মুষ্টির চালে মঙ্গা জয়
লিখেছেন লিখেছেন এফ শাহজাহান ০৭ জুন, ২০১৩, ০৩:২২:৩৬ দুপুর
রান্নার হাঁড়ি থেকে বাঁচানো এক মুঠো চাল সঞ্চয় করে একটি পরিবার ও সমাজের চিত্র পাল্টে দিতে সক্ষম হচ্ছেন উত্তরাঞ্চলের অনেক অভাবী এলাকার দরিদ্র মানুষ। দারিদ্রপীড়িত এসব এলাকার নারীরা ঐক্যবদ্ধভাবে মুষ্টির চাল সংগ্রহ করে গড়ে তুলেছেন কমিউনিটি ফুডব্যাংক। চরম অভাবের সময় যখন ঘরে রান্না করার মত চাল থাকে না, তখন এই ফুডব্যাংকের চাল নিয়ে স্বাচ্ছন্দে দিন পার করেন তারা। ফুডব্যাংকের মাধ্যমে একদিকে যেমন পারিবিারিক খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করেছেন তেমনি মঙ্গার সময় কর্মহীন দুর্দিনে সংসারের খরচ চালাতেও আর কারো কাছে হাত পাততে হচ্ছে না। সন্তানের লেখাপড়ার খরচ থেকে শুরু করে জীবন মানের উন্নয়নে পাশে দাঁড়াচ্ছে ফুডব্যাংক। অভাবী সংসারে এনে দিচ্ছে স্বচ্ছলতা। বেঁচে থাকার নতুন স্বপ্ন যোগাচ্ছে স্বপ্নহীন খেটে খাওয়া মানুষগুলোকে।
যে সময় চড়াসুদে দাঁদন চক্রে বন্ধী হতে হতো অথবা সস্তায় আগাম শ্রম বিক্রি করে বেঁচে থাকতে হতো, সেসময় ফুডব্যাংক তাদের জীবন ধারাই পাল্টে দিয়েছে। এখন আর দাঁদন ব্যবসায়ীরা তাদের ধারে কাছেই ভিড়তে পারছেনা।
নওগাঁর পতœীতলা উপজেলার পতœীতলা ইউনিয়নের প্রত্যন্ত বুজরুক মামুদপুর গ্রামের উপজাতি নারীদের মুষ্টি চাল সমিতি বা কমিউনিটি ফুডব্যাংক এমনই এক উজ্জল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। তাদের সম্প্রদায়ের মধ্যে ঠেকিয়েছে মহাজনী দাদন ব্যবসা। এখন আর দাদন ব্যবসায়ীদের নিকট হাত পাতে হয় না তাদের । চরম অভাবী মানুষগুলোর সংসারে এনছে স্বচ্ছলতা।
ফুডব্যাংকের প্রথম উদ্যোক্তা জানান, গ্রাম বাংলার প্রান্তিক মুসলমানরা সমিতির মাধ্যমে সারা বছর সঞ্চয়ের টাকা দিয়ে বিভিন্ন ধর্মীয় ও সামাজিক উৎসবে গরু-ছাগল ক্রয় করে মাংস ও আনন্দ ভাগাগাভি করতো। তাদের এই পুরাতন রীতি থেকেই কমিউনিটি ফুডব্যাংক মডেলটি গ্রহণ করা হয়েছে ।
পতœীতলার কমিউনিটি ফুডব্যাংক সমিতির সভাপতি শুনিবালা উরাও জানান, এ অঞ্চলের প্রায় সকল উপজাতিই দিনমজুর। কৃষি ভিত্তিক এলাকায় বছরের বৈশাখ-জৈষ্ঠ্য ও আশ্বিন-কার্তিক মাসে মাঠে তেমন কোন কাজ থাকে না। এ সময় তারা গ্রাম্য দাদন ব্যবসায়ী অথবা গৃহস্থদের কাছে আগাম শ্রম বিক্রয় করতে বাধ্য হতেন। অনেকেই চড়াসুদে দাদন নিয়ে সংসার চালাতেন। এই দাদনের শর্ত হলো এক হাজার টাকা নিলে তিন মাস পর দেড় হাজার টাকা এবং এক মণ চাল দিতে হবে। স্থানীয় ভাষায় একে বলা হয় ডেরা। এই দাাঁদন চক্র শুষে নিত তাদের সকল পরিশ্রমের মুল্য। কর্মহীন সময়ে সংসার চালাতে আগাম শ্রম বিক্রয়ের জন্য প্রতিদিন তাদের ৫০-৬০ টাকা লোকসান দিতে হতো। এভাবে দিনের পর দিন দারিদ্র্যের দুষ্টচক্রে ঘুরপাক খেতেন তারা। এখন ফুডব্যাংক তাদের সেই দুর্দিন ঘুঁচিয়ে সুদিন এনেছে।
মহাদেবপুর উপজেলার হাতুড় ইউনিয়নের দেওয়ানপুর গ্রামের রিনা উড়াও জানান, দাদন ব্যবসায়ীদের এই বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে আসার জন্য একটা উপায় খুজতে থাকি আমি। তখন আমার চোখে ভাসতে থাকে এলাকার মুসলমানদের সারাবছর মুষ্টির চাল সংগ্রহ করে বিভিন্ন উৎসবে সেগুলো বিক্রি করে ভাল খাবার এবং আনন্দ উৎসবের আয়োজনের কথা। এই ধারনাকে কাজে লাগিয়ে নিজ সম্প্রদায়ের কয়েকজন উপজাতি নারীদের নিয়ে ২০০৫ সালে আমি মুষ্টিচাল সমিতি গঠন করি। পরে এই ধারনাকে আরো আধুনিক করে কমিউনিটি ফুডব্যাংক স্থাপন করা হয়।
২০০৯ সালের শুরুর দিকে স্থানীয় বিএসডিও নামের একটি বেসরকারী সংগঠনের কর্মীরা পতœীতল্ াউপজেলার বুজরুক মামুদপুর গ্রামের উপজাতি প্রাক-প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাসিক মা ফোরাম সভায় দেওয়ানপুর গ্রামের ফুড ব্যাংকের সফলতার কথা তুলে ধরেন। এ কথা জানার পর ঐ বছরই শুনিবালা উরাওকে সভাপতি করে ১৬জন নারী মিলে মুষ্টি চাল সমিতি গঠন করে চাল জমা করতে থাকেন ।তাদের সঙ্গে এলাকার অন্য নারীরাও যোগ দেয়। সেই থেকে তাদের অগ্রযাত্রা শুর। গত চার বছরে তারা ফুডব্যাংকে সন সময় ৭০মণ চাল স্টক রাখছেন। এ থেকে যখন যার প্রয়োজনমত চাল নিয়ে সংসার চালাচ্ছেন আবার সময়মত তা জমা করছেন। এতে তাদের বাড়তি কোন অর্থ দিতে হচ্ছে না। ফলে সবাই সমান ভাবে উপকৃত হচ্ছেন। এখন অভাব বলে কিছু নেই তাদের।
কর্মহীন,মঙ্গা ও অভাবের সময় মুঠো মুঠো করে জমা করা ৭০মণ চাল তাদের একদিকে যেমন পারিবারিক খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করেছে, অন্যদিকে তেমনি সামাজিক মর্যাদাও বৃদ্ধি করেছে। তাদের আর আগাম শ্রম বিক্রি করতে হয় না । দাদন ব্যবসায়ীর কাছে ধর্নাও দিতে হয়না।
এ অঞ্চলে গিয়ে দেখা যায় ফুডব্যাংকের নির্দিষ্ট কৌটার মধ্যে চাল নিয়ে নারীরা এক জায়গায় সমবেত হচ্ছেন সাপ্তাহিক কিস্তির চাল জমা দেয়ার জন্য। সমিতির সভাপতি প্রত্যেকের খাতায় হিসাব লিখে নিচ্ছেন আর চাল জমা করছেন।
ফুডব্যাংকের সদস্যরা জানান, তারা প্রতিদিন ও রাতে ভাত রান্নার আগে নির্ধারিত পরিমান চাল থেকে এক মুঠো চাল সরিয়ে রাখেন। সমিতির সদস্যরা সপ্তাহের সুবিধামতো সময়ে সভায় মিলিত হয়ে প্রত্যেকে আড়াই’শ গ্রাম চাল জমা দেন। কোন সদস্য চাল ঋণ গ্রহণ বা ফেরৎ দিতে চাইলে সেটিও এ সভায় সিদ্ধান্ত হয়।
শুনিবালা উরাও জানান, এখন নিজেদের ঘরেই চাল থাকায় আমাদের দাদন ব্যবসায়ীদের কাছে যেতে হয় না। সমিতির সদস্যদের পাশাপাশি গ্রামের অন্যান্য পরিবারকেও চাল ঋণ দেয়া হয়। কেউ ১মণ চাল ঋণ নিলে ৩মাস পর তাকে ৫কেজি চাল বেশি দিতে হয়। সমিতির সদস্যরা জানান, বার্ষিক প্রয়োজনের উদ্বৃত্ত চাল বিক্রির টাকায় গরু ক্রয় করে সমিতির সদস্যদের বর্গা দেয়া হয়। পর্যায়ক্রমে সকল সদস্যকে এভাবে একটি করে গরু ক্রয় করে দেয়া হবে। যাতে তারা নিজের সংসারের স্বচ্ছলতা আনতে পারেন।
কমিউনিটি ফুড ব্যংাক শুধু আগাম শ্রম বিক্রয় ও দাদন ব্যবসায়ীদের ঠেকায়নি । সামাজিক উন্নয়নেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। সম্প্রদায়ের কেউ মারা গেলে, ছেলে-মেয়ের বিবাহ, পরীক্ষার ফরম ফিলাপ ও খাতা কলম ক্রয়সহ বিভিন্ন কাজে সহযোগিতা দেয়া হয় সমিতির মাধ্যমে। এর মাধ্যমে উপকৃত হচ্ছেন সমিতির সদস্যসহ সকল গ্রামবাসী।
উপজাতিদের নিয়ে কর্মরত সংগঠন বিএসডিও’র প্রকল্প সমন্বয়কারী পবন মালো কমিউনিটি ফুডব্যাংক বিষয়ে জানান, উদ্বুদ্ধকরণের ফলে সর্বপ্রথম মহাদেবপুর উপজেলার দেওয়ানপুর গ্রামে মুষ্টি চাল সমিতি এ কার্যক্রম শুরু হয়। এর সফলতা দেখে নওগাঁর ২টি উপজেলা ছাড়াও পোরশা ও সাপাহার উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে কার্যক্রম ছড়িয়ে পড়ে। পরে হাসানবেগপুর, ফয়েমপুর, কুমিরদহ,কল্যাণপুর যোয়ানপুরসহ আরো ৪০টি মুষ্টি চাল সমিতি গঠিত হয়েছে। এছাড়াও উত্তরাঞ্চলের মঙ্গাপীড়িত রংপুর ,গাইবান্ধা,লালমনিরহাটসহ বিভিন্ন জেলায় ফুডব্যাংক মডেল বেশ জনপ্রিয় হচ্ছে।
বিষয়: বিবিধ
১৭৯৭ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন