস্যাগুলো যেহেতু আমাদের হলেও বাবা এখনো বেঁচে আছেন। এবং এর আগে তার অফিসের ব্যাপারটি নিয়ে তাঁকে না জানিয়ে কিছু করাটা যে অন্যায় হয়েছিল সেটাও মনে পড়ল।
মিথিলা বাবু!
তোমার মনে আছে এর আগে গ্রামে বাবাকে কতটা অপমানিত হতে হয়েছিল চেয়ারম্যানদের নিকট? আমার ছেলেবেলায় হলেও আমি সেই অপমান ভুলতে পারি নাই। কিন্তু বাবা কিভাবে যেন ভুলে গেলেন। সেবার দাদীর অসুখের সময়ে বাবার সাথে আমিও বাড়িতে গিয়েছিলাম। সম্পত্তি ভাগাভাগির সময়ে চেয়ারম্যানদের লোকজনও উপস্থিত ছিল। একজন বাবার ভাগেরটুকু কিনে নিতে চাইলে বাবা আহত বাঘের মত গর্জে উঠেছিলেন!
আমি অবাক হয়েছিলাম... নিজের ভিতরের বাঘকে নতুনভাবে চিনে নিয়েছিলাম। একই রক্তই তো বইছে আমার শরীরেও।
কিন্তু পরক্ষণেই বাবা আবারো স্বাভাবিক মানুষে পরিণত হলেন। ওদের সাথে হাসি-ঠাট্টা আর গল্প-গুজবে মেতে রইলেন বাকি সময়টুকু।
গ্রামের অর্থনীতির ভিত্তি হল ফসলি জমিতে চাষাবাদ। প্রতিটি পরিবারেরই নিজস্ব জমি রয়েছে। একবারে ভূমিহীন যারা, তারা অন্যের জমিতে বর্গা চাষি হিসেবে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে। আমাদের ও অনেক জমি রয়েছে। আমার দুই চাচারা এক সাথে তাদের জমি একই দাগে পাশাপাশি নিয়েছেন সম্পত্তি ভাগবাটোয়ারা হবার সময়ে। আর বাবার জন্য ভাগে পড়ল একটু দূরের অন্য দাগের জমি। বড় দুই চাচার জমির আইল যাকে সীমানা বলা যায়, ঘেষে ছিল চেয়ারম্যানদের জমি।
গন্ডগোলটা বেঁধেছিল এই জমির সীমানা আইলকে সরানো নিয়ে। যখন জমিতে চাষাবাদ করা হয়, লাঙ্গল ও মই দেবার সময়ে আইল খুব নড়বড়ে থাকে। তখন সুবিধাবাদীরা তাদের জমির আইল বিপক্ষের ভিতরে অনেকটা ঠেলে দিয়ে কিছু বেশী যায়গা নিজেদের আয়ত্তে নিতে চায়। আর তখনই গোল বাঁধে। শুরু হয় শক্তির খেলা। সামন্ততান্ত্রিক মনোভাবের বশবর্তী অত্যাচারি চেয়ারম্যান বাড়ির মানুষগুলো বড় চাচার জমির আইল সরিয়ে প্রায় দু’হাত যায়গা নিজেদের ভিতর নিয়ে নেয়। বড় চাচা এটা লক্ষ্য করে প্রতিবাদ করেন। কথায় কথা বাড়ে, হাতাহাতির পর্যায়ে চলে যায়। চাচার কামলাদের সাথে ঐ পক্ষের লোকদের শেষ পর্যন্ত হাতাহাতি হয়েই যায়।
ব্যাপারটা সালিশ পররযন্ত গড়ায়। কিন্তু চেয়ারম্যান সাহেব ঐ সময়ে শহরে থাকাতে তিনি আসার পরে বসবার সিদ্ধান্ত হয়। দু’দিন পরেই তার ফিরবার কথা। সবাই অপেক্ষা করতে থাকে।
চাচারা শান্ত হলেও তাদের ছেলেরা শান্ত থাকতে পারল না। সেদিন সন্ধ্যায় বাজারের ক্যারম বোর্ডের দোকানে চেয়ারম্যানের দুই নাতির সাথে বড় চাচার ছেলের গোল বেঁধে যায়। প্রসঙ্গ সেই সীমানা আইল। তবে এবার সংখ্যায় ভারী থাকাতে আমার চাচাতো ভাই তার অন্য লতায়-পাতায় জড়ানো আত্মীয়দের সাথে নিয়ে চেয়ারম্যানের নাতি দুজনকে বেদম প্রহার করে। বাজারের লোকজন এসে না থামালে একটা বড় ধরণের দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারত। তবে যা হল তাও একেবারে কম কিছু ছিল না। রাগের মাথায় কাজটা ঘটিয়ে পরে চিন্তায় পড়ে গেল চাচারা। ছেলেদেরকে বকাবকি যা করার সেটা তো করা হয়েছিলই। কিন্তু এই ঘটনার প্রভাব কি হতে যাচ্ছে সেটা চিন্তা করেই চাচারা ভীত হয়ে পড়লেন। ঐ রাতেই চাচাত ভাই মনিরকে খুলনায় আমাদের বাসায় পাঠিয়ে দেয়া হল। মারামারিতে আর যাদেরকে প্রকাশ্যে দেখা গেছিলো, তারাও দূরের আত্মীয়দের বাড়িতে সাময়িক আশ্রয় নিতে চলে গেলো।
ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতির সাথে জড়িত ছিল চেয়ারম্যান নুরু খলীফা। তার বাবাও চেয়ারম্যান ছিলেন। কয়েক পুরুষ ধরে ওনারা এলাকার নেতৃত্ব দিয়ে আসছে। তাই নিজেদের শরীরে বয়ে যাওয়া ‘নীল রক্তের’ গৌরবে হোক আর প্রতিশোধের আগুনে অন্ধ হয়েই হোক, রাতে ওদের লোকজন আমাদের বাড়িতে হামলা করলো।
চেয়ারম্যানের বড় ছেলের নেতৃত্বে ২০/৩০ জনের একটি দল প্রথমে বাড়ি ঘিরে ফেলে। এরপর চাচাত ভাই মনিরকে খুঁজতে থাকে। কিন্তু ওকে না পেয়ে শেষে বড় চাচাকে গলায় গামছা বেঁধে টানতে টানতে গ্রামের রাস্তা দিয়ে নিয়ে যায়। ওদের কাছে দেশীয় অস্ত্র ছিল। ধারালো রাম দা চাঁদের আলোয় চকচক করছিল। যাবার সময়ে ওরা আমাদের কাছারি ঘরটিতে আগুন দিয়ে যায়।
কি একটা ভয়ংকর পরিবেশ তুমি কল্পনাও করতে পারবে না মিথিলা বাবু!
গ্রামের সহজ সরল মানুষের ভিতরে যে পরিমাণে সরলতা রয়েছে, ঠিক সেই পরিমাণে হিংস্রতাও রয়েছে। বাড়ির অন্য লোকজন তখন কাছারি ঘরের আগুন নেভাবে, না চাচাকে উদ্ধার করতে যাবে- ভেবে পাচ্ছিল না। এক বিভীষিকাময় রাতে আমাদের বাড়ির মহিলা ও অল্প বয়স্করা যার যতটুকু সামর্থ্য ছিল পানি দিয়ে কাছারি ঘরের আগুন নেভাতে থাকে। অন্যরা আশেপাশের আত্মীয় স্বজনদেরকে জড় করে চেয়ারম্যানদের লোকদের হাত থেকে বড় চাচাকে উদ্ধারের চেষ্টা চালায়। চারিদিকে খবর হয়ে যায়। আমাদের বংশও লতায় পাতায় জড়ানো অনেক বড় ছিল। ধীরে ধীরে সবাই এক হতে শুরু করে। যার কাছে যা অস্ত্র ছিল সাথে নিয়ে আসে। গ্রামে সাধারণত রাম দা, বল্লম, চল, ট্যাঁটা এগুলোই লড়াইয়ে ব্যবহৃত হয়।
দু’পক্ষের ভিতর একটা রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হতে হতেও হল না। যেভাবেই হোক, থানার পুলিশের একটা দল এলাকায় পৌঁছে যায়। ওদের হস্তক্ষেপে চাচাকে উদ্ধার করা হয়। কিন্তু ততক্ষণে তার অবস্থা বেশ শোচনীয়। চোখে কালসিটে পড়ে গেছে... মৃত্যুভয়ে চক্ষু বিস্ফারিত... আর লজ্জা? সেটা তো ছিলই। জীবনের এই পর্যায়ে এসে একজন মানুষ তার নিজ এলাকায় এরকম চরম অপমানের শিকার হবেন, কস্মিনকালেও ভেবেছিলেন কি?
থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার উপস্থিতিতে এলাকার অন্য গণ্যমান্যরা চেয়ারম্যান সাহেব না আসা পর্যন্ত এই ব্যাপারটা নিয়ে উভয়পক্ষকে আর বাড়াবাড়ি না করতে অনুরোধ জানায়। ভিতরে ভিতরে ফুসতে থাকলেও উভয়পক্ষ আপাতত শান্তি বজায় রাখতে রাজী হয়। এর মিমাংসা স্থানীয় ভিত্তিতে না হলে তখন থানা তাদের হস্তক্ষেপ করবে বলেও জানিয়ে যায়।
আমি ঐদিন কিছুই জানতে পারলাম না।
পরেরদিন কি কারণে বাসায় যেতে খুবই মন টানছিল। বাসায় এলাম।
এসেই মনিরকে দেখে অবাক হই। ওকে হঠাৎ এভাবে আসার কারণ জিজ্ঞেস করলে, সেও সরাসরি কোনো উত্তর দেয় না। বাবাও তখন বাসায় ছিলেন না। মা কি কাজে একটু বাইরে।
আমাকে সব কিছু বলে দেয় বাদল। ইতোমধ্যে গ্রাম থেকে চাচাকে অপমানের এবং বাড়িতে আগুন দেবার কথা বিস্তারিত জানিয়ে দাদী একজনকে পাঠিয়েছিলেন বাবার কাছে। সে বাবাকে সব জানিয়ে চলে যায়। মনিরকে শহরেই থাকতে বলে দিয়েছেন দাদী।
আমাদের বংশের উপর আঘাত এলো। আমার নিজের শেকড়- সেই শেকড়ে আঘাত লাগতেই আমার ভিতরের সুপ্ত আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল। আমি এক হিংস্র বাঘের মত নিজের ভিতরে গর্জে গর্জে উঠতে লাগলাম।
কিন্তু আমার নিজেকে বড্ড অশায় লাগল। আমি চাইলেই ভাইদেরকে দিয়ে খুব দ্রুতই একটা অ্যাকশন নিতে পারি। চেয়ারম্যানদেরকে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে পারতাম ঐ সময়ে। কিন্তু বাবার ভয়ে চুপ করে ছিলাম। বাবার কাছে আমি কিছু যে জানি সেটাও বললাম না। তবে ঐ রাতে বাসায় আসার পরে ওনাকে ভীষণ বিচলিত দেখলাম।
মাকেও কেমন অস্থির দেখলাম।
কিন্তু তাদের এই অবস্থা দেখে আমি নিজেও ওনাদের থেকে বেশী কষ্ট পেতে লাগলাম।
আমার রক্ত আমাকে কেবলি টানছিল... নাড়ির টানকে অস্বীকার করতে পারছিলাম না। যদিও দুই চাচা আমার বাবাকে অনেক অপমান করেছিলেন, সম্পত্তি থেকে ঠকানোর চেষ্টাও করেছিলেন। কিন্তু যখনই আমার কল্পনায় বড় চাচাকে গলায় গামছা বেঁধে কেউ টেনে নিয়ে যাচ্ছে কিংবা আমাদের বাড়ি আগুনে পুড়ছে- এটা দেখি, আমার সব এলোমেলো হয়ে যাচ্ছিল। অসহায় বড় চাচার জন্য হৃদয়ে একটা প্রবল মায়া অনুভব করলাম।
নিজের ভিতরে একটা জেদকে পুষে রাখলাম। হ্যা, আসছি আমি। যে বিপ্লবকে বুকে নিয়ে আজ শহরের মানুষকে সাম্যাবস্থায় আনার নিরন্তর চেষ্টা করছি, সেটার সব থেকে বেশী প্রয়োজন দেখছি গ্রামেই। আমি আমার নিজের এলাকা থেকে সবধরণের শোষণ নির্মুল করার ব্যাপারে দৃঢ়প্রত্যয়ী হলাম।
কিছুদিন গ্রামেই থাকার একটা বাসনা জাগল।
আর আমার মন যা চায় সেটাই সবসময়ে করে এসেছি। একটা নির্মল আনন্দ জেগে উঠল বুকে। লাভলিকে মনে হলে যেমন আনন্দ জাগে ঠিক তেমনই।
ছাদে উঠে গেলাম। ভরা পুর্ণিমায় চারদিক আলোয় আলোকিত। আমি নির্ণিমেষ চাঁদের দিকে তাকিয়ে রইলাম। একসময় চাঁদকে বিস্মৃত হলাম!
কিছু পরে নিজেকেও!
এরপর আকাশপানে লাভলির চাঁদমুখের দিকে একভাবে চেয়েই রইলাম!
(ক্রমশঃ)
বিষয়: সাহিত্য
৯৮৭ বার পঠিত, ৪ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
১৪ঘন্টা নেট বিচ্ছিন্ন ছিলাম! লাইনে কাজ চলায় বন্ধ ছিল নেট! কেমন জানি অসস্হি লাগছিল! ডিউটিতে এসে দেখলাম নেট চালু হয়েছে!
কি যে ভাল লাগছে এখন!
এমন ভাল লাগা ছড়িয়ে পড়ুক সবার মাঝে!!
অনেক ধন্যবাদ ভাই।
মন্তব্য করতে লগইন করুন