মায়া মহাপুরুষ ও আমি
লিখেছেন লিখেছেন মামুন ০৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৪, ০৬:০২:২১ সন্ধ্যা
কন্যা-জায়া-জননী... জননী-জায়া-কন্যা... নারীরই এক রূপ থেকে অন্য রূপে রুপান্তর বই অন্য কিছু নয়। এই রুপান্তরের সাথে একটা জিনিস ওতপ্রোতভাবে জড়িত থাকে। সেটি হচ্ছে মায়া! অফুরন্ত মায়ার এক 'পাওয়ারহাউস'।
আমার এই ছোট্ট বাবুটি ওর ছোট্ট হৃদয়ে আমার জন্য কল্পনাতীত মায়া নিয়ে বড় হচ্ছে। যা ওর রাফ এন্ড টাফ অ্যাটিচিউডের আড়াল থেকে সময়ে সময়ে উঁকি দিয়ে যায়। সে ছেলে হিসাবেই বেশী সময় আমার সাথে থাকতে পছন্দ করে।
একদিনের কথা মনে পড়ছে।
সেদিন ছিল 'সামার ভ্যাকেশন' এর শেষ দিন। স্কুল খোলার দিন। আমি সেই ফজরের আজানের সময়ে উঠে কোনাবাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা হবার প্রস্তুতি নিচ্ছি। কীভাবে যেন সে ও উঠে গেলো... আমার রেডি হয়ে নামাজ আদায় করতে করতেই সে তাঁর স্কুল পোষাকে রেডি। ওর মাকে আর ডাকলাম না। ব্যাগ গুছানো ছিল। মেইন গেইট খুলে বাসার দরোজার কাছে ফিরে এসে দেখি আমার জ্ঞানী বাবু দাঁড়িয়ে। গেটের চাবি ফিরিয়ে দিয়ে বললাম,
- পাপা, আসি আমি।
ওর চিবুকে একটু হাত বুলিয়ে আদর করলাম। সে আমাকে সালাম জানিয়ে শেষে বিদায় জানালো হাত নেড়ে- ' টা টা...' শব্দে!
আমি আমার হৃদয়ে এক অজানা ব্যাথা এবং এক রাশ ভালোবাসাকে সাথে নিয়ে ভোরের মিষ্টি বাতাসে বেরিয়ে এলাম। ব্যাথা এই বাবুটিকে পর্যাপ্ত সময় দিতে না পারার কারনে। সপ্তাহের ১৬৮ ঘন্টার ভিতরে মাত্র ৩০ ঘন্টা সে এই অক্ষম পাপার কাছ থেকে পায়। এর ভিতরেই সে চেষ্টা করে পাপার জন্য জমিয়ে রাখা বাকি দিনগুলোর অপুর্ণ পেন্ডিং মমতাগুলোকে এক্সিকিউট করার।
পায়ে পায়ে সামনের দিকে আগাই... পিছনে ফেলে আসা একটি কচি মুখের 'টা টা' শব্দটি বহুক্ষণ আমাকে তাড়িত করে... এই লেখাটি এখন অফিসে বসে লিখছি, এখনো গুঞ্জন এবং রেশ রয়েই গেছে।
মায়া বড্ড শক্ত জিনিস!!
হুমায়ুন আহমেদ যতদিন বেঁচে ছিলেন, আমি তার যে কোনো বই ও লিখা এক বসায় না পড়লে মনে শান্তি পেতাম না। এমনও সময় গেছে ইলেট্রিসিটি চলে গেছে, বই এর ভিতর এমন এক যায়গায় ডুবে আছি, সামনে আগাতে না পারলে ভেসে উঠতে হবে। মোমবাতি জ্বালিয়ে ওই অবস্থায়ও পড়া চালিয়ে গেছি। অফিসে কাজের ফাঁকে ফাঁকেও ই-বুকগুলো গিলেছি হাভাতের মতো।
তার মিসির আলী চরিত্রের থেকে আমার হিমু চরিত্রটি বেশী ভাল লাগত। এটা যে কেন সেটা কখনো বোঝার চেষ্টা করিনি। মিসির আলী বেশী ভারিক্কি অথবা জ্ঞানী বলে? কিংবা হিমুর ভিতরে এক সাধারণ যুবকের কিছু অসাধারণ কর্মকান্ড চোখে পড়ে বলে? নাকি রুপার মত এক লাবন্যময়ী নারী যে হিমুর জন্য এক সাগর ভালবাসা হৃদয়ে নিয়ে উন্মুখ হয়ে থাকে- যদিও সে জানে হিমু আসবে না- তার জন্য?
অনেক চিন্তা করলাম।
নাহ! হুমায়ুন আহমেদ এর লিখার জন্য আমার ভিতরে এক মায়া সৃষ্টি হয়েছে। যদিও হিমু চরিত্রের দ্বারা তিনি এই জীবনে সব কিছু থেকে 'মায়া' বা 'মোহ'কে কাটানোর শিক্ষা দিয়েছেন। আমিও সেই মায়া কাটানোর অনুশীলন করা শুরু করেছিলাম। আমার যেটা বেশি ভাল লাগতো, সেখানে আমি জোর করে খারাপ লাগাতাম... ভাল কোনো কিছু মনের ভিতরে দেখার ইচ্ছে জেগে উঠলেই সেখান থেকে ভেগে যেতাম... ফেসবুকে এসে লাইক দেয়াটাও বাদ দিয়েছিলাম... যাকে ভাললাগে তার সাথে ইচ্ছে করে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করতাম যাতে সে আমাকে ঘৃণা করে। এভাবে কাটাচ্ছিলাম আমার সময়।
কিন্তু একদিন হঠাৎ করে অনুভব করলাম, আমি যতই মায়াকে কাটাতে চাচ্ছি - মায়া আমাকে আরো বেশী করে জড়িয়ে নিচ্ছে... সর্বত্র। আমি আমার পরিবার থেকে সমাজ জীবনের সকল স্তরে মায়ার বাঁধনে ক্রমশ তলিয়ে যাচ্ছিলাম। প্রকৃতিও আমার চোখের ভিতরে এতোটা মায়া ঢেলে দিচ্ছে যে, আকাশ-মেঘ, পানি-বাতাস ও গাছপালা- যেদিকেই তাকাই আমি হারিয়ে যেতে থাকি... মায়ার গভীর থেকে গভীরতর স্তরে।
যেদিন কোনাবাড়ীতে স্ট্যান্ডার্ড গ্রুপের ১০ তলা গার্মেন্টসটিতে আগুন লাগে, সেদিন বন্ধু বিপ্লব সুদুর অস্ট্রেলিয়া থেকে আমাকে ফোন করে ঠিক আছি কিনা জানতে চায়... খুলনা থেকে আম্মা এই মুহুর্তে কোথায় আছি- ভাল আছি কিনা জানতে চান। মোবাইল বন্ধ থাকায় চাটগা থেকে বন্ধু মনসুর সে রাতে আমাকে পায় না... পরের দিন ফোনে পেয়ে আমি কেমন আছি জানতে চায়, সেইফে থাকার অনুরোধ করে।
এগুলো কি মায়া নয়?
... আমার বউ কাজের ফাঁকে ফাঁকে আমাকে ফোন করে বিভিন্ন কথা জিজ্ঞেস করে রেখে দেবার আগ মুহুর্তে জিজ্ঞেস করে, ' কেমন আছ তুমি?!' আমার চারপাশে কলিগদের দ্বারা বেষ্টিত এই আমি একটু হেসে রেখে দেই। বউ সেই হাসিটা কি দেখতে পায়? দু'পাশে দুইজন অদৃশ্য মানুষ তাদের মায়াকে দেখাতে না পারলেও মায়ার অস্তিত্ত কে অস্বীকারও করতে পারে না। আমি আমার প্রিয়তমাকে কেমন আছি এই কথাটুকু ও ভালভাবে বলার সঠিক সময়টুকু পাই না।
এই অনুভুতিটা ও কি মায়া নয়?
কোনো এক যায়গা থেকে কেউ একজন যখন আমাকে বলে, 'সাবধানে থেকো... বউ দিবসে সাভারে দেখেশুনে যেও' - আমি অদৃশ্য এক মায়ার জালে আটক হই।
এই সবার মায়াকে দূরে ঠেলে দিলেই কি আমি মহাপুরুষ হয়ে যাবো?
কি লাভ এমন মহাপুরুষ হয়ে, যদি মায়ায়ই সবাইকে জড়াতে না পারি? ... কিংবা নিজেই ওদের মায়ায় জড়িয়ে থাকতে না পারি!
মহাপুরুষের কাজটা কি? সবাইকে মায়ায় জড়িয়ে রাখা নয় কি? মায়ায় জড়িয়ে নিয়েই মায়া কাটানো শিক্ষা দেয়া।
এই জগতটাই কি একটা মায়া নয়?
পথিকের পথ চলাতেই আনন্দ। আমি কাউকে পথে পেলে আনন্দ পাই। একা একা পথ চলাতে আমি আনন্দ পাই না। আর কারো হাতে হাত রেখে (অবশ্যই সে বিপরীত লিঙ্গের এবং ইসলামের দৃষ্টিতে জায়েজও হতে হবে) চলাতে তো কোনো কষ্টই নেই। এমন কেউ নিজের অর্ধাঙ্গিনী ছাড়া আর কে হতে পারে?
নারীর মন নাকি শত সহস্র বছরের সাধনার ধন।
আমাদের গড় আয়ু কত হবে? ৫৫/৬০/৬৫...
তাই এতো সময় নষ্ট করে মনের খোঁজ নিতে ইচ্ছে হল না।
অনেক চিন্তা করে ওদের হাত ধরে পথটা পাড়ি দেবার কথা ভাবলাম।
আমার আকদ এর ৬ মাস পরে আমার বউকে আমার হাতে পারমানেন্ট ভাবে তুলে দেয়া হয়। এই ৬ মাস আমি কি কষ্টে কাটিয়েছি, সেটা কারো জানার দরকার নাই। তবে এই সময়ের ভিতরে ওর চিটাগং কলেজের পিছনের গেইটে, প্যারেড গ্রাউন্ডের দেয়ালের পাশে কিংবা আগ্রাবাদ সিজিএস কলোনির ওদের বাসার আশেপাশে (যখন আমার শ্বশুর অফিসে থাকেন তখন আর কি), রিক্সায় করে হালিশহর থেকে সেই পতেঙ্গার ওদিকে বোট ক্লাব পর্যন্ত সময়টার প্রতিটি সুযোগ-সন্ধানী মুহুর্তগুলোতে আমি ওর হাত ধরে থাকার সুযোগ পেতাম!
তখন আমার কাছে ওর হাতের একটা আঙ্গুলের সাথে আমার হাতের ছোঁয়াকে অনেক বিরাট পাওয়া মনে হতো! আমি আমার শাহাদত অঙ্গুলি দিয়ে ওর সেই আঙ্গুলটার সাথে খেলা করতাম। আর দিন শেষে বাসায় এসে আত্মতৃপ্তির ঢেঁকুর তুলতাম। মনে হতো বিশ্বজয় করে এসেছি।
এরপর কীভাবে যেন ১৪ টি বছর কেটে গেল।
এখন খুব অল্প সময়ই ওর সাথে থাকতে পারি। বৃহস্পতিবার রাতটা যেতে না যেতেই শেষ হয়ে যায়। শুক্রবারটা ঘোড়ার পিঠে করে চলে গিয়ে রাত ৪:৩০ এ জেগে উঠার অ্যালার্ম বাজিয়ে আমাকে কোনাবাড়ী পাঠিয়ে দেয়। পৌনঃপুনিক এভাবে সপ্তাহগুলো কেটে যাচ্ছে।
হাত ধরার সুযোগটা এখনো এক আধ বার এসে যায়।
যখন মেকুরাণীকে নিয়ে জাহাঙ্গীরনগর সংলগ্ন আমার বাসা থেকে সাভারে বা অন্য কোথায়ও বের হই, তখন এসে যায়। বিশমাইল গেট বা প্রান্তিক গেইট দিয়ে দু'জন যখন রাস্তাটা পার হতে চাই, পাশাপাশি দাঁড়ানো থাকা অবস্থায়ই মেকুরানী আমার হাত পরম নির্ভরতায় ধরে ফেলে।
আহ! কি শান্তি। আমাকে কিছু বলা লাগে না, কিংবা সে তাকিয়েও দেখে না আমার হাতটা কোথায় রয়েছে। জাস্ট একবারেই ধরে ফেলে...
দুজনে একসাথে রাস্তা পার হই।
এতোগুলো বছর তো এভাবেই পেরিয়ে এলাম!
এটা কি মায়া নয়?
আসলে মায়ায় মায়ায় জড়ানো এই পুরো জগৎ! সেখানে মহান আল্লাহ পাক প্রতিটি বস্তুতেই মায়া ছড়িয়ে দিয়েছেন। তাইতো এই জগৎ এতো মায়াময়- মধুর লাগে।
আমি একজন মহাপুরুষ না হতে চেয়ে একজন সাধারণ মানুষ হতে চেয়েছি, শুধুমাত্র এই মায়ায় জড়িয়ে থাকার জন্য।
[ছবিগুলো আমার ছোট মেয়ে লাবিবা মামুন খান এর। সবার কাছে ওর জন্য দোয়ার দরখাস্ত রইলো। আর ব্লগে এমন একটি ব্যক্তিগত পোষ্ট দেবার জন্যও কিছুটা বিব্রত হচ্ছি। তবুও লেখাটি মাথায় আসাতে না দিয়েও পারলাম না।]
বিষয়: বিবিধ
৯৮৮ বার পঠিত, ১২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
ওহ হে!
১৯৮৪ সালে হুমায়ুন আহমদের লিখা অমানুষ বইটি আমি পড়েছিলাম। সেবারই প্রথম হুমায়ুনের আহমদের নাম জানতে পারি। লেখাটি পড়ে আমি আবিভূত হয়েছিলাম। পরে যখন দেখলাম হুমায়ুন সেটি একটি বিদেশী সাহিত্য থেকে নকল করেছেন, বড় মনোক্ষুন্ন হলাম।
আরো পরে যখন দেখলাম হুমায়ুন শুরুতে কারো বই নকল করলেও নতুন কিছু লেখার বেলায় তার সমকক্ষ কেউ নাই। তিনি নিজেই তার পরিচয় তখন সাহিত্যিক হিসেবে শ্রদ্ধা লাগত।
তাই আপনার লিখনীতে কিছুটা হিমুর ছায়া আছে, প্রভাব আছে। অনেক ধন্যবাদ
হ্যা, অমানুষ বইটি আমিও পড়েছি। এই বিদেশী কাহিনীটি নিতে কাজী আনোয়ার হোসেন তার মাসুদ রানা সিরিজের একটি বইও লিখেছিলেন " অগ্নিপুরুষ" নাম দিয়ে।
আমি লেখালিখির একেবারে প্রথম স্টেজটিতে রয়েছি, তাই আমার ভালোলাগার লেখকদের লিখনির ছাপ মনের গভির কোনে রয়ে গেছে, সেগুলো আমার লেখার পরতে পরতে উঠে আসতে চায়। তবে নিজের স্বকীয়তা তুলে ধরার চেষ্টা করব ইনশা আল্লাহ।
আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
জাজাকাল্লাহু খাইরান।
হ্যা, আমার 'উনি' আমার লেখাগুলো প্রতি বৃহস্পতিবারে পড়ে থাকেন। আমিওই নিজে পড়ে শুনাই। তিনিও একজন এবং বলতে গেলে আমার সর্ব প্রথম পাঠক।
ধন্যবাদ আপনাকে।
জাজাকাল্লাহু খাইরান
লাবিবাকে আপনার ভালবাসা এবং শুভেচ্ছা আজ জানিয়ে দিবো ইনশা আল্লাহ।
ভালো থাকবেন।
অনেক শুভেচ্ছা।
িকামনা করছি- আগামীতে আপনার সচ্ছ সুন্দর সাহিত্য মান সম্পন্ন লেখনি দিয়ে দেশ-জাতি এবং সমাজ উককৃত হোক।
আপনি জানেন কি, আমি আপনার একজন গুণমুগ্ধ পাঠক?
আপনার দোয়া আল্লাহ পাক কবুল করুন, আমীন।
অনেক অনেক শুভেচ্ছা আপনার জন্য।
লাবিবার জন্য আপনার শুভেচ্ছা পৌঁছে দিবো ইনশা আল্লাহ।
জাজাকাল্লাহু খাইরান।
আমরা কেউই হারাবো না ইনশা আল্লাহ।
ভালো থাকবেন।
মন্তব্য করতে লগইন করুন