পেন্সিলে লিখা বাবার ডায়েরি (ধারাবাহিক উপন্যাসঃ পর্ব-২১)
লিখেছেন লিখেছেন মামুন ১৯ জানুয়ারি, ২০১৫, ০৮:৪০:১৩ সকাল
মানুষ কিছু হারালে আর কিছু অবলম্বন পায়। যা হারায়, আর যা পায় তার মধ্যে মিল হয়তো সব সময় বোঝা যায় না। তবু একদিন দেখা যায়, চলার পথটা একটাই ছিল।
লাভলি ঢাকা ভার্সিটিতে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে অনার্সে ভর্তি হল। আমার সাথে তার বিশ্বস্ত লোক মারফত চিঠির লেনদেন রইল। বাই পোস্ট যোগাযোগ কোন দিক থেকেই নিরাপদ ছিল না।
বাদলের খবর শুনে সে ডলি চাচীর এক আত্মীয়র হাতে আমার কাছে চিঠি পাঠালো।
চাচীর আত্মীয় ছেলেটা কলেজের গেটে অপেক্ষা করছিল। নামটা মনে নেই। সে তার পরিচয় দিতেই আমার প্রচন্ড রাগ উঠে গেল। আমার সহ্যই হচ্ছিল না। জীবনটা থেকেই মুক্তি চাচ্ছিল মন। কিন্তু কী করে জানি না, সে অল্পক্ষণেই আমাকে শান্ত করে ফেলল। একটা চুপচাপ জায়গায় নিয়ে গিয়ে বসে সে সব খুঁটিয়ে জেনে নিল। লাভলির প্রতি ভালোবাসার উল্টো পিঠে তীব্র ঘৃণা জন্মেছিল। কিছুটা তাকে ঘিরে আমার সাথে দুই পরিবারের, দুই পরিবারের একে অন্যের বিরোধের জন্য আমার তাকেই দায়ী মনে হচ্ছিল বলে। আর, বাকিটা বোধ হয় তীব্র নি:সংগতার জন্য। এই ছেলেটা, তার সাথে সেদিনের আগে পরে আর কখনো আমার দেখা হয়নি, সে যেন একটা আমার অপরাধবোধ আর লাভলির বিরুদ্ধে কঠিন অভিযোগটা ডিসমিস করে দিতে এসেছিল। অনেক হাল্কা হলাম। মনে হল উপরে একজন আছেন, তার কাছে কৃতজ্ঞ হলাম। আমার কাছ থেকে ছেলেটা তিন চার লাইনের একটা চিরকুট লিখিয়ে নিল। লাভলির জন্য। লিখে কেন যেন খুব ভালো লাগল।
ছেলেটা চলে যাওয়ার পর আমি হাতের চিঠিটার দিকে তাকালাম। স্পর্শ নিলাম। বুক ভরে ঘ্রাণ নিলাম। চিঠিটার গায়ে মৃদু সুবাস । ভালোবাসার। বেশ লম্বা চিঠি। অনেক কথা। এর মধ্যে আমাদের ব্যাপারে হেল্প করার কারণে ডলি চাচীকে লাভলির চাচার হাতে মার খেতে হয়েছে। তিনি বড় লোকের আদরের মেয়ে। ঘটনার পর পরই থানা পুলিশ করে ফেলেছেন। চাচী বেশ কিছুদিন বাপের বাড়ি ছিলেন। ডিভোর্স হবে শোনা গেলেও তিনি ফিরে এসেছেন। হয়তো নিজের সদ্যজাত ছেলেটার কথা ভেবে। অত সব অঘটন, ঘটনার বিবরণের পাশে তার আমাকে ছেড়ে থাকার মর্ম ছেঁড়া অনুভুতি, জগতে তার একান্ত কষ্ট গুলি, অনিশ্চয়তার ঘূর্ণিতে পড়ে যাওয়া স্বপ্নগুলি, নি:সংগতার বিষাদ।
আমার মন খারাপ আর সুখ মিলেমিশে একাকার হয়ে রইল। আমার জীবনটা তো আগের মত নেই! তবু পুরোনো দিনের এইটুকু আমার রয়ে গেল। বহুদূর থেকে আমার সবকিছুকে সারাক্ষণ জড়িয়ে থাকা একজন মানুষকে নিয়ে ক্ষণে ক্ষণে মনে নানান ভাবনা বইতে লাগল। প্রচন্ড আক্রোশ নিখাদ বিষাদে পরিণত হল। তার সাথে জড়িয়ে রইল ভালোলাগা আর আকাশ কুসুম কিছু কল্পনা।
লাভলির জন্য একটা প্রচন্ড ভালোবাসা আদিগন্ত বিস্তৃত হয়ে আমার হৃদয়কে আচ্ছন্ন করে রাখলো।
মিথিলা বাবু!
খালু মোটামুটি বেশ কিছুদিন ভুগে সেরে উঠলেন সম্পূর্ণ ভিন্ন মানুষ হয়ে। ক্ষতি যা হবার সেটা আমাদের পরিবারের হল। বাদলের জীবনটা তছনছ হয়ে গেল। আমার দিনগুলো কেটে যাচ্ছিল বিরহী চাতকের মত। হৃদয়ে লাভলীর জন্য সীমাহীন ভালোবাসা, বাদলের জন্য টেনশন আর বাবা-মায়ের কাছে কোনো কারণ না থাকলেও ছোট হয়ে থাকার এক অনুভূতিতে বিলীন হওয়া। আমি বি.এল কলেজের হলেই থাকা শুরু করলাম। কারণ অবস্থা তখন এমন দাঁড়িয়ে গেল যে, পথে ঘাটে আমার নিরাপত্তা রইল না। শত্রুর পরবর্তী টার্গেট আমিই হতে পারি, এমন কিছু তথ্য খালু পেয়েছিলেন। বাদলের ঘটনার জন্য তিনি খুবই কষ্ট পেলেন। আমাকে নিয়ে বেশ চিন্তিত হলেন। একদিন আমার সাথে দেখা করলেন আমার সুরক্ষিত গোপন যায়গাটায়। দীর্ঘক্ষণ আমাদের মধ্যে কথা হল। আমি সরাসরি আমার মনের ইচ্ছেটাকে তার কাছে ব্যক্ত করলাম। আমি যে শিমুল ভাইয়ের সাথে গোপন দলটিতে ঢুকে গেছি সেটাও জানাতে ভুল করলাম না। অনেকক্ষণ খালু চুপ করে থাকলেন। কিছু ভাবলেন। শেষে স্মিত হেসে আমাকে বললেন,' ওকে, যা হবার সেটা হয়ে গেছে। এখন এভাবেই থাকো।' আর আমাকে বি.এল কলেজের ছাত্রদলে যোগ দিতে বললেন। কারণ তখনকার সরকারি দলের এই ছাত্রসংঠনটিতে আমার সম্পৃক্ততা থাকলে গোপন দলের জন্য আমার জীবনে যে কালো আঁচ লেগে যাচ্ছে, সেটাকে হয়তো তিনি মুছে দিতে পারবেন। আর আমার নিরাপত্তাও আরো দ্বিগুণ হবে এর দ্বারা।
তখন বিএল কলেজে ইসলামী ছাত্র শিবির এবং ছাত্র দলের আধিপত্য বেশী ছিল। তবে ছাত্রদল সরকারি দলের ছাত্র সংগঠন হওয়াতে ওরা এক কাঠী উপরে ছিল। সেদিনই খালু ছাত্রদলের একজন ক্যাডার এবং নেতা খোকন ভাইকে আমার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। সে টাইগার খোকন নামে পরিচিত ছিল। দৌলতপুরের মহেশ্বরপাশা এলাকায় তার বাড়ি। কামরুল গাজী নামের একজন প্রভাবশালীর সাথে খোকন ভাইদের দীর্ঘদিনের দ্বন্দ্ব চলে আসছিল। পারিবারিক শত্রুতা তখন আমাদের খুলনা শহরের রাজনীতিকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করে আসছিল। যাই হোক, খালু খোকন ভাইয়ের হাতে আমাকে তুলে দিলেন। আমি প্রকাশ্য রাজনীতি করা শুরু করলাম জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের। আর গোপনে তো শিমুল ভাইয়ের সাথেই ছিলাম। মোট কথা ঐ সময়টাতে আমি বেশ শক্তিশালী কিছু মানুষের ছত্রছায়ায় চলে এলাম। আমার নিজের ভিতরে ভালবাসার শক্তি এবং নষ্ট রাজনীতির অপশক্তি আমাকে এক অন্য মানুষে পরিবর্তন করতে চাইলো। আমি সময়টাকে উপভোগ করতে শুরু করলাম। প্রশাসন, অস্ত্র এবং টাকা- তখন আমার জন্য কোন ব্যাপারই ছিল না। বয়স তখন বেশী ছিল না। সিগ্রেট ছাড়া আর কোনো ধরণের নেশা করতাম না। আমাদের গোপন দলের দু'একটা যে নীতি আমার ভালো লেগেছিল তার ভিতরে- নেশা দ্রব্যে এবং নারীদের উপর অত্যাচার- এ দুটোকে বেশ কঠিন ভাবে নিয়ন্ত্রন করা হতো, এটা ভালো লেগেছিল। আমি সীমাহীন রাজনৈতিক প্রভাববলয়ের মাঝে থেকে নিজের ইচ্ছেগুলোকে রূপ দানের সক্ষমতা অর্জন করলাম।
সৈয়দ পরিবারও ওদের বিপরীত দলের সাথে আমার সম্পৃক্ততার জন্য আমাদের পরিবারের দিকে চোখ তুলে তাকাবার সাহস করল না। কারণ, তখন একটা চেক এন্ড ব্যালান্স অবস্থা তৈরী হয়ে গিয়েছিল। আর ওরাও ওদের বউ ছেলেমেয়েকে নিয়ে এলাকায় ই বাস করত। তাই আমাকে একটু সমীহ করে চলাও শুরু করল। কিন্তু ভিতরে ভিতরে আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের জাল বুনে যেতে কোনো তো বাঁধা ছিল না। তাই আমাকে হিসাব করে প্রতিটি পা ফেলতে হতো। ঐ সময়ে মোবাইল ছিল না। যোগাযোগ ছিল চিঠি, চিরকুট, টেলিফোন এবং পেজারের মাধ্যমে। দিনের বেলা ছাত্রদলের মিটিং-মিছিল, ক্লাশের পড়াশুনা এবং আবার রাতে শিমুল ভাইয়ের সাথে দলের আভ্যন্তরীন মিটিংগুলোতে অংশ নেয়া আমার জীবনের একটা অংশ হয়ে উঠল। আমি সবগুলোকে খুব সুন্দরভাবে চালিয়ে গেলাম। অনার্স প্রথম বর্ষে টপ রেজাল্ট করেই দ্বিতীয় বর্ষে উঠলাম। সকলে অবাক হল। কিন্তু কেউ কোন মন্তব্য করল না। আমি তখন অন্য এক আমিতে পরিণত হয়েছিলাম।
এই সময়ে মৃণালের সম্পর্কে আমার আগ্রহ বেশ বাড়ল। তার বিষয়ে বিশদ জানার চেষ্টা করলাম। অনেক পড়ালিখা করলাম এই দেশের কম্যুনিস্ট আন্দোলনের উপরে। গোপন দলগুলোর বাপারে অনেক কিছু জানলাম। আর শিমুল ভাইয়ের দলে আমার কাজ ছিল নতুন কর্মী বাহিনী তৈরী করা এবং দলের উদেশ্য এবং সাধারণ মানুষের ভিতরে এর একটা গ্রহনযোগ্য স্থান বানানোর কাজে শিমুল ভাইকে সহায়তা করা।
যে কোন আন্ডারগ্রাউন্ড দলের দুটি অংশ থাকে। এই চরমপন্থি দলের ও সেটা ছিল। এক. রাজনৈতিক শাখা দুই. সামরিক শাখা। রাজনৈতিক শাখা দলের উদ্দেশ্য এবং লক্ষ্যকে সামনে রেখে দলের বিস্তার ঘটিয়ে থাকে। আর সামরিক শাখা দলের প্রয়োজনে প্রতিপক্ষকে দমন-পীড়ন এমনকি 'খতমের ' নামে সরাসরি খুন করায় নিয়োজিত থাকে। এটা আমাদের ঐ সময়ে একটা ট্রেন্ড হয়ে দাড়িয়েছিল। এক দলের ক্যাডারকে অন্য দল পেলেই মেরে ফেলত। মোটকথা এক ধরণের রোমাঞ্চকর মৃত্যুর খেলা খেলা ভাব অনুভূত হতো।
তবে এর একটি ভীতিকর সাইড ও ছিল। আমার জীবনের নিরাপত্তা আগের চেয়ে অনিশ্চিত হয়ে গেল। আমি হয়ে গেলাম একাধারে বেশ ক'টি দলের পথেরকাঁটা, পিস্তলের টার্গেট। আমি আমার পরিবারের সদস্যদের সাথে থাকতে পারতাম না। লাভলির কাছে যেতে পারতাম না।
অসহ্য লাগত মাঝে মাঝে। এ কি জীবন!
খালু, শিমুল ভাই দু'জনেই পরামর্শ দিলেন একটা দিন বাসায় সবার সাথে কাটিয়ে আসতে। একদিন রাতে গেলাম। ঢোকার পথেই বাবার মুখোমুখি পড়লাম। বাবাকে কেমন অপরাধী আর পলায়নপর মনে হলো। তিনি অস্বস্তি নিয়ে সরে যাচ্ছিলেন। আমি হঠাৎ কেন যেন পিছন থেকে ডাকলাম, 'আব্বা!'
ঠিক কী ছিল আমার স্বরে, আমার ও অচেনা লাগল। বাবা বেশ চমকালেন। ফিরলেন। বারান্দার অন্ধকারে বসলাম দু'জন। কিছু পরে কী করে যেন দু'জন অনেক কাছে চলে এলাম। অনেক বছর পর বাপ ছেলে প্রাণ খুলে কথা বললাম। অনেক কথা। বাবার চাকরি। আমার ভবিষ্যত চিন্তা। লাভলি। এলাকায় থাকা উচিত কি উচিত না। অনেক কিছুই। বাবা আমার নতুন জীবন নিয়ে দুশ্চিন্তা করলেন। তবু পরিস্থিতির দাবীটা উড়িয়ে দিতে পারলেন না। প্রয়োজনটা অস্বীকার করতে পারলেন না। আমি বুঝলাম, বাবার স্বপ্ন আর আমার জীবনের মধ্যে দুস্তর ফারাক হয়ে গেছে। সেই স্বপ্ন ভাংগার তীব্র বেদনায় আমরা আমাদের দুর্ভোগ আর আক্রোশ একত্রিত করলাম। এ ছিল সামনের দিনে এক কঠিন লড়াইয়ের প্রস্তুতি। আমি অনুভব করলাম, আমার প্রতি বাবার আস্থা ফিরেছে!
সেই রাতটা সারা রাত ভেবেছি বাবা, মা, বাদল, লাভলিকে নিয়ে। পাশের ঘর থেকে মধ্য রাতে মায়ের কান্না আর বাদলের কাতরানির শব্দ আসছিল, বাবার নৈ:শব্দ আসছিল। দূর থেকে দিন বদলের জোর গলার ডাক আসছিল। সমাজ, সংসারের সব দুর্গতি আর দুরবস্থার বিরুদ্ধে লড়ার জন্য নিজেকে সাজালাম বীর যোদ্ধার সাজে। নগন্য নিজের মাপটা বাড়িয়ে নিলাম যুদ্ধের মাপে।
(ক্রমশঃ)
বিষয়: সাহিত্য
৮১৯ বার পঠিত, ৪ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
সাবলীল বর্ণনায় নান্দনিক উপস্হাপনা অনেক বিষয় সামনে নিয়ে এলো! মিলিয়ে নিতে অনুপ্রেরণাও জাগাল! ভালবাসার উল্টো পিঠে তীব্র ঘৃণার সহাবস্থান সময়ে পারদের মত উঠা-নামা করে তা বুঝে আসলো ভাল করেই!
অনেক অনেক ভাল লাগা বরাবরের মতই!!
জাজাকাল্লাহু খাইর।
অথবা যারা কখনো বাবাকে দেখেনি তারা কিভাবে লিখার আবেগ বুঝবে?
মন্তব্য করতে লগইন করুন