ধারাবাহিক উপন্যাসঃ নাইয়র (পর্ব-দশ)
লিখেছেন লিখেছেন মামুন ০৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৪, ০৮:২২:১৪ সকাল
পারুল যখন মালেক শিকদারের বাড়িতে পৌঁছাল, ভিজে একেবারে চুপসে গেছে। পথে কয়েকবার দমকা বাতাসে ছাতা উল্টে যাওয়াতে এই বিপত্তি। মালেক শিকদার এবং হাবিব মুন্সী মালেক শিকদারের বাড়ির উঁচু বারান্দায় বসে আছে। মালেক শিকদারের বউ পারুলকে মোবাইল করে ডেকে এনেছেন। উৎকণ্ঠিত চিত্তে তিনি লম্বা বারান্দার পার্টিশনের অপর পাশে পায়চারি করছিলেন। জানালা দিয়ে পারুলকে দোরগোড়ায় দেখতে পেয়ে নিজেই এগিয়ে এলেন। দরোজা খুলে দিয়ে ওকে এই অবস্থায় দেখে বললেন, ' এসেছিস মা! ইস, ভিজে গেছিস যে একেবারে। ভিতরে গিয়ে মাথা মুছে নিবি, চল।'
বারান্দায় উঠে পারুল ওপাশে বসে থাকা হাবিব মুন্সী এবং মালেক শিকদারকে এক পলক দেখে। এরপর মহিলার পিছু পিছু ভিতরে চলে যায়। সেখানে ভিতরের এক রুম থেকে একজনের যন্ত্রনাকাতর আর্তনাদ শুনতে পায়। নিজের ভিজে অবস্থার দিকে গুরুত্ব না দিয়ে সে ঐ রুমের ভিতরে ঢুকে গেলো। মালেক শিকদারের মেঝ মেয়ে সন্তানসম্ভবা হওয়ায় মাস খানিক হল এখানে এসেছে। জামাইও সাথে আছে। আজ এই বৈরী আবহাওয়ায় তার প্রসব বেদনা উঠেছে। পারুল কাছে গিয়ে মেয়েটিকে ধরে। পারুলকে দেখে কেন যেন আশ্বাস পায় মেয়েটি। তবে পারুল ওর অভিজ্ঞতায় বুঝতে পা্রে অবস্থা বেশ জটিল। এখানে কিছুই করার নেই। হাসপাতালে নিতে হবে। হয়তো সিজার করারও প্রয়োজন হতে পারে। এই আবহাওয়ায় পিরোজপুর যাওয়াটা এক কথায় অসম্ভব। তবে নাজিরপুর স্বাস্থ্য কেন্দ্র এখান থেকে খুব কাছে। মালেক শিকদারের বাড়িটা একেবারে গ্রামের শেষ সীমায় থাকাতে এটি উপজেলার সাথেই। আর নিজে চেয়ারম্যান থাকাকালে উপজেলার মূল রাস্তার সাথে একটা পীচ ঢালা পথ নিজের বাড়ি পর্যন্ত টেনে এনেছিলেন। তাই এখন একটা যে কোনো প্রকার গাড়ি হলেই মেয়েটিকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গিয়ে শেষ একটা চেষ্টা করা যায়।
একটা শুকনো গামছা নিয়ে মালেক শিকদারের বউ ভিতরে এলেন। পারুলকে হাতে ধরিয়ে দিয়ে উৎকন্ঠিত কন্ঠে জানতে চাইলেন, ' কি বুজছস মা? এখানে কিছু করতে পারবি? না অন্য কোথাও নিতে হবে?' তার কথায় লোকাল ধাই মেহেরুন পারুলের দিকে তাকায়। নিজে থেকে বলে, ' মুই লক্ষণ বালা দেখতাছি না।' পারুল মালেক শিকদারের বউকে উদ্দেশ্য করে বলে, ' খালা, আমি নিজেও তো বেশী কিছু জানি না। তবে এখনই যদি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যাওয়া যায়...' পারুলের মুখের কথা শেষ হয় না, বারান্দা থেকে মালেক শিকদারের গলার আওয়াজ ভেসে আসে। সে ক্রুদ্ধ কন্ঠে বলে, ' আমার মেয়ে কোথাও যাবে না। যা হবার এখানেই হবে।'
রুমের ভিতরে প্রসুতির চাপা কষ্টের আওয়াজ... বাইরে একজন বাবা চীৎকার করছে... বিরূপ প্রকৃতি... এসব কিছুর ভিতর দিয়ে একজন মায়ের গলার আওয়াজে সব কিছু মুহুর্তের জন্য থমকে যায়। মালেক শিকদারের বউ রুম থেকে বের হয়ে বারান্দায় মালেক শিকদারের মুখোমুখী হয়।পারুলও তার পিছু পিছু বের হয়ে আসে। হাবিব মুন্সী কাঠের চেয়ারে চুপচাপ বসে থাকে। স্বামী-স্ত্রী মুখোমুখি হয়। মালেক শিকদার দ্বিতীয়বারের মত জানায়, ' আমার মেয়ে উপজেলায় যাবে না। তোমারে এই বুদ্ধি কি এই মাইয়াটা দিছে?' হাত তুলে পারুলকে নির্দেশ করে মালেক শিকদার বউকে জিজ্ঞেস করে। তার বউ এবারে রেগে উঠে বলে, ' আমি-ই ওরে ডেকে আনছি। আর তোমার ধাই বলেই দিছে সে কিছু করতে পারবে না।' এক মুহুর্ত থামে। হাবিব মুন্সীর দিকে তাকিয়ে মালেক শিকদারকে বলে,' প্রয়োজন হইলে আমার মেয়েরে পুরুষ ডাক্তারেই দেখবে ।
হাবিব মুন্সী এবার ঠান্ডা স্বরে জানায়, ' আল্লাহ পাক ভাগ্যে যা রাখছে, তার বাইরে তো কিছুই হইতে পারে না।' পারুল কিছু বলে না। তার অনেক কিছু বলতে ইচ্ছে করে। কিন্তু এখন এই মুহুর্তে সময় নষ্ট না করে মেয়েটিকে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেয়াটাই আসল কাজ। সে মালেক শিকদারের বউকে বলে, ' আমাদের একটা গাড়ি লাগবে।' পারুলের কথা শেষ হতেই তিনি মোবাইল বের করে কাকে যেন ফোন করেন। পারুল ভিতরের রুমে যেতে উদ্যত হলে মালেক শিকদার বেশ জোরের সাথেই বলে, ' এই মাইয়াডা সব নষ্টের মূল। এ্যাই, তুই যা আমার বাড়ি থেইক্যা।' এ কথা বলে তিনি পারুলের সামনে এসে পথরোধ করেন। এটা দেখে মালেক শিকদারের বউ রান্না ঘরের দিকে চলে যান। সাথে সাথেই আবার তিনি বারান্দায় প্রবেশ করেন। তবে এবার অন্য মুর্তিতে। হাতে বিশাল এক ধারালো খেজুর গাছ কাটার দা। এটা হাতে শক্ত করে ধরে তিনি পারুলকে বলেন, ' তুই ভয় পাস না মা। আইজ এই দুই ব্যাটারে প্রয়োজন হইলে আমি শ্যাষ কইরা দিমু। জামাইরে লিয়াকতের টেম্পু আনতে বলছি। তুই ভিতরে যা। আমি এদের দেখতাছি।' হাবিব মুন্সী একটু থমকে যায়। আর মালেক শিকদার বিস্ময়ে হতবাক হয়ে উঠে। যে বউ কখনো তার সাথে উচ্চ স্বরে কথাও বলেনি, আজ তার এই রণরঙ্গিনী মূর্তি দেখে নিজের কাছেই বিশ্বাস হয় না।
তবুও বউকে বলেন, 'তুমি যা করতাছ, ভাইবা চিন্তা করতাছ তো? মাইয়াডারে পুরুষ ডাক্তারের কাছে নিয়া বে-আব্রু করবার চাও? ঈমান-আমল সব শ্যাষ করবার চাও?' স্বামীর চোখে চোখ রেখে তিনি উত্তর দেন, ' আগে জান বাঁচানো ফরয। ঐ মুন্সী-ই তো এই কথা সব সময় বলে। মাইয়ারে বাঁচানোর জন্য যা যা করা লাগে আমি করবো। তবুও বেপারি বাড়ির পোলার বউ এর মত শুধু পানি পড়ার উপর ভরসা কইরা আমার মেয়েরে মরতে দিতে পারি না।'
পনের মিনিটের ভিতরে মালেক শিকদারের জামাই একটা টেম্পু সহ বাড়ির দোরগোড়ায় হাজির হয়। অনেক কষ্টে প্রসূতিকে তাতে তোলা হল। পারুল, ধাই মেহেরুন ও মালেক শিকদারের বউ মেয়েটিকে নিয়ে সীটের নিচের খালি যায়গায় হাত ধরে বসে থাকে। আর মালেক শিকদারের জামাই টেম্পু চালক লিয়াকতের পাশে বসে।
এক দুর্যোগপুর্ণ আবহাওয়ায় তিনজন মহিলা এক সন্তান সম্ভবা মাকে নিয়ে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের দিকে আগায়। তবে এই দুর্যোগপুর্ণ আবহাওয়ায় তাঁদের এভাবে বের হতে গিয়ে যে কষ্ট হয়েছে, তার চেয়েও বেশী কষ্ট হয়েছে আসলে বের হতে পারাটা। যুগ যুগ ধরে গ্রামীণ সমাজে চলে আসা এক সিস্টেমের বেড়াজাল কেটে এই মাত্র তাঁরা এক পরিবর্তনের ঢেউ তুলে এসেছেন! শুরুটা করা গেছে... এখন একের পর এক এরকম ছোট-বড় ঢেউ তৈরী করতে হবে। একসময় এই ছোট-বড় ঢেউগুলোর মিলিত শক্তি প্রতিক্রিয়াশীলদেরকে এক ঝটকায় ভাসিয়ে নিয়ে যাবে।
মালেক শিকদারের বারান্দায় তিনি এবং হাবিব মুন্সী বসে আছেন।
মালেক শিকদার গম্ভীর... কিছুটা লজ্জিত এবং প্রচন্ড রকমের ক্ষীপ্ত। হাবিব মুন্সীর সামনে এবং বিশেষ করে পারুলের সামনে তার বউ যে কান্ডটা করল- তাতে করে নিজেকে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে পারলে মনে হয় ভালো লাগত।
হাবিব মুন্সী একা একা বলে যেতে থাকে, ' কলি কাল বইলা একটা কথা শুনতাম। এইটা হইলো সেই কলিকাল।' মালেক শিকদার তার দিকে তাকালে হাবিব মুন্সী এবারে বলে, ' নিজের বউ যখন কথা শুনতে চায় না, তারে না রাখাই ভালো।'
মালেক শিকদার অবাক হয়ে তাকায়। বলে, ' একটু পষ্ট কইরা বলেন, কি বলবার চান?'
হাবিব মুন্সী বলে, ' যে বউ স্বামীর অবাধ্য হয়, তারে তালাক দেওয়া উচিত। তুমি তারে ছাইড়া দেও।' প্রথমটায় মালেক শিকদার বুঝে উঠতে পারেনা হাবিব মুন্সীর কথাটা। তবে মস্তিষ্ক যখন বিষয়টা উপলব্ধি করে, সে বসা থেকে সোজা দাঁড়িয়ে যায়। কিছুক্ষণ হাবিব মুন্সীর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। এরপর তার বউ এর ফেলে যাওয়া গাছ কাটা দা-টির উপরে চোখ পড়ে। সেটি এখনো বারান্দার এক কোণে অবহেলায় পড়ে আছে। ক্রোধে মালেক শিকদারের সারা শরীর জ্বলে যায়। একবার ইচ্ছে হয় হাবিব মুন্সীর ধড়টা এক কোপে আলাদা করে ফেলে।
অনেক কষ্টে নিজেকে সামলায় সে। তার ভিতর থেকে একজন পত্নী বৎসল পতি উঁকি দিয়ে যায়... এক স্নেহাশীল পিতা ক্ষনিকের জন্য তাঁকে ঘিরে রাখে। একজন কালো মনের মানুষের ভিতর থেকে একজন সাদা মনের মানুষ- একজন স্বামী এবং পিতার রূপ নিয়ে বের হয়ে আসতে চায়। একজন মালেক শিকদার হৃদয়ে ভালোবাসায় কানায় কানায় পুর্ণ একজন স্বামী থেকে একজন পিতায় রূপ নেয়... একজন পিতা থেকে আবার সাবেক চেয়ারম্যান মালেক শিকদারে... এভাবে বেশ কয়েকবার তার ভিতরে এই রুপান্তর ঘটে। কিন্তু একবার অধঃপতনের দিকে যাওয়া শুরু করলে এতো সহজেই কি ফিরে আসা যায়?
সে হাবিব মুন্সীর কথার উত্তরে বলে, ' দেখি, ভাইব্যা দেখি।' বউয়ের প্রতি দীর্ঘ এই বছরগুলোতে যে মায়া জমেছে... সংসার সংসার খেলতে গিয়ে এতটা কাছে এসেছেন... ভালোবাসাগুলো বাইরে থেকে হয়তো দেখা যাচ্ছে না... কিন্তু সেই বউকে মুহুর্তের জন্যও নিজের থেকে দূর করে দিতে মন টানছে না। তালাক দিয়ে সম্পর্ক শেষ করে দেয়াটা তো অনেক পরের কথা।
বাইরের একটানা বৃষ্টির সাথে মালেক শিকদারের হৃদয়েও টানা বর্ষণ হতে থাকে... হৃদয় থেকে রক্তক্ষরণের এই শব্দ তিনি একাই শুনতে পান... পাশে বসে থাকা হাবিব মুন্সীর জন্য চোখ দিয়ে সেই রক্তক্ষরণকে বের করে দিয়ে যে একটু শান্তি লাভ করবেন তা-ও পারেন না। এক জটিল ভাবালুলতায় মালেক শিকদার ভিতরে ভিতরে কাঁপতে থাকেন। অনেক দিন পরে নিজের মেয়ে এবং বউ এর জন্য একটা অন্যরকম ভালোবাসা ঝঞ্ঝা বিক্ষুব্ধ পরিবেশে লিলুয়া বাতাসে পাক খেতে থাকে। একই সাথে তার পাশে থাকা হাবিব মুন্সীর উপস্থিতি সেই ভালোবাসাকে দূরে ঠেলে দিতে থাকে... একজন মালেক শিকদার যেন কোনোভাবেই একজন বাবা-য় পরিণত হতে না পারে... এই কাজটিও করার জন্য প্রকৃতি অন্য এক বাতাসকে প্রেরণ করে। আর এই দুইয়ের মাঝে পিষ্ট হতে থাকে একজন সাদা-কালোয় মিশানো মানুষ!
... ... ...
'বিকশিত শ্রীরামকাঠী' তার যাত্রা শুরু করেছে।
গতকাল মাগরিবের নামাজের পরে বৃদ্ধা এবং বৃদ্ধদেরকে নিয়ে আলাদা কক্ষে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়েছে। বিরামহীন বৃষ্টি গতকালই কমে এসেছিল। শুরুটা একটু ঘটা করেই করার পক্ষপাতি ছিল মোতাহার। ওর যুক্তি ছিল, যেখানে বর্নাঢ্য উদ্বোধন-সেখানেই বেশী আলোচনা কিংবা সমালোচনা। আর এর দ্বারাই এই বয়স্ক শিক্ষার ব্যাপারটি পুরো গ্রাম ছাড়িয়ে অন্যান্য গ্রামেও ছড়িয়ে পড়বে। এর ফলে ওদের দেখাদেখি ঐ গ্রামগুলোতেও এই শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হবার সম্ভাবনা দেখা দিতে পারে।
তবে মুজিবর ও পারুল মোতাহারের সরাসরি বিপক্ষে মত না দিলেও ওরা খুব সাধারণভাবে এই প্রকল্পটি শুরুর ইচ্ছে পোষণ করে। ওরা যুক্তি দেখায়, আগে নিজেদের ভিত্ মজবুত করে তারপর এই প্রকল্পটির ব্যাপক প্রচার-প্রসার ঘটানো উচিত। এতে করে বয়স্কদের শিক্ষা কার্যক্রমের প্রতি অন্যরা আকৃষ্ট হবে বেশী। কারন এরই ভিতরে এই কার্যক্রম কিছু মানুষকে তৈরী করে ফেলতে পারবে যারা লিখতে পড়তে জানত না। সেই লোকগুলোকে দিয়েই যদি গ্রামে গ্রামে নিয়ে গিয়ে তাদের মুখে এই শিক্ষা গ্রহনের ব্যাপারে বলা হয়, তবে বেশী প্রভাব পড়বে।
উপজেলা শিক্ষা অফিসারকে ইনভাইট করা হয়েছিল। তিনি আসতে পারেননি। তবে তার সহকারিকে পাঠিয়েছিলেন। শ্রীরামকাঠী হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক সহ এলাকার আরো গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গকে দাওয়াত দেয়া হয়। দুষ্ট চক্রের সকলকে বলা হলেও তারা কেউ-ই আসেনি। তবে মালেক শিকদারের বউ এসেছিলেন। তার বাড়ি থেকে বড় ছেলের বউকেও সাথে নিয়ে এসেছেন। ওনারা দুজনে এসেছিলেন অবশ্য ছাত্রী হিসাবে।
সেদিন রাতে পারুলের সাহায্য না পেলে তার মেয়েকে বাঁচাতে পারতেন কিনা সন্দেহ। সারাটি রাত সেই দুর্যোগপুর্ণ আবহাওয়ায় তাঁরা যে উৎকণ্ঠায় কাটিয়েছিলেন! উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ডাক্তারকে বাসা থেকে ডেকে নিয়ে আসা হয়। পারুলের সহায়তায় এবং ডাক্তারের আন্তরিকতায় সিজার ছাড়াই সন্তান ভূমিষ্ঠ হয়। তখন রাত প্রায় ভোর হয়ে এসেছে। তবে মা ও নবজাতক উভয়েই সুস্থ ছিল। সেদিন উপস্থিত সকলেই পরম দয়াময়ের কাছে আন্তরিক দিলে শুকরিয়া জানায়। একপর্যায়ে মালেক শিকদারের বউ পারুলকে বলেছিলেন, ' মা! তুমি আজ থেকে আমার মেয়ে। যে কোনো সময়ে তোমার যে কোনো কাজে আমার সাহায্য লাগলে বলবা।' পারুল হেসেছে শুধু। তবে এলাকায় যে বয়স্কদের জন্য লেখাপড়ার ব্যবস্থা করা হচ্ছে এটা জানাতেও ভুললো না। ওর কাছ থেকে জেনেই তিনি তার বড় ছেলের বউকে সাথে নিয়ে স্কুলে শিক্ষা নিতে এলেন।
হাবিব মুন্সী তার সহচরদেরকে নিয়ে ফন্দী আটতে থাকেন। তিনি বেশ ভালোভাবেই বুঝতে পারেন গ্রামের সাধারণ মুর্খ মানুষ যদি শিক্ষার আলো পেতে থাকে, তবে তাদেরকে এতোদিন যেভাবে দমিয়ে রেখেছিলেন তা আর সহজ হবে না। ওদের টিপ সই নিয়ে যা ইচ্ছে লিখিয়ে নেয়া যাবে না। আর যে প্রগতির পথে পারুলেরা তাদেরকে নিয়ে যেতে চাচ্ছে, এই বয়স্ক শিক্ষা প্রকল্পটি তাতে আরো গতি সঞ্চার করবে। হাবিব মুন্সী এতোদিন অন্ধকার বিলিয়ে এসেছেন। আজ হঠাৎ করে এক সাথে এতো আলোর সম্মুখীন হয়ে তিনি কিছুটা হলেও হোচট খেলেন। তবে একেবারে দমে গেলেন না। তার কুট ব্রেইনের অন্ধকার গহীন কোণ থেকে কিছু ভয়ংকর প্ল্যান মাথাচাড়া দিতে থাকে। নিজের মনে একা একাই সেগুলোকে যাচাই বাছাই করেন... কিছু গ্রহন করেন... কিছু ফেলে দেন। এভাবে একে একে অনেক গুলো থেকে অবশেষে মনের মতো একটা 'প্ল্যান' করেন।
শ্রীরামকাঠী গ্রামে কোনো ভিক্ষুক ছিল না। তবে পাশের টেংরাকাঠী গ্রাম থেকে কয়েকজন বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে ঘুরে মাঝে মধ্যে এখানে আসে। তারা সবাই ই মুখ চেনা। শহরের ভিক্ষুকদের মতো তাদেরকে দেখেই কেউ মুখটা কালো করে ফেলে না। কিংবা চোখে মুখে দেখা দেয় না বিরক্তির চিহ্ন। এই গরীব মুসাফিরগুলো মানুষের দ্বারে দ্বারে যায় ঠিকই। তবে এরা পরিবারের সদস্যদের মত সুখ-দুঃখের আলাপ আলোচনা করে অনেকটা সময় কাটিয়ে যায়। গৃহস্বামী বা কত্রীরাও তাঁদের সাথে হাসিমুখে কথা বলে। বাড়ির দাওয়ায় বসে তাদেরকে 'চাল' দিয়ে দেবার পরেও এটা ওটা খেতে দেয়। কখনো বা রান্না ঘরে তরকারি কাটার সময়ে পরিচিত মুসাফির নিজেও একটু সাহায্য করে। কাজ করার সময়ে দূর গ্রামের খবরাখবরও জানা হয়ে যায়। গ্রামীন সমাজে আগে এভাবেই এক যায়গা থেকে অন্য যায়গায় যে কোনো খবর পৌঁছে যেতো। এখন অবশ্য মোবাইলের যুগ।
সেই শ্রীরামকাঠীর মানুষ একদিন অবাক হয়ে দেখলো তাঁদের নিজের গ্রামের এক বৃদ্ধা ভিক্ষার ঝুলি হাতে নিয়ে পথে নেমেছে! গ্রামের অবস্থান বোঝাতে 'কান্দা' শব্দটি ব্যবহার করা হয়। যেমন পুর্ব দিকের মানুষদেরকে 'পুব কান্দার' বলা হয়। এভাবে পশ্চিম/উত্তর/দক্ষিণ কান্দা ব্যবহৃত হয়ে আসছে। গ্রামের উত্তর কান্দার মৃত সোবহান মোল্লার বিধবা স্ত্রী আছিয়া বেগম। একমাত্র ছেলেকে বিয়ে করিয়েছেন বছর দুই হল। আর্থিক অবস্থা তেমন স্বচ্ছল না হলেও ভিক্ষার ঝুলি হাতে পথে নামার মতোও না। মুজিবর তার ক্লাব ঘরের জানালা দিয়ে যখন আছিয়া বেগমকে এভাবে আসতে দেখে, প্রথমে একটু অবাক হয়। এরপর সে যখন শিকদার বাড়ির দিকে হেঁটে যায় কৌতূহলবশত মুজিবরও পিছু নেয়। একটু দূর থেকে সে সব দেখতে থাকে। বৃদ্ধা পারুলদের উঠানে দাঁড়িয়ে কিছু সাহায্য করার জন্য মুসাফিরদের গলায় ডাক দেয়।একজন মা পরিণত হন একজন ভিক্ষুকে! মুজিবর ভাবে, একজন ভিক্ষুক কথাটা বললে চোখের সামনে যাকে দেখা যায় বা যার ছবি ভেসে উঠে- মহিলা হলে সেখানে একজন মা কেন ভাসে না? পুরুষ হলে একজন বাবাকে কেন দেখা যায় না? আমাদের চোখে ভিক্ষুক সব সময়েই একজন ভিন গ্রহের প্রানীর মতো ধরা দেয়। এই যে আছিয়া বেগম এখন সাহায্য চাইছে, খোদ মুজিবরের মনের ভিতরেই সেই আগের আছিয়া বেগমের প্রতি যে ফিলিংটা ছিল, এখন আর সেটা আসছে না। চিরপরিচিতির বেড়াকে পাশ কাটিয়ে এখন অন্য একজন আছিয়া বেগমের আবির্ভাব হয়েছে। যার একটাই পরিচয়- তিনি একজন ভিক্ষুক।
মুজিবর খুব ব্যথিত হয়। এই ব্যাপারটার অনেক গভীরে যাবে সিদ্ধান্ত নেয়। কেন পারিবারিক জীবন থেকে আমাদের অগ্রজদের এই ছিটকে পড়া? যে ভালোবাসা দিয়ে তাঁরা আমাদেরকে অংকুরকাল থেকে মহীরুহে পরিণত হওয়া পর্যন্ত আগলে রাখেন... কেন তাঁদের শেষ সময়টাতে আমরা ভিক্ষের ঝুলি হাতে ধরিয়ে রাস্তায় নামিয়ে দেই? একজন বৃদ্ধা মায়ের শেষ ঠিকানা কেন হবে বৃদ্ধাশ্রম? কিংবা নিজের তিলে তিলে গড়ে তোলা সংসারের এক কোণে বা বারান্দায় কেন তাঁকে ঠাই নিতে হয়?
আছিয়া বেগমকে দেখে পারুলের মাও অবাক হয়। কষ্ট পান তিনিও। খুটিয়ে খুটিয়ে অনেক কিছু জিজ্ঞেস করেন। খাওয়া-দাওয়া হয়েছে কিনা জানতে চান। মুজিবর এবার ফিরে চলে ওর ক্লাব ঘরটির দিকে। বৃদ্ধাকে ফিরে আসার সময় এখান দিয়েই যেতে হবে। তখনই সে সব জেনে নিবে।
মানুষের অবস্থা পরিবর্তিত হবে। কিন্তু তাই বলে এতো দ্রুত অবস্থার এই তারতম্য কেন জানি কবি মুজিবরকে উদ্ভ্রান্ত করে তোলে। সে কিছুক্ষণ আগে গভীর ভাবের রাজ্যে বিচরণ করছিল। একটি কবিতার শুরুটা করবে এমন সময়েই এই বৃদ্ধার আগমন তার সব অনুভূতিকে শুষে নিলো। এখন ভাবের রাজ্যে চরম বাস্তবতা বিরাজ করছে! আর সেখানে দাঁড়িয়ে মুজিবর আছিয়া বেগমের অপেক্ষা করে। যিনি একটু আগেই একজন মা থেকে একজন ভিক্ষুকে পরিণত হয়েছেন।
(ক্রমশঃ)
বিষয়: সাহিত্য
১০০৬ বার পঠিত, ১৪ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
আমি এই বৃদ্ধাশ্রম নিয়ে কিছু একটা লিখতে চাই, ইনশা আল্লাহ, সময় সুযোগ হলে একবার লিখব।
আপনাকে ধন্যবাদ সুন্দর মন্তব্য করার জন্য।
জাজাকাল্লাহু খাইর।
অনেক শুভেচ্ছা।
প্রথম থেকেই ভাবছিলাম পারুলের চরিত্র বাস্তবায়নের জন্য তো বরিশাল অঞ্চলের দরকার। হিন্দু মুসলিম মিলিয়ে যে সমাজ চিত্র অঙ্কন করেছেন সেটা সেখানেই উপস্থিত। আজকে উপরের লিখা পড়ে, নিশ্চিত হলাম।
আপনার দেশের বাড়ী কি ওদিকে?
নাকি কিছুদিন অবস্থান করার কারণে এই চিত্র অনুধাবন করেছেন?
নাকি অন্য কিছু?
সুন্দর রচনা! অবিশ্বাস্য দ্রুত গতিতে আপনি লিখে চলেছেন! আপনার মাথায় কল্প রাজ্য বাস্তব রূপ নিয়ে গিজগিজ করছে, তাই চিন্তা আর হাতের কলম এক সাথে কলা বলছে, নতুবা সম্ভব হতনা। আর এটার নামই প্রতিভা।
ভাল থাকুন, বেশী দিন বেঁচে থাকুন। আমীন।
লেখকের গুরুত্বপূর্ন পোষ্ট গুলো ষ্টিকি করা হউক।
যে এলাকার চিত্র অংকন করেছি, সেটি আসলেই বরিশাল বিভাগের ভিতর।
আর আমার বাড়ি খুলনা জেলায়।
তবে গল্পের প্লট এলাকাটি অনেক পরিচিত। আমরা ভাইয়েরা মিলে পিরোজপুর ঘুরতে যেতাম মটরবাইকে। সে উদ্দাম দিনগুলোতে আশেপাশের সকল এলাকাই ঘোরা হয়েছিল।
আপনিও ভালো থাকুন। আল্লাহ পাক আপনাকেও হায়াতে তাইয়্যেবা দান করুন-আমীন।
জাজাকাল্লাহু খাইর।
শুভেচ্ছা অনেক অনেক..
আপনি সময় দিতে পেরেছেন, এজন্য অনেক ধন্যবাদ।
শুভেচ্ছা রইলো অনেক অনেক।
জাজাকাল্লাহু খাইর।
আপনার জন্যও সুস্হ্যতা কামনা করছি।
আমি জানি না আপনি 'আপনারা' হয়েছেন কিনা। তবে জানলে 'আপনাদের' সুস্থতা কামনা করতাম।
দয়া করে জানাবেন।
ভালো থাকুন।
আপনাকেও ধন্যবাদ।
মন্তব্য করতে লগইন করুন