একটি পেন্ডিং ফ্রেন্ড রিকোয়েষ্ট (ধারাবাহিক গল্পঃ পর্ব-২)
লিখেছেন লিখেছেন মামুন ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৪, ০৮:২৩:৫৮ সকাল
২.
আজ অসময়ে বাসায় আসাতে জেসমিনের হাতের নাস্তা আর বারান্দায় পাশে বসে চা খাওয়া – এ দুটো অনেকদিন পরে শিহাবের ভাগ্যে জুটলো। ব্যাঙ্কটাউনের তিনতলা এই বাড়ীটার প্রতিটি রুমের সাথেই একটা করে বারান্দা থাকাতে জেসমিনের খুব পছন্দ হয়েছিল। ভাড়াটা একটু বেশী হলেও নিরিবিলি পরিবেশটা শিহাবের পছন্দ। ভিতরে স্কুল থাকাতে মেইন রোড পার হয়ে বাচ্চাদেরকে নিয়ে যাওয়া-আসার টেনশন নেই। এটাও একটা কারণ ছিল ব্যাঙ্কটাউনের মতো একটু দূরে বাসা নেবার।
বারান্দায় বসলে অনেকটা আকাশ দেখা যায়। আশেপাশের বাড়িগুলো ঢাকার অন্য যায়গার মতো একেবারে গা ঘেঁসে বানানো নয়। খুব সুন্দর ভাবে মোটামুটি একটা প্রাইভেসি মেইন্টেইন করেছেন এখানকার বাড়িওয়ালারা। এখন শিহাব জেসমিনকে সাথে নিয়ে বসে আছে।মেয়েরা সামনের মাঠে খেলছে। আরো অনেক পরিচিত ছেলেমেয়েদের মাঝে নিজের দুই রাজকন্যার উচ্ছলতা বসে বসে দুজনে দেখছে। শিহাবের একটা হাত নিজের হাতে তুলে নেয় জেসমিন। শিহাব বাইরে থেকে দৃষ্টি সোজা জেসমিনের চোখে এনে উত্তরটা পেয়ে যায় নীরবেই। সব কিছুই কি মেয়েদের চোখে লেখা থাকে নাকি! এজন্যই কি বলা হয়, 'চোখ যে মনের কথা বলে'। নিশ্চুপ থেকেই শিহাব একটা স্পর্শের কোমল অনুভুতিতে হারিয়ে যায়। একটা পরম নির্ভরতায়...
অথচ জেসমিনকে কেন্দ্র করেই বিয়ের পরে মায়ের সাথে কেমন একটা দূরত্ব তৈরী হয়েছিল। সেটা বাড়তে বাড়তে এমন একটা পর্যায়ে গেলো- আলাদা বাসায় চলে যেতে হয়েছিল ওদের। জেসমিন ও শিহাব। দুজনে ঘর-সংসারের কি বোঝে তখন। ওরা বাবা-মায়ের অনেক আদরের সন্তান হিসেবে বেড়ে উঠেছিল। বলা যায় ননীর পুতুল ছিল ওরা। সেই ওদেরকেই কিনা একটা অথৈ সাগরে ফেলে দেয়া হল। আজ এতোদিন পরে এটা ভাবছে না শিহাব, কার দোষ ছিল। কিন্তু সে নিজেও তখন অনেক ভুল করেছিল। আজ একজন বাবা হয়ে বুঝতে পারছে। তবে সেই সময়গুলোর কথা কখনো কি ভোলা যাবে? মৌমিতা তখন জেসমিন এর গর্ভে। শিহাব এর কোনো জব নেই। বাবা মা তাদের বড় ছেলেকে নিজের পায়ে দাঁড়া না করিয়েই বিয়ে দিয়েছিলেন। চাকুরীর জন্য অবশ্য শিহাব চেষ্টা করে যাচ্ছিল। ওর বাবার ইচ্ছে ছিল বিসিএস পাস করে ওনার মতো সরকারী চাকুরে হওয়ার। কিন্তু তার আগেই তো...
কত কষ্ট করেছে শিহাব সেই সময়ে। কয়েকটা টিউশনি করেছে। সকালে-দুপুর-সন্ধ্যায়। জেসমিনকে সময় দিতে হয়েছে। সেই সাথে ইন্টারভিউর পর ইন্টারভিউ। কিন্তু কোথায়ও কিছু হল না। তবুও দমলো না শিহাব। এদিকে একা একা বাসায় থাকতে থাকতে জেসমিন মানসিক ভারসাম্য হারাতে বসেছিল। শিহাব জেসমিনের পরিবারের কোনো সাহায্য নিত্যে চাইলো না। এ ব্যাপারে জেসমিনকে কঠোরভাবে নিষেধ করে দিয়েছিল। এই সব কিছু মিলিয়েই জেসমিন ভিতরে ভিতরে কষ্ট পাচ্ছিল। কিন্তু বড়ই চাপা স্বভাবের হওয়ায় শিহাবকে কিছুই বুঝতে দেয় নাই। একেবারে শেষ পর্যায়ে এসে সেটা ধরা পড়ে।
সেই সময়গুলোতে জেসমিন কারনে অকারনে শিহাবকে সন্দেহ করতে থাকে। টাকা আয়ের জন্য শিহাবকে বাইরেই বেশী সময় কাটাতে হত। সেই অনুপস্থিত সময়গুলোর প্রতি জেসমিনের তীর্যক দৃষ্টি ওকে অনেক পীড়া দিলেও অনাগত সন্তানের কথা এবং জেসমিনের মানসিক অবস্থার কথা ভেবে নীরবে সহ্য করে যেতো। একটু নিজের পায়ে দাঁড়াতে ওর সে কি আপ্রাণ চেষ্টা!
আবার বাস্তবে ফিরে আসে শিহাব। এক ফাঁকে জেসমিন পিসিতে গান ছেড়ে দিয়ে এসেছে। চিত্রা সিং এর ' বাঁকা চোখে বলো না ' গানটি বাজছে। গানের কলিটা খুবই সুখশ্রাব্য ও মনকে প্রগলভ করে দেবার মত। এখন বেজে চলেছে-
'কিছু দিন থেকে গেছি কাছে কত সুখে মন ভরে আছে
স্মৃতি তার মনি মালা হয়ে এ জীবনে জানি যাবে রয়ে'...
এই ১৪ বছরে কত উত্থান-পতনের ভিতর দিয়ে যেতে হয়েছে। জেসমিনের সাথে দুবার দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছিল। সেই দু'বারই ৬ মাস করে মৌমিতা এবং জেসমিন থেকে দূরে থাকতে হয়েছিল শিহাবকে। জেসমিনই ওকে বাসা থেকে বের করে দিয়েছিল। একটা অক্ষম ক্ষোভ-রাগ ও লজ্জায় সেদিন বাসা থেকে বের হয়ে আর পিছনে ফিরে তাকায় নাই। জেসমিনও ওকে ডাকে নাই। দুজনেই যার যার জেদ নিয়ে অটল থাকাতে সম্পর্কটাই শেষ হয়ে যাবার উপক্রম হয়েছিল। পরিবারের অন্য সদস্যদের জন্য সেবার সব ঠিক হলেও এর পরেরবার শিহাবের কোনো দোষ ছিল না। একটা সামান্য ভুল বোঝাবুঝির জন্য কতটা মুল্য দিতে হয়েছিল...
শিহাবের হাতের নীচে নিজের হাতে চাপ অনুভব করে জেসমিন... সামান্য ব্যাথাও পায়। অবাক হয়ে তাকায় ওর মুখের দিকে। কোথায়-কোন সুদূরে হারিয়ে আছে ওর মানুষটি সেটা কিছুক্ষণ বোঝার চেষ্টা করে। ইদানিং একটু অন্যরকম দেখছে সে ওর ভালবাসার নরম-গরম পাগলাটে এই মানুষটিকে। জিজ্ঞেস করে পরম মমতায়-
: কি সাহেব? কোথায় আছ এখন?
শিহাব ঘোর কেটে বাস্তবে আসে। প্রগাঢ় স্বরে বউয়ের চোখে চোখ রেখে অস্ফুটে বলে-
: তোমার হৃদয়ের বীট এর ভিতরে 'আমি আমি' শব্দ বাজছে কিনা সেটা শুনতে চাইছিলাম।
হাসির দমকে কাছাকাছি থাকা দুটি হৃদয় দুলে উঠে আরো কাছে চলে এলো।
ওদিকে সন্ধ্যার আকাশে আবীর রাঙানোর খেলা শুরু হয়ে গেছে... মৌমিতা ও রিয়া খেলা শেষে বাবা-মায়ের কাছে ফিরে আসছে... দু'জোড়া চোখের মায়াভরা পথ বেয়ে বেয়ে।
... ....
একদিন ঘুম থেকে উঠে আবিষ্কার করে ৪০ পার হয়ে গেছে। কেটে গেছে যৌবনের বসন্ত বেলা! ছোট রাজকন্যাটাও এখন শিহাবকে পেপার পড়ে শোনাতে পারে... কম্পিউটারে ছবিকে এডিট করে বাবার জন্মদিনে ভোরবেলায় প্রিন্ট করে মাথার পাশে রেখে দিতে পারে! তার এবং জেসমিনের মাথার শুভ্র কেশ জীবনের ওপারের ডাক আসার সতর্ক সংকেত দিচ্ছে।
অথচ কত কিছুই যে করা বাকী...
ওরা দুজন একে অপরকে এখনো তো ভালভাবে একটু বুঝতেই পারলো না। শরীরের চাহিদা তো যে কোনোভাবে মিটে যায়ই।
কিন্তু মনের?
মনের নাগাল কি পেয়েছে? কখনো কি সে চেষ্টা করেছে?
জেসমিন বা সে নিজে?
সময়ের নিয়মে সময় কেটে যাচ্ছে ঠিকই। কিন্তু একজন কাছের মানুষ হয়ে শিহাব তার কাছের মানুষদেরকে কতখানি কাছে টেনে নিতে পেরেছে?
আচ্ছা, কাছের মানুষগুলো কারা ওর?
ড্রয়িং রুমে সোফায় এখন। ল্যাপটপে লিখতে বসে শিহাব কথাগুলো ভাবছিল। চিন্তা অক্ষরে রূপ নিচ্ছে। লিখেই চললো সে-
আব্বার কথা মনে পড়ছে আগে। একটা প্রচন্ড ভালোবাসা আর জীবনে যা কিছু পাওয়ার আশা, সব এই একজনকে ঘিরে আবর্তিতো ছিল একসময়। আজ মনে হচ্ছে, সে শুধু চেয়েই গেছে। দিতে পেরেছে কি কিছু? হিসাবের চুলচেরা বিশ্লেষণ করে একটা বিশাল ‘শূন্য’ ছাড়া আর কিছু দেখতে পেলো না। অবশ্য আব্বাও কখনো কিছু ওর কাছে পাওয়ার আশা করেন নি। একতরফা শুধু দিয়েই গেছেন বিনিময় আশা না করে।
আম্মার কথা মনে হলে, প্রথমেই একটা প্রচন্ড অভিমান হৃদয়ে নাড়া দিয়ে যায়। এতোটা বেশী যে স্বাভাবিক ভালবাসাটাও চাপা পড়ে গেছে। একটা ভালবাসার মৃত্যু হওয়া অনুভব করে আম্মার কথা চিন্তা করলেই। জেসমিনকে তিনিই পছন্দ করেছিলেন ওর জন্য। অথচ মেয়েলি কিছু ইর্ষাজনিত কিংবা ওর বোধের বাইরের অন্য কোনো কিছু অবোধ্য অনুভুতির প্ররোচনায় হয়তো আম্মা ওর আর জেসমিনের মাঝে দেয়াল হয়ে দাড়িয়েছিলেন। আর সেই দেয়ালকে সরানোর চেষ্টা না করে শিহাব একটা সহজ পথ বেছে নিয়েছিলো।
দেয়ালের ওপারে চলে গিয়েছিলো জেসমিনকে নিয়ে।
আম্মাকে একা ফেলে!
বিষন্ন-একাকী ও হেরে যাওয়ার বেদনায় আম্মা নিজের ভিতরে গুমরে কেঁদেছেন। আত্মীয়স্বজন ও আশপাশের সকলের সামনে ছেলের হঠকারিতায় ছোট হয়েছেন। কিন্তু তারপরও শিহাবের থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন নাই। বরং দিন দিন তার হৃদয়ের ভালবাসাটা এই ছেলেটির প্রতি আরো বাড়িয়ে দিয়েছিলেন।
তবে সে এবং জেসমিন এতোটা দূরে সরে গিয়েছিলো যে আম্মার ভালবাসাকে ভান মনে করে ক্রমে ক্রমে আরো শক্ত হয়ে উঠেছিল। ওদের দুজনের হৃদয়ের উপরের কোমল পর্দাটা এই ১৪ বছরে এতটা পুরু হয়েছে যে, আম্মার ভালবাসার কোমল পরশ সেই কঠিন হৃদয়ে বারবার ধাক্কা খেয়ে ফিরে এসেছে।
ছোট ভাইদের সাথে কেবল বছরে দুই ঈদে মোবাইলে মোবারকবাদ জানানো এবং নববর্ষ গুলোতে (নিউ ইয়ার সহ) ম্যাসেজ পাঠানোর ভিতরে এখন সীমাবদ্ধ। আর কখনো পরিচিত কেউ মারা গেলে সেই সংবাদ পৌঁছানো... এ পক্ষের ইন্নালিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাইহে রাজেউন পড়া।
ছোটবেলার সেই বন্ধুত্তপুর্ণ আত্মার সম্পর্কটি অন্য পরিবারের একটি মেয়েকে বউ করে আনার পরে এতো দ্রুত কীভাবে শেষ হয়ে যেতে পারে?
ওর একটা লিখায় শিহাব লিখেছিল-
“... ভাইয়েরা যেভাবে ছোটবেলা থেকে একসাথে পরিবারে বেড়ে উঠে, একটা মেয়েকেও সেই ছেলেবেলা থেকে বালিকা বধু হিসেবে পরিবারে বেড়ে উঠার সুযোগ দিতে হবে। দেবর এবং ননদ তখন মেয়েটির ভাই ও বোনে পরিণত হবে। শাশুড়ি হবেন মা। আর স্বামীর অন্তরের অন্তঃস্থল পর্যন্ত যেয়ে সেই বালিকা বধু যখন সময়ের সাথে সাথে পুর্নাঙ্গ বউতে পরিণত হবে- সেখানে একটা কঠিন ও নিবিড় সম্পর্কের সুত্রপাত হবে, যেটা ছোটখাট বা বৃহৎ আকস্মিক কোনো পারিবারিক দুর্ঘটনায় ভেঙ্গে যাবে না। মচকে যেতে পারে। তবে পরিবারের বাকী সদস্যদের সাথে যেহেতু বধু বালিকা বয়স থেকে লালিত-পালিত হয়ে এসেছে, তাদের সকলের যৌথ উদ্যোগে মচকে যাওয়াটা দ্রতো সেরে উঠবেই...।“
(ক্রমশঃ)
বিষয়: সাহিত্য
১০৩৫ বার পঠিত, ১২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
নিজেকে নিয়েই ভাবার আবর্ত থেকে বের হয়ে এসে দেখা সময় গড়িয়ে গেছে অনেক......।শুধরে যাওয়া পথ সীমাহীন দূরত্বের.....।মানুষ ফিরে যায় আপন পরিবারে....মুখ না ঘুড়িয়ে টেনে নেয় তারা আগের মত। এইতো সুখের প্রশান্তির জায়গা ,পরিবার।
সাথে থেকে প্রেরণাময় অনেক ধন্যবাদ জানাচ্ছি.........
অনেক শুভেচ্ছা আপনার জন্য।
মামুন ভাই,অভ্র ইনসষ্টল করলাম তো,আরো কিছু করতে হবে?ফেবুতে বাংলা আসছে না।এখানে কারো সহযোগীতা নেয়ার সুযোগ নেই,নিজেও বুঝতেছি না।হেল্প চাই....................
আমারো এক্সময়ে একজন অন্ধ মেয়েকে বিয়ে করার ইচ্ছে হয়েছিল। এই ইচ্ছেটার পিছনে যতীন্দ্রমোহন বাগচির 'অন্ধ বঁধু' কবিতাটি এবং প্রয়াত আজম খানের 'যে মেয়ে চোখে দেখে না' গানটি অনেক প্রভাব ফেলেছিল। কিন্তু এখন বাস্তবতা দেখুন, এখনকার জীবনসঙ্গিনী আমার সকল কিছুই কিভাবে যেন দেখে ফেলে, সে দৃশ্যমান হোক আর অদৃশ্যই হোক।
অনেক ধন্যবাদ এবং শুভেচ্ছা আপনার জন্য।
শুভেচ্ছা রইলো।
সাথে থাকবার জন্য অনেক শুভেচ্ছা রইলো।
সাথে থাকার জন্য অনেক শুভেচ্ছা।
মন্তব্য করতে লগইন করুন