পেন্সিলে লেখা বাবার ডায়েরি (ধারাবাহিক উপন্যাসঃ পর্ব-২)
লিখেছেন লিখেছেন মামুন ১৪ নভেম্বর, ২০১৪, ০৮:৪৫:৪৪ রাত
দুই.
মিথিলা বাবু!
অনেক বাবারা তাদের সন্তানদের কাছে কোনো লিখা উইল আকারে রেখে গেলে তাদের লিখনির শুরুতে নানান নাটকীয় কথা লিখে থাকে। যেমন, ‘ এই লিখাটি যখন তুমি পড়বে, হয়ত তখন আমি তোমার থেকে অ...নে...ক দূরে’- এই টাইপের।
আমি তোমার জন্য সেরকম কিছু লিখলাম না। তোমার দাদুর মাধ্যমে এতোদিন পরে তোমার কাছে এই ডায়েরীটা এই জন্য পাঠানোর ব্যবস্থা করলাম, আজ তোমার বুঝবার ক্ষমতা যতটুকু হয়েছে, আরো আগে ততটুকু ছিল না। এই ডায়েরির গুরুত্ব আজ তোমার কাছে যতটুকু, আরো আগে তেমনটা থাকত না। বয়সের একটা স্থিতিশীল পর্যায়ে তুমি পৌঁছার পরে যেন এটা তোমার হাতে আসে, আমি সেই ব্যবস্থাই করেছিলাম।
ব্যাপারটার ভিতরে একটু হয়ত নাটকীয়তার পরশ রয়েই গেল! তবে তা তো হতেই পারে, কারণ আমাদের জীবনটাই তো একটা নাট্যমঞ্চ। সেখানে আমরা সবাই এক একজন অভিনেতা।
আমার বাবু!
তোমার মনে প্রশ্ন আসতে পারে, আমি কখন মারা যাব, সেটা তো আমার জানার কথা নয়। হ্যা, এটা একটা সার্বজনীন ব্যাপার। কেউ আগে থেকে জানতে পারে না। মানুষের জীবন বড্ড অনিশ্চিত। তাই আমি আমার হৃদয়ের অনুভূতিগুলো আগেই অক্ষরে রুপ দিয়ে রেখেছিলাম।
কোথা থেকে শুরু করবো?
অনেক ভাবলাম।
শেষে কোনো চিন্তা ভাবনা না করেই লিখা শুরু করলাম। লিখতে লিখতে কলম (আসলে হবে পেন্সিল) যেদিকে নিয়ে যায়! তারপরও চেষ্টা করছি একটি নির্দিষ্ট প্যাটার্ণ অনুসরণ করতে। লিখাগুলো তুমি একটানা না পড়ে ধীরে ধীরে পড়তে পার। আমার এই লিখায় আমার সমসাময়িক প্রেক্ষাপট উঠে আসবে... কিছু রাজনৈতিক এবং সামাজিক প্রাসঙ্গিকতার নিরিখে টুকরো আলোচনা চলে আসতে পারে। তোমার এই বাবার অনেক না পাওয়ার বেদনা... কষ্টে নীল হতে হতে নীলাভ বর্ণ ধারণ করা আমার সেই সময়ের অনুভূতি জানতে পারবে। এসব কিছু মিলিয়ে তোমার চিরচেনা সেই বাবার সাথে সাথে নতুন এক অচেনা বাবাকেও তুমি পাবে আশাকরি।
আর একটা কথা, আমার এই লিখা সম্পুর্ণ আমার নিজস্ব অভিমত। তোমাকে যে এই মতবাদ দ্বারা প্রভাবিত হতে হবে, ঘুণাক্ষরেও সেটা তোমার হৃদয়ে স্থান দিবে না।
নিজে নিজের মত করে মানুষ হতে চেষ্টা কর।
প্রথম স্মৃতি
যেহেতু এটি একটি ডায়েরি, তাই সেভাবেই দিনপঞ্জি আকারে লিখা উচিত ছিল। কিন্তু সেদিকে গেলাম না।
আমার জীবনের শিশুবেলার একেবারে প্রথম স্মৃতিটি কি ছিল? প্রতিটি মানূষ চোখ বুজে বা চোখ খোলা রেখে নিজ নিজ শৈশবের কথা চিন্তা করলে, একেবারে প্রথম কোন ঘটনাটি মনে পড়ে? তুমি নিজের প্রথম স্মৃতিটি এই মুহুর্তে চিন্তা করে দেখতে পারো।
কি? কোন স্মৃতিটি মনে পড়ল?
মিথিলা বাবু!
আমি তোমার পাশে না থেকেও এই লিখার দ্বারা সাথে রয়েছি। মন খারাপ কর না। এই পৃথিবীতে যতদিন থাকবে, আনন্দে থাকবার চেষ্টা করবে। জীবনটা একটা গতি। আনন্দ সেই গতিময়তা ধরে রাখার জ্বালানি।
যা বলছিলাম, প্রথম স্মৃতির ব্যাপারটিতে ছিলাম, তাই না বাবা?
শুনেছি এল এস ডি নামের এক ধরণের ড্রাগ নিলে নাকি মায়ের গর্ভের কথাও মনে পড়ে যায়। এ দেশে এই ড্রাগ পাওয়া গেলে আমি একটু নিয়ে আমার ব্রেইনের লুক্কায়িত ঝিল্লিগুলোতে পর্দার আড়ালে থেকে যাওয়া আমার মধুর শৈশবের সেই সব মাদকতাময় হারানো সময়কে দেখতে চাইতাম। তবে নিজের হারানো সময়কে পাবার জন্য এই জীবন ধবংসকারী মাদক গ্রহন করাটাও ঠিক নয়।
আমি চিন্তা করে দেখলাম, আমার একেবারে মনে পড়ে এমন প্রথম স্মৃতি কোনটি।
স্মৃতি মিনারে একেবারে চূড়ায় যেটি দৃশ্যমান, তা হল- আমি আমার নানাবাড়িতে নানার পাশে শুয়ে আছি। তখনো ফজরের আজান হয় নাই। পাশের রুমে তোমার দাদু মানে আমার আম্মা প্রসব বেদনায় ছটফট করছেন। তখন কি আম্মার এই যন্ত্রণার স্বরূপ অনুধাবন করতে পেরেছিলাম? অন্ধকার ঐ রুমটিতে আমার নানী, দাই মা ভানু এবং আরো কারা যেন ছিলেন। যন্ত্রনাকাতর আম্মার অনুভূতি শিশু এই আমার কাছে কেমন অপার্থিব লেগেছিল। কিছুক্ষণ পরে ফজরের আজান হয়ে গেল। সেই সাথে এক নবজাতকের চীৎকার নতুন এক মানবের এই পৃথিবীতে আগমনী বার্তা জানিয়ে দিলো। সেই শিশুটি হল তোমার মেজ চাচা।
আর একটি স্মৃতি মনে পড়ে।
আমি আমার নানা ভাইয়ের কোলে। খালের পাড়ে আমরা সবাই লঞ্চের অপেক্ষায় রয়েছি। আব্বা শহরে যাবেন। লঞ্চ এলো। আব্বা লঞ্চে উঠে গেছেন। আমি নানা ভাইয়ের কোলে বসে খুব কাঁদছি। কিন্তু আমাকে না নিয়েই শেষ পর্যন্ত লঞ্চটি চলে গেল। সাথে আব্বাও।
এতো গেল নানাবাড়ির স্মৃতি। এরকম আরো অনেক রয়েছে। সেগুলো যদি সব লিখতে যাই, তবে তো সাড়ে সাত শো পাতার এক বিশাল উপন্যাসই হয়ে যাবে। তাই সেদিকে গেলাম না। তবে এই স্মৃতি এবং শৈশব- এগুলো খুব যত্ন করে আমাদের মনের মণিকোঠায় অবস্থান করে। জীবনে চলার পথে আমাদেরকে বিভিন্ন বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয়। তখন অবস্থার প্রেক্ষিতে আমরা প্রায়ই দিশেহারা হয়ে পড়ি। তখন এই সাময়িক বিবশ অবস্থা থেকে নিজেদেরকে রিফ্রেস করতে প্রয়োজন হয় কিছু নির্ভেজাল আনন্দময় স্মৃতি। আর শৈশবের থেকে মনকে সতেজ করার মত এত আনন্দঘন মুহুর্ত মনে হয় না জীবনের অন্য কোনো পর্যায়ে রয়েছে।
এই স্মৃতির কথাটা এজন্যই উল্লেখ করছি, তোমার জীবনেও চলার পথে অনেক ঘাত প্রতিঘাত আসবে... মন খারাপ হবে... তখন আমি হয়ত থাকব না। তাই এই সব বিব্রতকর মুহুর্তগুলোতে নিজেকে তোমার সেই শৈশবের স্মৃতিময় মুহুর্তে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে। চিন্তার গভীর টানেল ধরে স্মৃতিদের শান্ত নির্জন এক জলাশয়ের পাশে নিজেকে কল্পনা করবে। সেখানে বাতাস শান্ত জলের উপরে মৃদু ঢেউয়ের সৃষ্টি করছে... সবুজ বনানীর পাশের এই জলাশয় তোমার ভালোলাগা স্মৃতিদের আধার। জীবনের ঐ সব রুক্ষ্ণ মুহুর্তগুলোতে তুমি সেই জলাশয়ে অবগাহন করে ভালোলাগাময় সময়কে তুলে আনবে। এতেই হৃদয়ের প্রশান্তি আসবে।
মিথিলা বাবু!
এই বাবা তোমার জন্য সবসময়েই পাশে আছে মনে করবে। জীবন চলার বন্ধুর পথে হোচট খেলেও বার বার উঠে দাঁড়াবে। থামবে না। চলাই জীবন... আর জীবনের জন্যই চলতে হয়।
(ক্রমশঃ)
বিষয়: সাহিত্য
১১৫০ বার পঠিত, ২১ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
ভাইয়া এমনি মনটা কয়দিন হলো খারাপ তারউপর আবার এরাম কৈরে আবেগী লেখা লিখলে আমার অন্তরটাতো হার্টফেইল করবে।
আমি মনে হয় আর বেশীদিন বাঁচবো না। লেখা সুন্দর হইছে। সুন্দর অনুভূতি রেখে গেলাম।
আপনিও নিজের সোনালী শৈশবে কিছুক্ষণ হারিয়ে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আসছেন না কেন?
আল্লাহপাক আপনাকে দীর্ঘায়ু দান করুন-আমীন।
ভালোলাগার অনুভূতি রেখে যাবার জন্যও আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
জাজাকাল্লাহু খাইর।
খুবই সুন্দর কথা আমি মেনে চলার চেষ্টা করি যদিও বা কখনো থমকে দাড়াই পরক্ষনেই মনে সাহস নিয়ে উঠে দাড়াই না আমার তো থেমে থাকা যাবে না ।
অনেক ভাল লাগল ধন্যবাদ ভাইয়া ।
জাজাকাল্লাহু খাইর।
জীবন চলার বন্ধুর পথে হোচট খেলেও বার বার উঠে দাঁড়াবে। থামবে না। চলাই জীবন... আর জীবনের জন্যই চলতে হয় ।
অনবদ্য হৃদয় ছোঁয়া লিখা। সাথে থাকার অদম্য ইচ্ছা রেখে যাচ্ছি।
সাথে থেকে উৎসাহ দিয়ে সুন্দর অনুভূতি রেখে গেলেন, অনেক অনেক ধন্যবাদ এবং শুভেচ্ছা রইলো।
জাজাকাল্লাহু খাইর।
উপরের সবাই বিদগ্ধজন!তাদের মন্তব্যের পরে আমার আর কিছু লেখা বেয়াদবীর মতই হয়ে যাবে!
সার্বজনীন মৃত্যুর কথা বেমালুম ভূলে গিয়ে ক্ষণস্হায়ী জীবন নিয়ে পড়ে থাকার মতই আমার মন্তব্য! আনন্দময়তার জ্বালানী ফুরিয়ে গেলে জীবন চলার গতি যেমন স্টপ হয়ে যেতে বাধ্য! তেমনি...............!!
আপনারদের সর্বাংগিন কুশলতার কামনা খোদার কাছে!!!
সুন্দর অনুভূতি রেখে যাবার জন্য সবসময়ের মত এবারো আপনাকে জানাই অনেক অনেক ধন্যবাদ।
জাজাকাল্লাহু খাইর।
পড়ার আশা ব্যক্ত করে যাচ্ছি। তবে লেখক ভাইয়ের কাছে আবদার যেন লেখার পরে ছোট্ট একটা আমন্ত্রন দেন। তাহলে খুশি হতাম। প্রকৃত সত্যটি এই যে, আমি কোনভাবেই একটা পর্বও মিস করতে চাচ্ছিনা।
এজন্য আপনাকে প্রিয় লিষ্টে নিয়ে নিলাম। এখন থেকে আমার সকল লিখার আমন্ত্রণ আপনার কাছে চলে যাবে।
অনুভূতি রেখে যাবার জন্য অনেক ধন্যবাদ।
জাজাকাল্লাহু খাইর।
অনুভূতি রেখে যাবার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
জাজাকাল্লাহু খাইর।
অনুভূতি রেখে গেলেন, অনেক ধন্যবাদ।
ধন্যবাদ আপনাকে।
মন্তব্য করতে লগইন করুন