Rose Good Luck Rose একজন কুলাঙ্গারের ডায়েরি (ছোট গল্প) Rose Good Luck Rose

লিখেছেন লিখেছেন মামুন ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৪, ০৭:৫৩:৩৮ সন্ধ্যা



Roseপ্রতিদিনের মত অফিসে সময় পার করছি।

পিওন এসে খবর দিলো, একটা পার্শেল এসেছে আমার নামে।

'কোথা থেকে?'

'স্যার, যে পাঠাইছে তার নাম লেখা নাই।'

'ঠিক আছে, নিয়ে এসো'।

কুরিয়ারের ফর্মালিটিজ শেষ করে খুলে দেখি একটা ডায়েরী।

বেশ পুরনো।

কেমন যেনো অতীতের গন্ধ মাখানো। আমার নানা বাড়ীর দেয়ালের সাথে লাগোয়া বুকসেলফ খুললে এই গন্ধ পেতাম। কাছারী ঘরের উপরে মাচার ভিতর রঙ্গীন মার্বেল খোঁজার সময় এলোমেলো বোচকা গুলো থেকেও এই ঘ্রান পেয়েছি কত! একটা ডায়েরী এসেছে আমার নামে। কোনো প্রেরকের নাম নাই। চামড়া দিয়ে বাঁধাই করা। পরের ডায়েরী খোলা মানে একান্ত নিজস্ব সময়ে অপরের বেডরুমে ঢুকে উকি মারার মত ব্যাপার। তবে যেহেতু আমার নামে পাঠিয়েছে, আমি খুললে কো্নো দোষ হবে না।

ডায়েরিতে কা্রো নাম বা মালিকের কোনো ইনফরমেশন নাই। প্রথম পাতায় শুধু বড় করে লেখা আছে,

"একজন কুলাঙ্গারের দিনপঞ্জী"। আরো কিছু কথা আছে-

'আমি একজন কুলাঙ্গার।

তবে আমাকে একজন 'কুলাঙ্গার' হতে গিয়ে কত ত্যাগ ও কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে তা কেউ কল্পনাও করতে পারবে না। এ জন্য যা কেউ কল্পনাও করতে সক্ষম না, সেটা নিয়ে প্যাচাল না পারাই ভালো মনে করছি। তবে এই দিনপঞ্জীতে আমি আমার কুলাঙ্গার জীবনের কথা উল্লেখ করেছি। আমার অভিজ্ঞতা আমি এখানে শেয়ার করলাম আমাদের নেক্সট জেনারেশন এর জন্য যাতে তারা আমার লব্ধ জ্ঞানকে কাজে লাগাতে পারে।'

এর পরে তার স্বাক্ষরের যায়গায় '......' লেখা ।

তারিখ দেয়া ১৭-০৮-২০০৬ ইং।

আমি অতীতের গন্ধ পাবার আশায় পাতা উল্টালাম।

ডিজিটাল ক্যামেরার জুমের মতো দূর অতীত এক নিমিষে আমার কাছে চলে এলো।

আমি হারিয়ে গেলাম বাদামী-কালো অক্ষরের ভিতর।

………………………………………………………………………………………

"কুলাঙ্গারের দিনপঞ্জীঃ

২৫-০৮-২০০৬ ইং"

আমার জন্ম হয়েছে যুদ্ধের ভিতরে রাস্তার উপরে।

কি? কারো কি শুনতে খারাপ লাগছে?

খারাপ তো লাগার কথা না। আজ সেই যুদ্ধটাকে অনেকে বলে' গন্ডোগোল' যেটা সেই সময়ের সুর্য-সন্তানদের সামনে বলার মতো ধৃষ্ঠতা তাদের হতো কিনা জানি না। তবে যে যুদ্ধের কারনে আমার মায়ের মতো হাজারো মাকে প্রসব বেদনায় ছটফট করা অবস্থায় প্রাণভয়ে পালিয়ে বেড়াতে হয়েছে- আমার মতো রাস্তা যার আতুড়ঘর; তার সামনে যখন বলা হয় '৭১ এ কিছু হয় নাই- কিছু বিচ্ছিন্নতাবাদিদের জন্য সেই সময়ে পাকিস্থান ভেংগে গেছে। আর এই মত প্রতিষ্ঠিত করার জন্য আমার দেশের শিক্ষিতো সমাজের একাংশ তাদের লেখনির মাধ্যমে নিরন্তর সচেষ্ট রয়েছেন। তখন কেমন লাগে?

কারো কি শুনতে খারাপ লাগছে যে আমি রাস্তায় জন্মগ্রহন করেছিলাম ১৯৭১ এ? এর জন্য তো আমি দায়ী ছিলাম না। তবে আমার মায়ের কাছে শুনেছি যারা সেই সময়ে দেশের বিরুদ্ধে ছিলো, তাদের ই একজন আজ নাকি ফ্ল্যাগ লাগিয়ে বীরদর্পে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে রাজনৈতিক অঙ্গন।

কোনো মা কি মিথ্যা বলতে পারে?

আমার তো তা মনে হয় না। আজ মায়ের থেকে আমি অনেক দূরে। না ভুল বললাম। মা আমার থেকে অনেক দূরে। এটাও ভুল হল।

মা কি কখনো সন্তানের থেকে দূরে থাকতে পারে? যদিও এই পৃথিবীতে সে নাই, আমার সমগ্র সত্তায় তিনি মিশে আছেন। আমি আর তিনি - এক হয়ে আছি।

আজ মাকে খুব মনে পড়ছে। তবে আমাকে কান্না করা যাবে না। আবেগ তাড়িতো হওয়া যাবে না।

আমাকে সব সময় মনে রাখতে হবে আমি একজন কুলাঙ্গার। নিরবিচ্ছিন্ন এক অভ্যন্তরীন বিপ্লব ঘটে চলছে আমার ভিতরে যা থেকে আমি বা অন্য কোনো কুলাঙ্গার বের হতে পারবো না।

মা এর কথা বলছিলাম।

আমার মা অন্য সব মায়েদের মতো আমাকে মমতা দিয়ে বড় করে তুলেছিলেন। শেষ পর্যন্তু এতো বড় করে তুলেছিলেন যে নতুন এক জীবনের গন্ধে তাড়িত হয়ে সেই মমতাময়ীকে ছেড়ে এসেছিলাম।

তখনো কুলাঙ্গারে পরিণত হই নাই।

আমার মা আমার জীবনসংগিনী খোঁজার জন্য পিড়াপিড়ি করতেন। আমি তখন মাকে নিয়ে ই ব্যাস্ত ছিলাম। শেষে তার পছন্দের মেয়েকে বিয়ে করলাম। মা এর মমতা তিন ভাগের এক ভাগ আমি আমার থেকে কমিয়ে ফেললাম ।

দিন গেলো- মাস গেলো।

একই পরিবারে দুই মা (এখানে মা তো আছে ই, বিয়ের পরে বউও মা হয়ে গেলো যেনো)। তাদের ভিতরে ছোটখাটো খুনসুটি প্রথমে কলহ...তার পর বিরহ

এরপর?

এর আর পর নাই।

আমার কাছে মা ই পর হয়ে গেলেন। মায়ের মমতা আমি আরো এক ভাগ কমিয়ে ফেললাম।এর ভিতরে আমার আরো এক মা এসে গেলো।

আমার মেয়ে।

মায়ের মমতা আমি আরো এক ভাগ কমিয়ে ফেললাম। তোমরা তো নিশ্চয়ই ভালো অংক কষতে জানো।

মনে মনে বের করে ফেলোতো আমার মায়ের প্রতি মমতার আর কতটুকু অবশিষ্ট রইলো?

হ্যা, ঠিক ই ধরেছো।

মায়ের প্রতি আমার আর কোনো ই মমতা রইলো না।

আমি এক কুলাঙ্গার সংসারে বউ -মেয়েকে নিয়ে সুখের খোঁজে দিনাতিপাত করতে লাগলাম।

ওদিকে মা আমার মা ই রেয়ে গেলেন। তার মমতার কোনো কমতি ছিলো না।

আমি যখন তার থেকে আলাদা বাসায় চলে গেলাম, বিভিন্ন উছিলায় আমার কাছে আসার চেষ্টায় তার কোনো কমতি ছিলো না। ভালো-মন্দ কিছু রান্না হলেই আমার ছোটো ভাইকে দিয়ে পাঠিয়ে দিতেন। তখন তো আর আজকের মতো মোবাইলের যুগ না। অনেকের কাছে 'পেজার' ছিলো। আজ এখন যদি অতি আধুনিক কাউকে জিজ্ঞেস করা যায়, 'পেজার কি চিনো?' আকাশ থেকে না পড়লেও বিছানার উপর থেকে নির্ঘাত পড়বে ই।

তো যা বলছিলাম, আমার মা আমাকে কাছে টানার জন্য সব কিছু করলেও আমি বুঝতাম উলটা। আমি সেই মহিলাকে তখন 'বেহায়া' মনে করতাম।

কিন্তু যখনই কোনো অসুখ-বিসুখে পড়তাম, ঠিকই মায়ের কাছে খবর চলে যেতো। প্রচন্ডো জ্বরের ঘোরে প্রলাপ বকে বকে ক্লান্ত একটু হুশ এলে যে মুখটিকে প্রথম দেখতাম, সেটা আমার মায়ের মুখ ছিলো।

চাকুরি জীবনে একবার আমার পাশের অফিস বিল্ডিঙ্গে আগুন লাগে। মিডিয়ার কল্যানে সবাই জেনে যায়।

আমার এতো রিলেটিভ (বিয়ের পরে বউ এর দিকেরা ই রিলেটিভ বলে গন্য হয়), তার পরও সর্ব প্রথম মায়ের গলা ফোনে ভেসে আসে,

'তুই ভালো আছিস তো? তোদের অফিসে কিছু হয় নাই তো?'

উদ্বিগ্ন এক মায়ের মমতাকে তখনো উপলব্ধি করতে পারি না।

এর পরে আরো দিন চলে যায়।

সময় বয়ে চলে কালের আবর্তে।

একদিন আমার মা ছবি হয়ে যায়!

সেদিন আমি বুঝি আমি কি হারিয়েছি।কিন্তু এই উপলব্ধি দিয়ে আমার কি লাভ হয়েছে। এক মা তার সন্তানের থেকে দূরে থাকার সময় কি যাতনা ভোগ করেন, অল্প দিনের ভিতর আমি সেটাও অনুভব করি।

আমার বড়ো মেয়েও ছবি হয়ে যায়!

আমার হৃদয়ের সকল উপলব্ধির শিরা -উপশিরা পুড়ে যায়।

আমি মনে মনে আর্ত-চীৎকার করি... কিন্তু কেউ তা শুনতে পায় না।

আমার দু চোখের সাগর বয়ে বয়ে শুকিয়ে যায়... কিন্তু তাতে কারো পায়ের পাতাও ভিজে না।

আমি যদি পাগল হয়ে যেতাম তবে তাও মনে হয় ভালো হতো।

কিন্তু জীবন তো থেমে থাকার নয়। আমার আরো এক সন্তান আসে।

আমি তাকে নিয়ে হাসি। আমার বউ এর সাথে মিলিতো হই।

কিন্তু যে সত্তাকে আমি হারিয়েছি, তার জন্য এক নীরব -বোবা কান্না অবচেতন মনে থেকে ই যায়।

মা!

আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি।

কিন্তু সেটা আমি বুঝেছি তোমাকে হারানোর পরে।

জীবনের ওপার থেকে তুমি নিশ্চয়ই আমাকে দেখছ।

আমাকে ক্ষমা করতে না পারো...শুধু একবার বলতে কি পারো-

'তুই ভালো আছিস তো?'

............................................................................

এরপরের পৃষ্ঠাগুলো খালি।

বুঝলাম না এটা আমার কাছে পাঠানোর কি কারণ?

ভুলে কি আমার কাছে চলে এলো?

একটা রহস্যময় ডায়েরী যেভাবেই হোক আমার কাছে এসেছে... কিছু অসহ্যকর কষ্ট সাথে করে বয়ে এনেছে। একজন সন্তানের ভুল পথে চলার ফলে উদ্ভুত পরিস্থিতিতে চির মমতাময়ীর থেকে বিচ্ছিন্ন হবার যন্ত্রণা... একই সাথে অবচেতন মনে তাকে কাছে পাবার জন্য অধীরতা। এই দু'য়ের মাঝে বয়ে চলা নাগরিক জীবন... একান্নবর্তী সংসারের ভাঙ্গন... সব কিছুই এখন কত স্বাভাবিক।

এতোটা স্বাভাবিকও কি অস্বাভাবিক নয়??? Rose Rose Good Luck

বিষয়: সাহিত্য

১২২৯ বার পঠিত, ১০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

266388
১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৪ রাত ০৮:৪৯
মনসুর লিখেছেন : মহান আল্লাহ আমাদর সবাইকে হেদায়েত দিয়ে দুনিয়া ও আখেরাতে নেক কামিয়াবী দান করুন, আমীন।
১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৪ রাত ০৯:১১
210120
মামুন লিখেছেন : আমার ব্লগে স্বাগতম আপনাকে।
ধন্যবাদ অনুভূতি রেখে যাবার জন্য।
আল্লাহ পাক আপনার দোয়া কবুল করুন-আমীন।
জাজাকাল্লাহু খাইর।Happy Good Luck
266396
১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৪ রাত ০৯:১৫
মাহবুবা সুলতানা লায়লা লিখেছেন : মানুষের জ্ঞান একটুতেই লোপ পাওয়া ঠিক নয়! মাকে মায়ের সম্মান আর স্ত্রীকে স্ত্রীর সম্মান দেয়াই জ্ঞানী পুরুষের দায়িত্ব!
১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৪ রাত ০৯:৩২
210124
মামুন লিখেছেন : সহমত।
কিন্তু আমাদের সমাজে এমন লোকের সংখ্যা একেবারেই কম নয়। আর এজন্যই বৃদ্ধনিবাসের সংখ্যাও বেরে যাচ্ছে। সবার আগে প্রয়োজন নিজেদের মনের ভিতরের ওল্ড হোম গুলোর মূলোৎপাটনের।
ধন্যবাদ আপনাকে।
জাজাকাল্লাহু খাইর।Happy
266410
১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৪ রাত ১০:০৫
আতিক খান লিখেছেন : মায়ের বিকল্প মাই। যে যত আগে বুঝে মঙ্গল। বেশ ভালো লাগলো। Rose Nail Biting Rose Good Luck
১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৪ সকাল ০৯:১৯
210169
মামুন লিখেছেন : সহমত।
ধন্যবাদ এবং শুভেচ্ছা রইলো।
জাজাকাল্লাহু খাইর।
266427
১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৪ রাত ০৩:১৮
বৃত্তের বাইরে লিখেছেন : মায়েদের কোন তুলনা নেই। সন্তানের এমন আচরণও তারা কীভাবে যেন পরম মমতায় ক্ষমা করে দিতে পারেন! আল্লাহ্‌ আমাদের সবাইকে বাবা মায়ের হক আদায় করার তৌফিক দিন। আমীন Praying Rose Good Luck
১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৪ সকাল ০৯:২০
210170
মামুন লিখেছেন : আমীন।
আপনার অনুপমেয় মন্তব্যটি হৃদয় ছুয়ে গেল।
অনেক ধন্যবাদ।
জাজাকাল্লাহু খাইর।Happy Good Luck
266435
১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৪ রাত ০৪:০৬
কাহাফ লিখেছেন :
"মায়ের আচল নীড়ে তোমরা যারা-
আছো মা-র স্নেহের ছায়ায়,
বুঝবে কি করে বলো.....
মা ছাড়া এ হ্রদয় কত অসহায়?"

রহস্যময় ডায়েরীর কথামালা আমাদের অবচেতন মনকে মায়ের কাছে ফিরিয়ে নিয়া যাক সবসময়ের জন্যে.....।
পৃথিবীর সব ভালবাসা/শ্রদ্ধা মায়েদের উদ্দেশ্যে.....
১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৪ সকাল ০৯:২১
210171
মামুন লিখেছেন : খুব ভালো লিখেছেন, সহমত।
সকল মায়েরা দুই জীবনেই ভালো থাকুক।
ধন্যবাদ।Happy Good Luck

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File