চাঁদ তারার এলার্জি
লিখেছেন লিখেছেন এম_আহমদ ০৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৪, ০২:২০:২৭ রাত
আমার এক বন্ধু, শাহজালাল ইউনিভার্সিটির প্রাক্তন ছাত্র, বলেন যে তার এক কালের শিক্ষক জাফর ইকবাল চাঁদ তারা নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করতেন। ইউনিভার্সিটির কেন্দ্রীয় মসজিদের শীর্ষে খচিত চাঁদ তারার প্রতি ইঙ্গিত করে বলতেন, দেখ, নব-চন্দ্রের আকৃতির মধ্যেই তারকা চিহ্ন, বিষয়টি কত অবৈজ্ঞানিক! একজন বিদেশি লোক এই ইউনিভার্সিটি পরিদর্শন করতে এলে, এটা দেখে কী বলবে? নবচন্দ্রের (হেলালের) মধ্যে কী তারকা ধারিত হয়?
কিন্তু একটি প্রতীক চিহ্ন এবং বাস্তবের সাথে এর সম্পর্ক যে কীরূপ হতে পারে এই বিষয়ে উল্লেখিত ব্যক্তির মন্তব্য কত যে অপরিপক্ষ কেবল তা'ই প্রকাশ পায়।
গত কয় বছর আগে আমি একটি ব্লগ-সাইটে যখন লেখালেখি করতাম তখন সেখানে জাফর ইকবালের নাম করে কিছু লোক চাঁদ-তারা প্রতীকের সমালোচনা করতে দেখি। পরে অনেক চর্বিত চর্বণও দেখি। এই গ্রুপটির কাছে পাকিস্তানের কোনো ভাল বা ইতিবাচক দিক ছিল খাটি ছুঁৎমার্গের বিষয়। এই পাকিস্তানীরাই নাকি মুসলিম জাতীয়তাবাদের নামে বাঙালীদেরকে দুই দশক শোষণ করেছিলএবং এই শোষক দেশের পতাকায় ছিল চাঁদ তারা খচিত! (মার চালাইয়া!)। চাঁদ তারা -শোষণের প্রতীক!
প্রায় ১০/১২টি সংখ্যাধিক্য মুসলিম অধ্যুষিত দেশের পতাকায় চাঁদ তারা খচিত। পতাকা শ্রেণীতে, অথবা বাইরেও, কোথাও চাঁদ-তারার প্রতীকীতে ইসলাম নির্দেশিত হলে তা কি শিরক হয়ে যাবে? না, মোটেই না। শিরক অন্য বস্তু।
তুর্কীর পতাকাতেও চাঁদ তারা খচিত! এই চিহ্নটি ওসমান সাম্রাজ্যের পতাকায় সম্ভবত অষ্টাদশ শতাব্দী থেকে চলে আসছে। তখন ইউরোপে নৌশক্তির উত্থান ঘটেছে। ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম থেকেই ওসমান সাম্রাজ্যের পতন টানতে ইউরোপে নানান পরিকল্পনা চলছিল। ইউরোপিয়ান শক্তিগুলো ওসমান সাম্রাজ্যে বসবাসরত খৃষ্ঠীয়ানদের স্বার্থ সমৃদ্ধির অজুহাত দেখিয়ে বিভিন্ন এলাকা নিয়ে নাক গলাত। ঊনবিংশ শতাব্দীতেই তারা খৃষ্টীয়ান অধ্যুষিত কয়েকটি এলাকা স্বাধীন করিয়ে নেয়। (যেমন ১৮০৮ সালে সার্বিয়ায়, বর্তমান ইউগোস্লাভিয়ায়, বিপ্লব ঘটায় এবং ১৮৩০ সালে স্বাধীন করিয়ে নেয়)। বিংশ শতাব্দীতে এসে তারা ওসমান সাম্রাজ্যকে সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করে দেয়। যারা এই কাজ করেছিল তারা যে শুধু ইসলামের ভূখণ্ড খণ্ড খণ্ড করতে চেয়েছিল তা নয় বরং ইসলামের সাথে যাকিছু সংশ্লিষ্ট তা হোক ধারণা বা প্রতীক সবগুলোতে আক্রমণ এনেছিল। মুসলমান কোনো জাতি নয়, ইসলামে কোনো ভূখণ্ডের দরকার নেই, ‘আঙুলে-গুণা’ কয়েকটি কাজেই যখন ইসলাম ধর্ম ‘শান্তির সুশীতল ছায়া’ হয়ে পড়ে, তখন ভূখণ্ডের কি প্রয়োজন? তাদের এই ধারণা মুসলমানদের একাংশে সাফল্যজনকভাবে ঢুকিয়ে দিতে পেরেছে এবং তাদের আদর্শে ও জীবন দর্শনে মুসলমানদের এক বিরাট অংশকে উদ্বুদ্ধ করতে পেরেছে।
সকল জাতির মত মুসলিম জাতিতে শিক্ষা-দীক্ষার বিকাশ ঘটেছে, সংস্কৃতির বিকাশ ঘটেছে, সাহিত্য রচিত হয়েছে, স্থাপত্য-শিল্প গড়ে ওঠেছে এবং সর্বত্রই আধ্যাত্মিকতার বিকাশ তাদের কর্মকাণ্ড ও ব্যবহারিক বস্তুতে প্রতিফলিত হয়েছে। মুসলমানরা মূর্তি তৈরি করেনি কিন্তু স্রষ্টার সৃষ্টিরাজির নৈপুণ্য ও প্রকৃতির সৌন্দর্য বিভিন্নভাবে ধারণ করেছে, দেখেছে এবং তাদের নিজেদের স্থাপত্য-শিল্পে ও সৃষ্টিতে সেই সৌন্দর্যকে স্থান দিয়েছে, কিন্তু কখনো আল্লাহ ছাড়া কারো উপাসনা করেনি। মুক্ত ময়দানে দাঁড়িয়ে মহাকাশকে গম্বুজের মত দেখেছে, রাতের তারকা-খচিত দিগন্ত-দৃষ্টে খোদার সৃষ্টি-নৈপুণ্য অন্তরাত্মা বিহ্বল করেছে। অনন্ত মহাকাশের বিরাজিত মহিমাময় দৃশ্যকে তারা ক্ষুদ্র ক্ষণিকায় নিজেদের স্থাপত্যে ও শিল্পে স্থান দিতে চেয়েছে, মহাসিন্ধুকে ক্ষুদ্র বিন্দুতে ধারণের মত। কোনো এক সময়ে ‘গুম্বজ ও চাঁদ তারা’ প্রতীকীতে অনন্য (unique) হয়ে গিয়ে বিশ্ব মানবতায় পরিচিতির ইঙ্গিতবাহী হয়েছে। এমনিভাবে কোনো কোনো মেটোনিমিক প্রতীক (metonymic sign) পরিচিতিতে মেটাফোরিক (metaphoric) হয়ে যেতে পারে এবং হয়েছে।
কোরান হাদিসে প্রতীকী অর্থ
মানুষের যোগাযোগ ব্যবস্থা যেহেতু এমন যে এর সবকিছুতেই প্রতীক ও প্রতীকী ধারণা কাজ করে যাচ্ছে তাই কোরান হাদিসে এই ভাষিক উপাদানটির ব্যবহার বিস্তর আকারে থাকবে এটাই স্বাভাবিক। এই বিষয়টি এতই স্বাভাবিক যে তা প্রমাণের অপেক্ষা রাখে না। ঈমান থেকে শুরু করে ইসলামের শাখা প্রশাখা পর্যন্ত পরিব্যাপ্ত। কলিমা তৈয়্যিবাহকে খেজুর গাছের ইঙ্গিতে ‘শাজারাহ তৈয়্যিবাহ’ (شجرة طيبة /পবিত্র গাছ) বলা হয়েছে (১৪:২৪)। এখানে কালিমাহ হচ্ছে ঈমান (লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ) এবং পবিত্র বৃক্ষ হচ্ছেন ‘মুমিন’ (ইবন আব্বাস রা.)। মুজাহিদ ও ইকরিমা (রা.) বলেছেন খেজুর বৃক্ষকে ঈমানের উপমায় বলা হয়েছে। হযরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘ঈমানের উদাহরণ হচ্ছে এক বলিষ্ঠ বৃক্ষ। এতে (এই উপমায়) ঈমান হবে তার জড় বা শিকড়, নামাজ হবে তার কাণ্ড, যাকাত হবে শাখা-প্রশাখা, রোজা হবে ডালপালা, আল্লাহর পথে দুঃখ-কষ্ট তার সবজিজাত গাছ/তরুলতা, উত্তম চরিত্র তার পত্রপল্লব এবং হারাম থেকে বেঁচে থাকা হবে তার ফল-ফসল।’ কুফরকে শাজারাহ খাবিছাহ (খবিছ বৃক্ষ) বলা হয়েছে (১৪:২৬)। এই বৃক্ষটি ‘হানযালাহ’ যার কোনো উপকার নেই এবং এর জড় মাটির গভীরে নয় এবং এটা কাঁটাযুক্ত এবং দুর্গন্ধময়। কোরবানির উট (২২:৩৬), সাফা মারওয়া (২:১৫৮), মসজিদ ইত্যাদি আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রতীক (شعائر/symbols/নিদর্শন) বলে উল্লেখ এসেছে –এসব ফিরিস্তি অতি দীর্ঘ করা যেতে পারে। এগুলোর সাথে সংশ্লিষ্ট বিধান ও কর্মকাণ্ড তা’জীমের সাথে পালন করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তা’জীমের অর্থ হচ্ছে আদব আখলাকের সাথে এবং সম্মানের সাথে সেই নিদর্শনপূর্ণ স্থানে দ্বীনি নির্দেশনা পালন করা, যেমন মসজিদে ঢুকার পর মসজিদের আদব রক্ষা করা এবং সাফা-মারওয়া, কাবা গৃহ ইত্যাদিতেও তা’ই।
পতাকাও একটি প্রতীক। যুদ্ধের সময় মুসলমানদের পতাকা থাকত এবং তাদের একজন সেই পতাকা বহন করতেন। কাফির দলেও পতাকা থাকত এবং তাদের দেবমূর্তিও থাকত। কিন্তু মুসলমানদের পতাকার অর্থ কি হত? মুসলমানদের হাতে যখন পতাকা থাকত, তখন ওঠা কীসের প্রতীক হত? উত্তর হচ্ছে এই পতাকা মুসলিম পক্ষের প্রতিনিধিত্বের ভাব প্রকাশ করত। এখানে পরিচিতির ও প্রতিনিধিত্বের একটা অর্থ নিহিত থাকত। এই পতাকা মানি ‘এই পক্ষ’, মুসলিম পক্ষ। অপরের পতাকা অপরের পক্ষের। বলেছি এসেছি, ইসলামী আর্ট ও স্থাপত্য শিল্পে প্রতীকীর ছড়াছড়ি রয়েছে। ওগুলো নানান প্রতীকী অর্থ, বিশেষ ধারণাকে, প্রতিনিধিত্ব করত এবং এখনো করে। পতাকা যে কেবল যুদ্ধের ময়দানে ব্যবহৃত হত তা নয়, দুই বা ততোধিক দলের সন্ধিক্ষণেও ব্যবহৃত হত। আমার পঠিত স্মৃতি থেকে বলছি হযরত আলীর (রা.) এবং আরো রেওয়ায়েত আছে যে তাঁরা বলছেন অমুক সন্ধিতে আমি পতাকা ধারণ করেছি। ইসলামে প্রতীকের পূজা নেই, কিন্তু অর্থের ব্যবহার আছে। ইসলামের আলিম-উলামা এসব বিষয়ে পরিপূর্ণভাবে জ্ঞাত।
নব-চাঁদের (বা হিলালের/crescent) উল্লেখ কোরানে এসেছে। আল্লাহ বলেন এটা হচ্ছে সময় নির্দেশক/নির্ধারক (২:১৮৯)। মুফাসসিরগণ এর অনেক ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করেছেন। বলেছেন, এতে হজ্জের সময় ও বিধান, রোজার সময় ও বিধান, নারীর ইদ্দত, ব্যবসা-বাণিজ্য ও সন্ধির কাল এবং কৃষিকার্যসহ অনেক বিষয়ের কাল নির্ধারিত ও বিবেচিত হয়। আল্লাহ সূর্যকে বলেছেন উজ্জ্বল আলো (দানকারী) এবং চাঁদকে আলো, ব্যাখ্যায় তা স্নিগ্ধ আলো ((প্রাপ্ত) (১০:৫))। সুফি তফসীরে এর তুলনা রূহ এবং ক্বালবের মত আলোচিত হয়েছে। আল্লাহ রূহকে নূরানী করে সৃষ্টি করেছেন, সূর্যের মত বা এর তুলনায় এবং ক্বালবকে করেছেন শ্বেত, আলোর গ্রাহক হিসেবে, চাঁদের তুলনায় ((তাফসীর/ইমাম আহমদ বিন ওমর (র.))। আল্লাহ তাঁর নবীকে ‘সিরাজুন মুনির’ (উজ্জ্বল প্রদীপ)আখ্যায়িত করেছেন (৩৩:৪৬)। কোরানে গ্রহ-নক্ষত্রের আলোচনা হেদায়াত বুঝার নিদর্শন হিসেবে বিস্তরভাবে এসেছে। তফসীরেও বিস্তৃত আলোচনা হয়েছে। ইমাম আহমদ বিন ওমর (র.) আলাদাভাবে সুফি ইশারাবাহী একখানা তফসীর প্রণয়ন করেছেন যার নাম হয় ‘গ্রহ-নক্ষত্র বিষয়ক ব্যাখ্যার তফসীর’ (التأويلات النجمية في التفسير الإشاري الصوفي)। আল্লাহ আসমান জমিনকে নিয়ে চিন্তা-ভাবনা (তাফাক্কুর) করতে বলেছেন, তিনি তার সৃষ্টিরাজির কথা কোরানে বর্ণনা করেছেন। মুসলিম সমাজে এইসব বিষয় চিন্তা-ভাবনায় এসেছে, আলোচিত হয়েছে, তাদের শিক্ষা সংস্কৃতিতে এবং তাদের স্থাপত্যেও রূপায়িত হয়েছে। চাঁদ তারাতে সমস্যা কী হয়েছে? কেউ কি চাঁদ তারার উপাসনা করে? এটা কী উলটা বলা যাবে না যে এক শ্রেণীর লোকজন মুসলিম সমাজের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে এলার্জি অনুভব করে থাকেন, যেমন একটি গ্রুপের কথা উল্লেখ করেছি।
পুরা লেখাটি পড়তে এখানে ক্লিক করুন
বিষয়: বিবিধ
১৫১৮ বার পঠিত, ৪ টি মন্তব্য






































পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন