পৃথিবীর সৃষ্টি ঃ কোরআন এবং বিজ্ঞান
লিখেছেন লিখেছেন আবু মাহফুজ ১৯ জুলাই, ২০১৫, ০৫:২৮:২০ সকাল
এটা নিঃসন্দেহে একটি সামাজিক-দর্শন বিষয়ক বিতর্ক, এ বিশ্বের সৃষ্টি হলো কিভাবে? কারো কারো সোজা উত্তর, ”এ পৃথিবীর সৃষ্টিকর্তা তো আল্লাহ। তিনিই তো সবকিছু সৃষ্টি করেছেন।” কেউবা বিশ্বাস করেন বিশ্ব ব্রম্মান্ডে। অর্থাৎ হিন্দুদের পুজারী ব্রম্মের অন্ড বা ডিম থেকে এই পৃথিবীর সৃষ্টি। ছোটকালে তো বিশ্বসৃষ্টি এবং ভুমিকম্প সম্পর্কে এভাবে শুনেছি যে সমস্ত পৃথিবীটা একটা বড় ষাঁড়ের এক শিং এ ¯’াপিত। প্রতি বছর বা মাঝে মধ্যে যখন ষাঁড়ের শিং বদলের প্রয়োজন হয় তখন পৃথিবীটাকে ষাঁেড়র এক শিং থেকে অন্য শিং এ নেয়ার সময় প্রচন্ড ঝাঁকুনী হয় সেটাই ভুমিকম্প। এমন কুসংস্কার ও প্রচলিত রয়েছে যে যারা স্বর্গে বা বেহেশতে যাবে ঐ ষাঁড়ের কলিজা দিয়ে তাদেরকে নাস্তা করানো হবে। নিঃসন্দেহে এটা একটা কুসংস্কার।
পৃথিবী সৃষ্টি সম্পর্কে কেউ কেউ বিশ্বাস করেন ”বিগ বেঙ” থিওরীতে। বিগ বেঙ হলো ইংরেজী শব্দ যার অর্থ হলো বিকট শব্দ। এই বিগ বেঙ থিউরীর মূল কথা হলো, আজ থেকে কোটি কোটি বছর আগে সেীরজগতে একদিন হঠাৎ নক্ষত্রে নক্ষত্রে সংঘর্ষ হয় এতে একটি বিকট শব্দ হয় এই বিকট শব্দের মাধ্যমে ছিন্ন বিছিন্ন হয়ে যাওয়া গ্রহ নক্ষত্রের টুকরো থেকেই এই পৃথিবীর সৃষ্টি।
আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত প্রায় সকলেই বিশেষত বিজ্ঞানের সাথে সম্পর্কিত ব্যাক্তিরা বিগ বেঙ থিওরীতে বিশ্বাস করেন। এই বিগ বেঙ থিওরীকে যেীক্তিক এবং বৈজ্ঞানিক মনে করা হয় কারণ এই থিওরীর পেছনে রয়েছে বৈজ্ঞানিক যুক্তি তর্ক এবং ঐতিহাসিক উদাহরন। যদিও এই বিগ ব্যাঙ থিওরী বা অন্য কোন বৈজ্ঞানিক থিওরীই চিরন্তন নয়। সেীরজগৎ সম্পর্কে বা সূর্য ঘুরে না পৃথিবী ঘুরে এ নিয়ে বিজ্ঞানীদের মধ্যে বারবারই মতের পরিবর্তন এসেছে। তাছাড়া এনিয়ে একজন প্রসিদ্ধ বিজ্ঞানী কোপারনিকাসকে যথেষ্ট কষ্ট পেতে হয়েছে। আধুনিক যুগে পৃথিবী সৃষ্টি সম্পর্কে বিগ ব্যাঙ থিওরীটাই সবচে’ বেশী গ্রহনযোগ্য এবং সবচে’ বেশী বৈজ্ঞানিক। যদিও এই থিওরী নিয়েও বৈজ্ঞানিকদের মধ্যে আজো পর্যন্ত্য মতানৈক্য রয়েছে। সম্প্রতি জন কেইরিন (John Kierein) নামে একজন লেখক ”কেন বিগ ব্যাঙ থিওরী ভুল” (Why the Big Bang is Wrong) শীর্ষক একটি নিবন্ধে এ সম্পর্কে আলোচনা করেছেন।
এছাড়া গত বছর, ২০১৪ সালের ২৫শে সেপ্টেম্বর বৃটেনের বিশ্ববিখ্যাত ডেইলি মেইলের সাইন্স সেকশেন একটি নিবন্ধ ছাপা হয়েছিল যার শিরোনাম ছিল, (Black holes do NOT exist and the Big Bang Theory is wrong)
যার অর্থ হলো, (ব্ল্যাক হোল বলতে কিছু নেই, বিগ ব্যাঙ্গ থিওরী একটি ভুল থিউরি), সে নিবন্ধে দাবী করা হয় যে, যুক্তরাষ্ট্রের ইউনির্ভাসিটি অফ নর্থ ক্যারলিনার (Professor Laura Mersini-Houghton) প্রফেসর লাউরা মেরসিনি হাফটন নামের একজন বিজ্ঞানী দাবী করেছেন যে, তাঁর কাছে গানিতিক প্রমাণ আছে যে ব্ল্যাক হোল বলতে কোন কিছুর অস্তিত্ব অসম্ভব।
সে যাক, আমরা ঐ সব অর্ন্তনিহিত বিতর্কে না গিয়ে শুধু কোরআনের সাথে বিজ্ঞানের বিশেষতঃ পৃথিবী সৃষ্টি সম্পর্কে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আলোকপাত করবো।
পবিত্র কোরআন সবসময়ই জ্ঞানকে প্রাধান্য দিয়েছে। জ্ঞান ছাড়া ইসলামে কোন কিছুই গ্রহনযোগ্য নয়। আল্লাহর পক্ষ নবী করীম (সঃ) এর কাছে থেকে অবতীর্ণ প্রথম শব্দই হলো ইকরা বা পড় এবং জ্ঞানার্জন করো। বৈজ্ঞানিক ধারনা বা থিওরীর সাথে যুগে যুগে কোন কোন সময় ধর্মীয় বিশ্বাসের কিছু কিছু সংঘাত হয়েছে। এই সংঘাতগুলোর কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে (১) বিষয় সম্পর্কে ধর্মের অস্পষ্ট বা ভুল ধারনা (২) ধর্মীয় থিওরীতে ধর্মানুসারীদের ধারনা স্পষ্ট না থাকা (৩) বৈজ্ঞানিক থিওরীতে ভুল থাকা।
সেীরবিজ্ঞান বা সৃষ্টিতত্ত্ব সম্পর্কে উল্লেখযোগ্য মতানৈক্য গুলোর মধ্যে রয়েছে খৃষ্টধর্মের সাথে কোপারনিকাসের বিরোধ। সুর্য ঘুরে না পৃথিবী ঘুরে এই বিতর্ক সবচে বেশী পরিচিতি লাভ করে। এই বিতর্ক শুধু খৃষ্টানদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি এ বিতর্কে মুসলমানরাও জড়িয়ে পড়ে। বিজ্ঞানের থিওরী মতে পৃথিবী সুর্যকে কেন্দ্র করে ঘুরছে। আমাদের সেীরজগতে মোট ১৩ বা মতান্তরে আরো বেশী নক্ষত্র রয়েছে। আমাদের এই সেীরজগতে সুর্য হলো কেন্দ্র। সুর্যকে কেন্দ্র করে সবক’টি গ্রহ ঘুরছে।
আদিকালে জ্ঞানের সীমাবদ্ধতার কারণে মুসলমানদের কেউ কেউ বিশ্বাস করতে থাকে যে সেীর জগতে পৃথিবী নয় সুর্যই পৃথিবীকে কেন্দ্র করে ঘুরছে। এসব মুসলমানদের এই ধারনার পেছনে রয়েছে পবিত্র কোরানের একটি আয়াতকে ভুলভাবে বুঝা। পবিত্র কোরানের সুরা ইয়াসিনে আল্লাহ পাক বলছেন ”এবং সুর্য তার কক্ষপথে আবর্তন করছে।” (আল কোরআন ৩৬ঃ৩৮) পবিত্র কোরানের এ আয়াতকে দিয়ে যারা বুঝতে চান যে পৃথিবী নয় সুর্যই ঘুরছে। তারা আসলে চরম এবং স্পষ্ট ভুল করছেন। কোরআনে বলা হয়েছে, "সুর্য তার কক্ষপথে আবর্তন করছে", কোরান হাদীসের কোথাও একথা বলেনি যে সুর্য্য পৃথিবীকে কেন্দ্র করে ঘুরছে। কোরআন বলছে সূর্য তার জন্য নির্দ্দিষ্ট কক্ষপথে ঘুরছে। আর কোরআনের কোথাও তো বলা হয়নি যে, পৃথিবীটা স্থির। বরং সুরা ইয়াসিনেই আল্লাহ পাক আবার বলছেন, ’কুললুন ফি ফালাকিন ইয়াসবাহুন’। অর্থাৎ ”সেীরজগতে প্রত্যেকটি গ্রহ নক্ষত্রই আবর্তন করছে”। (আলকোরআন ৩৬ঃ৪০) এ আয়াতের প্রেক্ষিতে বলা যায় সুর্য এবং পৃথিবী উভয়ই ঘুরছে। সুর্য্য এবং পৃথিবী উভয়ই ঘুরছে এ ব্যাপারে কোরআন বা বৈজ্ঞানিক থিওরীতে কোন পার্থক্য নেই। এখানে শুধু পার্থক্য হলো কে কাকে কেন্দ্র করে ঘুরছে এ প্রসঙ্গে। কে কাকে কেন্দ্র করে ঘুরছে এ ব্যাপারে আমার পরবর্তী আলোচনা ”কোরআন বনাম বিজ্ঞান সুর্য্য ঘুরে না পৃথিবী ঘুরে” শীর্ষক অধ্যায়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।
এবার আসা যাক পৃথিবী সৃষ্টি সম্পর্কে বিগ ব্যাঙ থিওরী এবং কোরআনের সাথে সম্পর্ক নিয়ে আলোচনায়। বিগ ব্যাঙ থিওরী মতে, আজ থেকে ১০-২০ বিলিয়ন বছর আগে সেীরজগতে একটি বিকট শব্দে এক মহাসংঘর্ষ (বা এক্সপ্লোজন) হয়েছিল। সে মহা সংঘর্ষে সেীরজগতের বিভিন্ন গ্রহ নক্ষত্র টুকরো টুকরো হয়ে যায় এবং সে টুকরো থেকেই আমাদের এই পৃথিবীর সৃষ্টি। এ প্রসঙ্গে কোরআনের বক্তব্য হলো, সুরা আম্বিয়ায় আল্লাহ পাক বলছেন, ”ঐ সমস্ত অসিশ্বাসীরা কি জানেনা যে, একসময় আকাশ এবং পাতাল তথা মহাবিশ্ব একত্রে জোড়া লেগে একত্রে ছিল আর আমি (আল্লাহ) এগুলোকে বিভিন্ন অংশে বিভক্ত করেছি।” (আল কোরআন ২১ঃ৩০)। বিশ্ব সৃষ্টি সম্পর্কে বিজ্ঞানের আরো মত হলো এই বিশ্ব সৃষ্টি হয়েছে ইন্টারস্টেলার থিওরী (Interstellar Matter) মতে। ইন্টারস্টেলার মেটার থিওরী হলো, বিভিন্ন প্রকার গ্যাস, ধুলাবালি এর মাধ্যমে গ্রহ নক্ষত্রের সৃষ্টি। এই থিওরীর গ্যাস বলতে মূলত হাইড্রোজেন এবং হিলিয়াম গ্যাসকে বুঝানো হয়। আর ইন্টারস্টেলার ধুলাবালি বা ডাস্ট বলতে বুঝানো হয়েছে, পানি, বরফ, সিলিকন, গ্রাফাইট তার সাথে যোগ হয়েছে কালো মেঘ, ধুলাবালি এবং গ্যাস। (ইন্টারস্টেলার থিওরী সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্যের জন্য দেখুন Merrill, General Science, Moyer Bishop, p-320-321)
এবার দেখা যাক বিশ্ব সৃষ্টি সম্পর্কে কোরআনের সাথে এই ইন্টারস্টেলার থিওরীর সম্পর্ক কোথায়। ইন্টারস্টেলার থিওরীর উপরোক্ত কথাগুলোকে একত্রে করলে বুঝা যায় এই থিওরী মতে বিশ্ব সৃষ্টির মূল উপাদান মূলত হাইড্রোজেন এবং হিলিয়াম গ্যাস। শুধু তাই নয়, বিজ্ঞানীদের মতে আজো হাজার হাজার নক্ষত্র রয়েছে যেগুলোর উপাদান মূলঃ হাইড্রোজেন গ্যাস। তাছাড়া বিজ্ঞান অনুযায়ী হাইড্রোজেন গ্যাস নিজে জ্বলে। মহাশুণ্যের লক্ষ লক্ষ নক্ষত্র মূলতঃ এই জ্বলন্ত হাইড্রোজেন গ্যাস। এদিকে কোরআনের দৃষ্টিতে পৃথিবী সৃষ্টির মূল উপাদান হলো পানি। পবিত্র কোরআনের সুরা হুদের ৭ নং আয়াতে বিশ্ব সৃষ্টি সম্পর্কে আল্লাহ পাক বলছেন, ”এবং তিনি আকাশ-পাতাল বিশ্বভুমন্ডল ৬ দিনে (পর্যায়ে) সৃষ্টি করেছেন এবং তখন তাঁর আরশ ছিল পানির উপরে।” এ আয়াতে প্রেক্ষিতে বুঝা যায় বিশ্বসৃষ্টির সময় আল্লাহর আরশ পানির উপর ছিল অর্থাৎ বিশ্বের কোন কিছু সৃষ্টি করার আগে পানি সৃষ্টি করা হয়েছিল। অপরদিকে সুরা আম্বিয়ার ৩০ নং আয়াতে সরাসরি বলা হচ্ছে যে মহাবিশ্বের সকল জীবনকে পানি থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে। পানি থেকে সৃষ্টি প্রসঙ্গে আবদুল্লাহ ইউসুফ আলী তাঁর বিশ্ববিখ্যাত কোরআনের ইংরেজী অনুবাদ (The Meaning of the Qur’an) এ বলেছেন যে, এটা বৈজ্ঞানিকভাবে স্বীকার করার মত যে, মহাবিশ্বের সকল জীবনের উৎস হলো পানি। আল্লামা ইবনে হাজার আসকালানী যিনি একজন প্রখ্যাত হাদিস বিশারদ এবং ব্যাখ্যাতা তিনি তাঁর রচিত বোখারী শরীফের তাফসীর ’ফাতহুল বারীতে’ একটি হাদীস উল্লেখ করেছেন যে, ”এই মহাবিশ্বের সকল কিছু এমনকি আল্লাহ পাকের আরশ সৃষ্টির আগেই আল্লাহ পাক পানি সৃষ্টি করেছিলেন। (বিস্তারিত তথ্যের জন্য দয়া করে দেখুন, (ফাতহুল বারী, দার আল ফিকর আল আরাবী, বৈর“ত, লেবানন কতৃক প্রকাশিত, ১৯৯৩, ৬ষ্ঠ খন্ড, ৪২৯ পৃষ্ঠা।)
ফাতহুল বারীর উপরোক্ত খন্ডের ৪৩০ পৃষ্ঠায় আল্লামা ইবনে হাজার আসক্কালানী প্রসিদ্ধ সাহাবী মুজাহিদ থেকে আরো একটি হাদীস রেওয়ায়েত করেছেন যে, ”আল্লাহ পাক তাঁর আরশ, পানি এবং গ্যাস দিয়ে সৃষ্টির কাজ শুর“ করেছেন। এবং পৃথিবীর সৃষ্টি হয়েছিল পানি দিয়ে”। (ফাতহুল বারী প্রাগুক্ত ৪৩০ পৃষ্ঠা)।
এবার দেখা যাক কোরআন এবং হাদীসের উপরোক্ত মতের সাথে বিজ্ঞানের সাথে মিল বা বেমিল কোথায়। কোরান এবং হাদীসের কথাগুলোর সারাংশ হলো পৃথিবীর সৃষ্টি হয়েছে পানি থেকে বা পানি দ্বারা। কোরান এবং হাদীস কোথাও কোথাও গ্যাসের কথাও উল্লেখ করেছে। অপরদিকে বিজ্ঞানের কথাগুলোর সারাংশ হলো পৃথিবীর সৃষ্টি হয়েছে গ্যাস থেকে বিশেষতঃ হাইড্রোজেন গ্যাস বা হিলিয়াম গ্যাস থেকে।
বৈজ্ঞানিকভাবে পানি এবং হাইড্রোজেন গ্যাস সম্পর্ক হলো পানি এবং হাইড্রোজেন গ্যাস মূলতঃ একই উপাদানের দুটি ভিন্ন রুপ। পদার্থ বিজ্ঞানের মতে যে কোন পদার্থে মুলতঃ তিনটি রুপ থাকে (১)সলিড বা কঠিন (২)তরল এবং (৩) বায়বীয়। পানির কঠিন রুপ হলো বরফ, তরল রুপ হলো পানি আর বায়বীয় রুপ হলো হাইড্রোজেন এবং অক্সিজেন। সুতরাং প্রমাণিত হচ্ছে এক্ষেত্রে কোরানের বক্তব্য এবং বিজ্ঞানের মতের মধ্যে কোন পার্থক্যই নাই।
বিষয়: বিবিধ
১৪৯২ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
ধন্যবাদ
মন্তব্য করতে লগইন করুন