কর্জে হাসানা : ক্ষুদ্রঋণের বিকল্প
লিখেছেন লিখেছেন ডক্টর আ ফ ম খালিদ হোসেন ২৫ আগস্ট, ২০১৩, ১১:৪৩:৪৮ সকাল
বিত্তশালীরা ইসলামী বিধিবিধান মেনে জাকাত, সাদাকাত ও কর্জে হাসানা প্রদান করলে সমাজের অবহেলিত ও দারিদ্র্যক্লিষ্ট মানুষগুলো নিজ পায়ে দাঁড়ানোর সুযোগ সৃষ্টি হবে। জাতীয় উৎপাদনে তারা তাদের কর্মশক্তি নিয়োজিত করতে পারবে। সামাজিক নির্দেশনা, ক্যাপাসিটি বৃদ্ধি, আর্থিক সহায়তার মাধ্যমে সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়েপড়া পরিবারগুলোকে শত্তিশালী করে অভাবের তাড়না থেকে মুক্তি প্রদানের পথ কর্জে হাসানা বা সুদমুক্ত ঋণ। কর্জে হাসানা ইবাদত এবং মানবতার পুণ্যময় কল্যাণ। মহানবীর (সা.) ভাষ্য অনুযায়ী, দানের চেয়ে ঋণ প্রদানের গুরুত্ব বেশি। দানের সওয়াব দশ গুণ আর ঋণ প্রদানের সওয়ার আঠারো গুণ। বিভিন্ন ইসলামী ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বা ট্রাস্ট বিনা সুদে ছোট ও মাঝারি আকারের ঋণ প্রদান করে অসহায় পরিবারগুলোকে আত্মনির্ভরশীল করার পথ দেখাতে পারে। কর্জে হাসানা হতে পারে দারিদ্র্যবিমোচনের ব্যাপকভিত্তিক শক্তিশালী মডেল। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ব্যক্তিপর্যায়ে কর্জে হাসানা চালু থাকলেও প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পরিগ্রহ করেনি। এ ক্ষেত্রে কতিপয় অপরিহার্য নীতিমালা প্রণয়ন জরুরি। যেমন, দু’জন গ্যারান্টার থাকবেন, যারা ঋণ গ্রহীতাকে সত্যায়ন করবেন এবং তার ব্যবসা মনিটর করবেন। ব্যবসার পরিকল্পনা তৈরিতে ব্যাংক বা ট্রাস্ট কর্তৃপক্ষ সহায়তা দেবেন এবং ব্যাংক কর্তৃক নির্ধারিত কিস্তিতে ঋণ পরিশোধ করবেন। ঋণের পরিমাণ ব্যাংক কর্তৃপক্ষ নির্ধারণ করবেন, তবে সাধারণত ১০ হাজার টাকা থেকে ১ লাখ টাকা হতে পারে। ঋণের মেয়াদ ২৪ মাস থেকে ৫ বছর হতে পারে। নিম্নোক্ত খাতে কর্জে হাসান বা সুদমুক্ত ঋণ সুফল বয়ে আনতে পারে। যেমন পোশাক তৈরি, এমব্রয়ডারি, কিচেন ব্যবস্থাপনা, খাদ্য তৈরি, মোটরসাইকেল মেকানিক, অটোমেকানিক, হাঁস-মুরগির খামার, কম্পিউটার সফটওয়্যার, ওয়েল্ডিং, কাঠের সরঞ্জাম তৈরি, ছাগল পালন ইত্যাদি। অসচ্ছল পরিবারের মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষাঋণ দিলে নিরক্ষতা দূরীভূত হবে। কর্জে হাসানায় কোনো ধরনের সুদ, সার্ভিস চার্জ, লোন প্রসেসিং ফি, মুনাফা, জরিমানা নেই। নির্ধারিত মেয়াদের ভেতরে মূল টাকা ফেরতযোগ্য। ঋণগ্রহীতা ইচ্ছে করলে ঋণের পুরো অর্থের ১% ইন্স্যুরেন্স করতে পারবেন ইসলামী শরিয়াহ পরিচালিত যে কোনো ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিতে। এটা বাধ্যতামূলক নয়, স্বেচ্ছাধীন। ইন্স্যুরেন্স করা হলে ব্যবসার ক্ষতি, দুর্ঘটনা বা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে ক্ষতিপূরণ পাওয়া যাবে। ‘ক্ষুদ্রঋণ’, ‘দারিদ্র্যবিমোচন’ সম্প্রতি খুব আলোচিত পরিভাষা। অভাবগ্রস্ত মানুষের দরিদ্রতাকে কাজে লাগিয়ে ঋণ প্রদানের মাধ্যমে লাভজনক ব্যবসা পরিচালনার নাম ‘ক্ষুদ্রঋণ’ (Micro Credit)। এর মাধ্যমে দারিদ্র্যবিমোচন তো হয়ই না, বরং তৃণমূলপর্যায়ে সুদের বিস্তৃতি ঘটে, তৈরি হয় নতুন কাবলিওয়ালা। কিছু দিন আগে ডেনমার্কের সাংবাদিক টম হাইনেমান (Tom Heinemann) কর্তৃক নরওয়ের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে প্রচারিত ‘ক্ষুদ্রঋণের ফাঁদ’ (Caught in Micro Debt) নামক প্রামাণ্য চিত্রের মাধ্যমে এ কথা ¯পষ্ট হয়েছে যে, ‘ক্ষুদ্রঋণ’ দারিদ্র্যবিমোচনে ব্যর্থ। দারিদ্র্যবিমোচন ও নারীর ক্ষমতায়নে ক্ষুদ্রঋণের ইতিবাচক ভূমিকা নেই। বাংলাদেশের হতদরিদ্র মানুষ ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে ৬৭ শতাংশই ব্যয় করে অনুৎপাদনশীল খাতে, যা দারিদ্র্যবিমোচনে কোনো ভূমিকাই রাখে না। তাই ক্ষুদ্রঋণের মাধ্যমে দারিদ্র্যবিমোচন সম্ভব নয়। সম্প্রতি দেশের দুর্যোগপ্রবণ আট জেলার খাদ্য নিরাপত্তা পরিস্থিতির ওপর বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (WFP) পরিচালিত এক জরিপের প্রতিবেদনে এ তিক্ত সত্য ফুটে উঠেছে। সম্প্রতি দেশের দুর্যোগপ্রবণ রংপুর, গাইবান্ধা, বগুড়া, নেত্রকোনা, সুনামগঞ্জ ও কিশোরগঞ্জ জেলায় এ জরিপ চালানো হয়। ইউরোপীয় ইউনিয়নের (EU) আর্থিক সহায়তায় পরিচালিত এ জরিপ প্রতিবেদন ‘দারিদ্র্যবিমোচনে দরিদ্র ব্যক্তিদের সম্পদ প্রদানে’র ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, হতদরিদ্র ব্যক্তিদের ৫০ থেকে ৭৫ শতাংশই ঋণগ্রস্ত। এদের মধ্যে ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ দেনাগ্রস্ত শুধু স্থানীয় মুদি দোকানগুলোর কাছে। ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে ২৯ শতাংশ হতদরিদ্র চিকিৎসা বাবদ খরচ করে ও ১৭ শতাংশ দৈনন্দিন খাবার কেনে। এছাড়া ক্ষুদ্রঋণের ১৩ শতাংশ অর্থ ব্যয় হয় মৃতের সৎকার, বিয়ে ও বিবাহ বিচ্ছেদের মতো পারিবারিক অনুষ্ঠান এবং জরুরি সঙ্কট মোকাবিলায়। হতদরিদ্রের ঋণের উৎস সম্পর্কে প্রতিবেদনে বলা হয়, ৬০ শতাংশ মানুষ আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধবের কাছ থেকে ঋণ নেয়। দাদনের ঋণ নেয় ১০ শতাংশ। এছাড়া ১৪ শতাংশ গ্রামীণ ব্যাংক থেকে, ৭ শতাংশ ব্র্যাক থেকে, ১২ শতাংশ বিভিন্ন এনজিও থেকে ও মাত্র ১ শতাংশ সাধারণ ব্যাংক থেকে। বিশিষ্ট সাংবাদিক ফরহাদ মজহার বলেন, ‘ক্ষুদ্রঋণ দারিদ্র্যবিমোচন করে না বরং সামন্তসমাজের ভূমিদাসের মতো এ যুগের মানুষকে গ্রামীণ ব্যাংক একধরনের ঋণদাসে পরিণত করছে। দারিদ্র্যবিমোচনের এ পথ অনুসরণ করার ফলে আমাদের উন্নতির কোনো দিশা আমরা খুঁজে পাচ্ছি না। পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থার মধ্যেই সংখ্যালঘুর ধনী ও সংখ্যাগরিষ্ঠের গরিব হওয়ার প্রক্রিয়া নিহিত। এই গরিব করা ও গরিব রাখার ব্যবস্থা বহাল রেখে গরিবদের ঋণ দিয়ে ও উচ্চ হারে সুদ নিয়ে কীভাবে গরিবি মোচন হবে? এই অস্বাভাবিক ও বিকৃত চিন্তাকেই আমরা সদলবলে লালন করে আসছি।
http://www.alokitobangladesh.com/islam/2013/08/25/18243
বিষয়: বিবিধ
১৮১৭ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন