ছোট গল্প : লেখকের অভিশপ্ত প্রতিচ্ছবি
লিখেছেন লিখেছেন আমীর আজম ২৫ জুলাই, ২০১৫, ০৪:১৫:০৭ বিকাল
তমালের মনটা আজকে খুব খারাপ। খারাপ হওয়ার কারণ তার নিজের না। মন খারাপ অন্য কারণে। তার প্রিয় লেখকের মা মারা গেছে গতকাল । টেলিভিশনের পর্দায় দেখেছে।
অনেক লোকের সমাগম হয়েছিল। শেষ শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য । পাশে দাড়িয়ে ছিল লেখক। কি রকম জানি বিমর্ষ আর অসহায় লাগছিল তাকে।
এই বিমর্ষ আর অসহায় ভাবটাই তমালের মনকে নাড়া দেয়। মনের সাথে কি জানি মেলাতে চেষ্টা করে। কিন্তু কিছুই মাথায় আসছে না। সবকিছু কেন জানি এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে।
তাই মনটা সেই তখন থেকেই খারাপ হয়ে আছে। এর একটা সমাধান তাকে বের করতেই হবে।
.........................................
অনেক ছোটবেলা থেকেই লেখকের ভক্ত সে। যেনতেন ভক্ত না। একদম গভীর ভক্ত। এমন কোন বই নাই যেগুলো পড়ে নাই। উপন্যাস, সায়েন্স ফিকশন, ছোটদের গল্প সমগ্র সবগুলো বই তার মাথার মধ্যে গিজগিজ করছে।
এমন অনেক বই আছে যেগুলো দশ - পনেরো বার করে পড়া হয়েছে। মোটামুটি ছোটখাটো ধরনের গবেষক হয়ে গেছে সে লেখক সম্পর্কে।
লেখকের চেহারাটা যখন তার মনে পর্দায় অনুভব করে তখন সেটা দেখতে ঠিক সুপারহিরোদের মত লাগে।
লেখককে অনেক সম্মান আর শ্রদ্ধা করে তমাল। সে বিশ্বাস করে এই লোকটাই একদিন দেশটাকে পরিবর্তন করে ফেলবে। করবে তার লেখনির মাধ্যমে।
লেখকের বই পড়ে তমালের মনে অনেক কিছুই বদ্ধমূল হয়েছে। যেমন, সৃষ্টিকর্তা বলে কিছু নেই, এই দুনিয়ার জীবনই সব, সবচেয়ে বড় ধর্ম হচ্ছে মানববধর্ম, প্রকৃতির সবকিছু স্বাভাবিকভাবেই ঘটছে। এর কোন নিয়ন্ত্রণ কর্তা নেই। আরো কত কিছুই যে তার মনে গেথে গেছে তার ইয়ত্তা নেই।
...........................................
কিন্তু ইদানিং কেন জানি কোন কিছুই সঠিকভাবে মেলাতে পারে না সে। শুধু মনে হয় কোথায় জানি একটা গ্যাপ থেকে যাচ্ছে। কোথায় জানি রয়ে যাচ্ছে অপূর্ণতা। ভাবনাগুলো এলোমেলো হয়ে আসে। খন্ড খন্ড ভাবে মনের পর্দায় ভাসে কিছু যৌক্তিক চিন্তা।
স্কুল কলেজে বিজ্ঞান পড়ার সময় জেনেছিল মানুষের শ্রাব্যতার সীমা নির্দিষ্ট। 20 - 20000 Hz কম্পাঙ্ক। এর বেশীও শুনতে পারে না। কমও শুনতে পারে না। তাহলে পৃথিবীতে হয়তো অনেক বড় বড় কিংবা ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র শব্দ হচ্ছে যেগুলো মানুষের অগোচরেই থেকে যাচ্ছে।
আবার মানুষের দৃষ্টির সীমাও তো নির্দিষ্ট। খুবই ক্ষুদ্র জিনিস যেমন দেখতে পারে না তেমনি হয়তো অনেক বড় বড় জিনিসও দেখতে পায় না। হতে পারে মানুষের ত্বকের অনুভূতিও নির্দিষ্ট। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জীবানুর অস্তিত্ব যেমন ত্বক বুঝতে পারে না। তেমনি অনেক বিশাল বিশাল বস্তুর উপস্থিতিও আমাদের ত্বক অনুভব করতে সক্ষম নয়।
তাহলে প্রতিনিয়ত আমরা হয়তো এমন কিছু বিশাল বিশাল প্রাণীর সাথে ধাক্কা খাচ্ছি যার শব্দ না আমাদের কান শুনতে পাচ্ছে, যাদেরকে না আমরা দেখতে পাচ্ছি, যাদেরকে না আমাদের ত্বক অনুভব করতে পারছে।
তাহলে কি মানুষের ক্ষমতা সসীম। একটা নির্দিষ্ট গন্ডির বাইরে মানুষের পক্ষে কোন কিছুই বোঝা সম্ভব নয়।
তার মানে তার প্রিয় লেখকটিরও ক্ষমতা সসীম। তিনি যা কিছু লেখেন বলেন সবকিছু বিশ্বাসযোগ্য নয়।
আর মেডিকেলে ভর্তি হওয়ার পর যতই দেখছে ততই আশ্চর্য হচ্ছে আরো। বারবার মনে হচ্ছে -
মানুষের মৃত্যু বরণ করাটাই তো স্বাভাবিক। বরং অস্বাভাবিক হচ্ছে মানুষের বেচে থাকাটা।
হাসপাতালে আসলেই বোঝা যায় প্রচন্ড প্রতাপশালী মানুষ আসলেই কতো অসহায়।
পথে - ঘাটে, এখানে - সেখানে মানুষের লাশ পড়ে থাকবে। রাস্তার ডাস্টবিন, ময়লার স্তুপে জমা হবে মৃতদেহগুলো। জীবিত মানুষগুলো দেখেও না দেখার ভান করে চলে যাবে। এটাই হওয়া উচিৎ ছিল আমাদের স্বাভাবিক চিত্র।
শরীরে যে কি পরিমাণ রহস্য নিয়ে জীবিত ঘুরে বেড়াচ্ছি, ভাবতেই অবাক লাগে।
বুঝতে পারে সে এটা কোন অটোমেটিক সিস্টেম নয়। এটা প্রকৃতির আপনাআপনি হয়ে যাওয়া কোন বিষয় নয়। There is really someone Very Very Very Special behind our lives. Yes, He is none but our ALMIGHTY CREATOR.
তাই হাজার চেষ্টা করেও সে আর নিজেকে নাস্তিক ভাবতে পারছেনা।
.........................................
আজকে লেখকের মায়ের মৃত্যুর পর তার এই হতাশ চেহারা দেখে সত্যিই অবাক হয়ে গেছে তমাল। এটাই তো শেষ পরিনতি। একদিন সবাইকে এই পরিনতি ভোগ করতেই হবে।
শেষ মুহুর্তে যে সুপারহিরো হবে সেই আসল সুপারহিরো।
কিছুদিন আগে এক দেশদ্রোহী ব্যাক্তির মৃত্যু হয়েছিল। এ ব্যাক্তি যে দেশদ্রোহী ছিল সেটা লেখকের লেখা পড়েই জানতে পেরেছিল সে। সেদিন তার জানাজার নামাজেও অনেক লোক সমাগম হয়েছিল। সেদিন জানাজার নামাজ পড়িয়েছিল তারই ছেলে। সে কি বক্তব্য তার। দেখে মনে হয়েছিল মৃত্যু ভয় হীন আত্মতৃপ্তিতে ভরপুর এক যুবক।
সে ভেবেছিল আজকেও তার প্রিয় লেখক মায়ের জানাজা পড়াবে। কিন্তু একি চেহারা দেখছে সে। দেখে মনে হচ্ছে মৃত্যু ভয়ে ভীত এক জরাক্লীষ্ট মানব শরীর।
এতদিন রত্নগর্ভা জননী ভেবে এসেছিল সে। কিন্তু জননী এ কি ধরনের রত্ন গর্ভে ধারণ করল। তার রত্ন তার জানাজা পড়াতেই অক্ষম।
বুঝতে পারে তমাল। এতদিন সে ভুল পথে এগিয়েছে। আর তাকে ভুল পথে নিয়ে যাওয়ার জন্যে দায়ী এই লেখকই। সহজ সরল লেখনীর মাধ্যমে তাকে স্লো পয়জনিং করা হয়েছে । বিভ্রান্ত করা হয়েছে সঠিক পথ চিনতে, সঠিক লোক চিনতে।
লেখক ক্ষমা করতে পারবে কি না ভাবছে তমাল। মনে মনে অভিশাপ দিতে চাচ্ছে। কিন্তু পারছে না। এতদিনের গভীর শ্রদ্ধাবোধ।
ভাবতে পারে না আর সে । চোখ দুটো বুজে আসে আপনাআপনি। মনের পর্দায় দেখে লেখকের সুপারহিরো ছবিটা ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছে। সেখানে জায়গা করে নিচ্ছে হতাশাগ্রস্থ অভিশপ্ত এক লেখকের প্রতিচ্ছবি।
বিষয়: বিবিধ
১২১২ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
আলহামদুল্লিলাহ। সবের মর্ধ্যে ভাল লেগেছে।
মন্তব্য করতে লগইন করুন