কুরবানি এবং অ্যানিম্যাল রাইটসঃ অযোক্তিক প্রশ্নের যোক্তিক উত্তর
লিখেছেন লিখেছেন চিলেকোঠার সেপাই ১১ সেপ্টেম্বর, ২০১৬, ০১:২৬:২৫ রাত

কুরবানি এবং অ্যানিম্যাল রাইটসঃ অযোক্তিক প্রশ্নের যোক্তিক উত্তর
মুসলিমদের দ্বিতীয় প্রধান ধর্মীয় উৎসব ঈদ-উল আযহা বা কুরবানির ঈদ। ইদানিং এই কুরবানি নিয়ে এখন কিছু প্রশ্ন উঠছে। সেগুলো কতটা যোক্তিক বা কতটা অযোক্তিক ?! আসুন দেখা যাক।
>আমরা শুধু মাত্র খাবার জন্য এভাবে লক্ষ লক্ষ পশুকে নির্মম ভাবে হত্যা করবো?!
এই যুক্তিটা ৫০ বছর আগে ঠিক ছিল। এখন আধুনিক বিজ্ঞান আমাদের বলে, গাছ এবং লতা, পাতারও জীবন আছে। তারা ব্যাথা পায়। হাসি বা কান্নাও করে। একজন বন কর্মকর্তার কাছে শুনেছিলাম, একবার এক বিদেশি বিশেষজ্ঞ তাদের বাগান করার উপর একটি ক্লাসে বলেছিলেন, “বাগান করার সময় বাগানের পাশ দিয়ে হাঁটবেন, গাছ গুলোর মরা পাতা হাত দিয়ে ফেলবেন, গাঁয়ে হাত রাখবেন কারন গাছেরও অনুভূতি আছে। এমন করলে গাছেরা তারাতারি বাড়ে। তাদের এই ব্যাথা, হাসি, কান্না আমাদের শ্রবন ক্ষমতার বাইরে। এখন আপনি শুনতে পান না এজন্য হত্যা করতে পারবেন এটা- কোনভাবেই যোক্তিকও না মানবিকও না। এটা পুরোপুরি অনৈতিক চিন্তা। অর্থাৎ যে নিরামিষাসিগন প্রচার করেন জিব হত্যা মহাপাপ তারা হয় মূর্খ না হলে প্রতারক। মূর্খ বলার কারন তারা জানে না যে গাছ, শাক-সজবিরও জিবন এবং অনুভূতি আছে। আর যদি জেনেও এটা প্রচার করে তারা নিঃসন্দেহে প্রতারক। তবে একটা মারাত্নক যুক্তি শুনেছিলাম, গাছের ২ টা ইন্দ্রিয় কম। তাই গাছ হত্যা প্রাণি হত্যা থেকে ছোট অপরাধ। এটা একটা কুতর্ক। ধরেন আপনার ছোট ভাই কানে শোনে না, চোখেও দেখে না। কেউ তাকে হত্যা করলে কি তার শাস্তি কম হবে? আল্লাহ পবিত্র কুরআনের ১৬ নম্বর সূরা, সূরা নাহলের ৫-৮ আয়াতে বলেন,
"তিনি পশু সৃষ্টি করেছেন। তাদের মধ্যে রয়েছে তোমাদের জন্য পোশাক, খাদ্য এবং অন্যান্য নানাবিধ উপকারিতাও। তাদের মধ্যে রয়েছে তোমাদের জন্য সৌন্দর্য যখন সকালে তোমরা তাদেরকে চারণভূমিতে পাঠাও এবং সন্ধ্যায় তাদেরকে ফিরিয়ে আনো। তারা তোমাদের জন্য বোঝা বহন করে এমন সব জায়গায় নিয়ে যায় যেখানে তোমরা কঠোর প্রাণান্ত পরিশ্রম না করে পৌঁছতে পারো না। আসলে তোমার রব বড়ই স্নেহশীল ও করুণাময়। তোমাদের আরোহণের জন্যে এবং শোভার জন্যে তিনি ঘোড়া, খচ্চর ও গাধা সৃষ্টি করেছেন। আর তিনি এমন জিনিস সৃষ্টি করেছেন [মানুষের উপকারের জন্য] যা তোমরা জান না”।
অর্থাৎ ইসলাম মাংস এবং সবজি উভয় খাবারের অনুমতি দেয়। তবে জবেহ যথাসম্ভব মানবিক হতে হবে। এ ব্যাপারে ইসলামে একটি বিস্তারিত অধ্যায় রয়েছে। আর গাছের ব্যাপারে রাসুলুল্লাহ সাঃ বলেন “তোমরা প্রয়োজনে গাছ কাটো তবে বিনা প্রায়োজনে গাছের একটি পাতাও ছিঁড়বে না”
আসুন শরীরিক দিক থেকে দেখার চেষ্টা করি, মাংসাশি প্রানিদের দাঁত সুচালো এবং পাকস্থলি ও হজম প্রণালি শুধুমাত্র মাংস জাতীয় খাবারই প্রক্রিয়া করতে পারে। অন্যদিকে তৃণভোজির প্রানির দাঁত সমান শুধুমাত্র পাকস্থলি ও হজম প্রণালি শুধুমাত্র শাকসবজি জাতীয় খাবারই প্রক্রিয়া করতে পারে। কিছু বছর আগে অ্যামেরিকাতে গরুকে ভেড়ার মাংস খাওয়ানোর চেষ্টা করা হয়, তার ফলাফল ছিল ভয়াবহ। ম্যাটকাউ রোগের প্রাদুর্ভাব হয়। আমাদের মানুষের দাঁত দুই ধরনেরই আছে। সুচালো আবার সমান। আমাদের পাকস্থলি ও হজম প্রণালি শাকসবজি এবং মাংস উভয় খাবারই প্রক্রিয়া করতে পারে। এখন আমাদের সৃষ্টিকর্তা {নাস্তিকরা ভাবুন প্রকৃতি} যদি চাইতেন আমরা শুধু শাকসবজি খাবো তাহলে আমাদের এমন দাঁত বা পাকস্থলি দিবেন কেন?
>প্রতিটা প্রানিরই অনুভূতি আছে। এত নিষ্ঠুর ভাবে জবেহ করছি? আবার আমরা এক প্রাণীর সামনে অন্য একটি প্রাণীকে হত্যা করছি, তারা কেমন অনুভব করে?
ইসলাম অনুযায়ি জবেহ করার সাধারন নিয়মগুলো হচ্ছেঃ
• একটি ধারালো ছুরি একক একটানা পিছনে গতির সাথে প্রাণীর শ্বাসনালী, অন্ননালী এবং গলার পাশের দুটি রক্তনালীসমূহ কেটে ফেলতে হবে।
• স্পাইনাল কড এ কোন রুপ আঘাত করা যাবে না।
• সমস্ত রক্ত প্রবাহিত হতে দিতে হবে। এভাবে জবেহ করলে পশুর স্নায়ুতে আঘাত লাগে না এবং বেশি ব্যাথা পায় না। রক্ত বের হওয়ার সময় পশু ছটফট করে কারন রক্ত শরীর থেকে বের হয়ে যাচ্ছে এজন্য, ব্যাথার জন্য না।
এছাড়া পশুর সামনে ছুরি ধার দেওয়া কিংবা একপশুর সামনে অন্যপশুকে জবেহ না করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আমি জানি এই নিয়মটা বাংলাদেশে সেভাবে অনুসরণ করা হয় না। এটা মুসলমানদের সমস্যা। ইসলামের না।
ইসলাম মাংস খাওয়ার অনুমতি দেওয়ার পাশাপাশি পশুপাখির সাথে মানবিক ব্যবহার নির্দেশও দিয়েছে। প্রাচীন আরবে পশু-পাখিদের প্রতি চরম অমানবিক আচরণ করা হত। জীবিত উটের কুঁজ, মেষের পাছার বাড়তি অংশ কেটে খেয়ে ফেলা হত। কেউ মারা গেলে তার কবরের ওপর জীবিত একটা উট বেঁধে রাখা হত। উটটি সেখানে অনাহারে ধুঁকে ধুঁকে মারা যেত। তাছাড়াও আরবরা কিছু দিন পর পরই উট জবাইয়ের প্রতিযোগিতা দিত। রাসুলুল্লাহ সাঃ এসব অমানবিক কুপ্রথা উচ্ছেদ করেন। জীবনের প্রতি হুমকি না হলে তিনি অকারণে কিট পতঙ্গও হত্যা করতে নিষেধ করেছেন। হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাঃ বলেন করেন, ‘দয়া ও অনুগ্রহকারিদের প্রতি দয়াময় রহমান অনুগ্রহ করে থাকেন। অতএব তোমরা জমিনবাসীর ওপর দয়া কর আসমানবাসীরা তোমাদের ওপর দয়া করবেন।’ (আবু দাউদ)
একদিন মদিনা দিয়ে যাওয়ার সময় মহানবি সাঃ দেখেন একটি উটকে ঠিকমত না খেতে না দেওয়ায় জন্য কষ্ট পাচ্ছে। তখন তিনি বলেন, “আল্লাহকে ভয় করো সে সমস্ত প্রানির সাথে আচরণের সময় যারা কথা বলতে পারে না। যদি তুমি তাদের পরিবহনে লাগাতে চাও তাহলে তাকে সেভাবে লালন করো। যদি মাংস খেতে চাও তাহলেও তাকে সেভাবে লালন করো। (আবু দাউদ)
মহানবি সাঃ অন্য এক প্রসঙ্গে বলেন, ‘এক মহিলাকে একটি বিড়ালের কারণে আজাব দেয়া হয়েছিল। কারণ কোনো প্রকার খাবার না দিয়ে মহিলা বিড়ালটিকে বেঁধে রেখেছিল। তাকে সে কোনো খাবার এমনকি পানিও দেয়নি। ছেড়ে দিলে সে জমিনে পোকামাকড় খেয়ে বেঁচে থাকতে পারত। কিন্তু বিড়ালটি মারা গেল।
>আমরা শিশুদের সামনে প্রাণীদের জবেহ করছি। সেটা কতটা উচিত?
শিশুদের জবেহের সামনে রাখতে হবে এমন কোন বিধান ইসলামে নেই।
>আমরা কুরবানির সময় খোলা জায়গা কুরবানি করছি, রক্ত বা পাকস্থলী পরিস্কারের জন্য যথেষ্ট ব্যবস্থা করছি না। এতে দূষিত হচ্ছে পরিবেশ। এই ব্যাপারটি কিভাবে দেখেন?!
ইসলামে একটি খুবই প্রচলিত কথা হল, পরিস্কার পরিচ্ছনতা ঈমানের অর্ধেক। পরিস্কার পরিচ্ছনতা ব্যতীত বেশির ভাগ ইবাদতই কবুল হয় না। সুতরাং যারা কুরবানি দেবে এটা তাদের একটা গুরুত্বপূর্ণ দ্বায়িত্ব পরিবেশ পরিস্কার পরিচ্ছনতা রাখা।
এবার আসুন কুরবানির সামাজিক গুরুত্ব দেখি...
এ বছর ট্যানারি ব্যবসায়ী সংগঠনগুলো কোরবানির ঈদে প্রায় ৭০-৮০ হাজার কোটি টাকার পশুর চামড়া সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছেন। চামড়ার পুরো টাকাটাই বাধ্যতামূলক ভাবে গরীবদের মাঝে দান করা হয়। বাংলাদেশ এ আর কোন দিন সন্মিলিত ভাবে এত্ত টাকা দান করা হয় না। এছাড়া ধর্মীয় নিয়ম অনুযায়ি যারা কুরবানি দেয় তারা বাধ্যতামূলক ভাবে মোট মাংসের তিন ভাগের একভাগ গরীবদের দান করেন। বাজার মূল্যের হিসাব করলে এর দাম হবে কয়েক শত হাজার কোটি টাকা। এ ছাড়াও এ দিন কিছুটা অবস্থা সম্পন্ন সবার বাড়ির দরজা গরিবদের জন্য খোলা থাকে। মাংস এবং মিষ্টান্ন দিয়ে আপ্যায়ন করতে সবাই চেষ্টা করে। আল জাজিরার একটি রিপোর্ট অনুযায়ি দেশের শতকরা ১৬.৩ ভাগ মানুষ ৩ বেলা খাবার পায় না অর্থাৎ দেড় কোটিরও বেশি মানুষ চরম দারিদ্র সীমায় বাস করে। যদি সরকার বা ইসলামি ফাউন্ডেশন এই চামড়ার সব টাকা সংগ্রহ করে গঠনমূলকভাবে এই দেড় কোটি মানুষের মাঝে বিতরণ করে তাহলে খুব বেশি দিন লাগবে না এদের পরিমাণ সহনীয় মাত্রায় কমাতে। এইদিন মানুষ কুরবানির মাংসের একটা অংশ আত্নীয় স্বজনদেরকে এবং প্রতিবেশিকে দেয়। এতে সামাজিক সম্পর্ক আরও দৃঢ় হয়। যে সব পরিবারে সবাই ব্যস্ত থাকে তারাও কোরবানির পশু নিয়ে আলোচনা করে। পারিবারিক সম্পর্ক মজবুত হয়। ঈদ-উল আযহা ধর্মীয় অনুষ্ঠান তবে আমার মনে হয় এর সামাজিক গুরুত্ব এতটাই বেশি যে আর যত ধর্মীয় বা সামাজিক উৎসব আছে সব গুলোকে এক করলেও তারা সামাজিক গুরুত্বের ক্ষেত্রে ঈদ-উল আযহার ধারের কাছেও আসবে না।
বিষয়: বিবিধ
৯৯৮ বার পঠিত, ৪ টি মন্তব্য






































পাঠকের মন্তব্য:
মাশা আল্লাহ ! ভাল যুক্তিই দেখিয়েছেন ।
যারা মুসলমানদের কুরবানি নিয়ে কটাক্ষ করে হিসেব করলে দেখা যাবে যে তারাই মানুষ হত্যায় মেতে থাকে সারা বছর ।
তাদের কাছে জিজ্ঞাসা - তাদের কাছে কোনটা বেশী পীড়াদায়ক ?
এক লাদেন এর নামে , এক সাদ্দামের নামে , তালেবান , আল কায়েদা ,নাইন ইলেভেন , আইএস ধরার নামে তারা যে লাখ লাখ নিরীহ মানুষদের মেরে ফেলতেছে সেটার দিকে কোন খেয়ালই নেই ।
কয়েকদিন আগে সামুতেও দেখেছি একজন পোস্ট দিয়েছেন যে , ডেনমার্কের কোন এক গোষ্ঠী নাকি নিরীহ ডলফিল/তিমিকে হত্যার উৎসব করে । খাওয়ার জন্য না ।
নেপালেও এরকম কিছু হয় মহিষ হত্যার নামে ।
যতই প্রানীর জন্য লাফালাফি করুক না কেন এদের পাতে দেখবেন নন-ভেজ রেসিপিই ।
(সামুতে আপনার পোস্টে এক ইসলামবিদ্বেষী ভালই লাফালাফি করতেছে - আশা করি সুন্দর একটা জবাব দিয়ে তাকে লাফালাফির কষ্ট থেকে রেহাই পেতে সাহায্য করবেন )
মন্তব্য করতে লগইন করুন