কষ্টে কাটে নষ্টপ্রহর, পর্ব- ৬: জনবিচ্ছিন্ন রাজনীতির উত্তরাধিকার
লিখেছেন লিখেছেন মাহরুফ চৌধুরী ০৬ মে, ২০১৩, ০৮:০৪:২৯ সকাল
ছয়: জনবিচ্ছিন্ন রাজনীতির উত্তরাধিকার
ইতিহাসের পালাবদলে ১৭৫৭ সালের ২৩শে জুল পলাশীর প্রান্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সূর্য অস্ত গিয়েছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর সাথে স্বদেশী কুচক্রী মহলের আঁতাতের মধ্যে দিয়ে। বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজ-উদ্-দৌলার সেনাবাহিনী পরাজয় বরণ করে ঘরের শত্রু বিভীষণ- মীর জাফর আলী খাঁ, উঁমি চাঁদ আর ঘোসেটি বেগমদের চক্রান্তে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর সেনাপতি রবার্ট ক্লাইভের কাছে। রাজা যায়, রাজা আসে; তাতে প্রজার কী! এটাই বাংলাদেশের সাধারণ জনতার জীবনে একটি চিরন্তন ঐতিহাসিক সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। তাই বিদেশী বেনিয়ার কাছে সিরাজের এ পরাজয়ে সাধারণ মানুষের কোন মাথা ব্যাথা ছিল না।
বাংলাদেশের শাসক শ্রেণী সব সময়ই ছিল জনবিচ্ছিন্ন, এবং বর্তমানেও আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো অনেকটাই জনবিচ্ছিন্ন। রবার্ট ক্লাইভের বিবরণ থেকে জানা যায়, তার বিজয়ী বাহিনীকে দেখার জন্য পলাশী থেকে মুর্শিদাবাদ পর্যন্ত রাস্তার দুই পাশে দাঁড়িয়েছিল শত-সহস্র সাধারণ মানুষ। আমরা যদি ইতিহাসের আরেকটু পেছনে ফিরে তাকাই, বাংলার শেষ হিন্দু রাজা লক্ষণ সেনকেও দেখি তাঁর নদীয়ার বাসভবনের পেছনের দরজা দিয়ে পালিয়ে যেতে একজন কিশোর যোদ্ধা ইখতিয়ার উদ্দীন মুহাম্মাদ বিন বখতিয়ার খিলজীর ১৩ সদস্যের সেনাবাহিনীর ভয়ে। প্রকৃতপক্ষে রাজ্যের জনসাধারণের কাছ থেকে রাজা হিসেবে তাঁর জনবিচ্ছিন্নতাই ছিল প্রতিরোধহীন এ পলায়নের মূল কারণ। আর এই জনবিচ্ছিন্নতাই আমাদেরকে ধীরে ধীরে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও সামাজিক অবক্ষয়ের চরম পর্যায়ে নিয়ে এসেছে।
আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে ইতিহাসিকভাবে আমাদের শাসক শ্রেণী সব সময়ই ছিল জনবিচ্ছিন্ন। কালানুক্রমে এই জনবিচ্ছিন্নতার ধারা আমাদের বর্তমান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেও ঐতিহাসিক উত্তরাধিকারের মতোই প্রবহমান। এই গণবিচ্ছিন্নতা ও কলুষিত রাজনৈতিক সংস্কৃতির সাহিত্যিক প্রতিরূপ লক্ষ্য করা যায় কথাসাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলনের ভিক্ষুক নামক গল্পটিতে। ভোটের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করার জন্য আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো ও তাদের মনোনীত প্রার্থীরা প্রাক্-নির্বাচনকালীন সময়েই শুধু গণসংযোগ করে থাকে। তারা জনগণের দরজায় ধর্ণা দেয়, ভোটারদের হাতেপায়ে ধরে কিংবা কখনো কখনো হুমকী-ধমকী দিয়ে থাকে তাদেরকে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করা জন্য। পরবর্তী নির্বাচন না আসা পর্যন্ত বাকী সময়টুকু তারা থাকে জনগণের ধরা ছোঁয়ার বাইরে। ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস- যারা নির্বাচনে জেতে তারা ভাবে জনগণের আর প্রয়োজন নেই। তারাইতো এখন সব দন্ডমুন্ডের কর্তা। কারণ জনগণতো তাদেরকে নির্বাচিত করেছে, দিয়েছে স্বেচ্ছারিতার অবাধ অধিকার এবং রাষ্ট্রীয় সম্পদের লুন্ঠনের সুযোগ। নির্বাচন-উত্তর সময়ে সেই অধিকার আর সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে তারা এতই মশগুল হয়ে পড়ে যে, দেশ ও জনগণের কথা ভাববার তাদের কোনই অবকাশ আর থাকে না। অপর দিকে যারা পরাজিত হয়, তারা ভাবে- জনগণ যেহেতু আমাদেরকে নির্বাচিত করেনি তাই তাদের আর খোঁজখবর নেয়ার দায়দায়িত্ব তাদের নেই।
মানবিক অধিকার ভোগ করার পূর্বশর্ত স্বাধীনতা। প্রকৃতপক্ষে স্বাধীনতা ব্যতিত মানবাধিকার অর্জিত হতে পারে না। আর সেই স্বাধীনতা মানে স্বেচ্ছাচারিতা নয়। স্বাধীনতা সব সময়ই অর্থময় হয়ে ওঠে একটি সুনির্দিষ্ট নিয়মনীতির পরিসরে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, আমাদের অনেকেই ভুলে যান যে, রাজনীতি হচ্ছে সামষ্টিক কল্যাণের জন্য- ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য নয়। দেশ এবং জাতির কাছে দায়বদ্ধতা আর রাজনীতিবিদ হিসেবে তাদের উপর অর্পিত দায়-দায়িত্ব পালন করাই আদর্শিক রাজনীতির প্রধান লক্ষ্য। কিন্তু আমাদের রাজনীতিবিদদের অনেকেই ক্ষমতার অপব্যবহার করে নিজেদের আখের গোছানোকেই রাজনীতির রাজপথে বিচরণের প্রধান লক্ষ্য মনে করেন। তাই আমাদের দেশে রাজনীতি হয়ে ওঠে তোষণ, শোষণ আর ক্ষমতার অপব্যবহারের হাতিয়ার। আমাদের বিগত রাজনৈতিক সরকারগুলোর দিকে তাকালে সেটা যেমন সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে, তেমনি বর্তমান অরাজনৈতিক সরকারের কর্মকান্ডও জনগণকে স্বস্তি দিতে ব্যর্থ হয়েছে। কারণ দেশ ও জাতির স্বার্থ রক্ষা এবং উন্নয়নের চেয়ে তারা নিজেদের গদি রক্ষা ও নিজেদের ব্যক্তিগত অর্থনৈতিক অর্জনের প্রতিই বেশী খেয়াল রাখে।
বিষয়: বিবিধ
১৩২৭ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য






































পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন