হাদীস যেভাবে সংরক্ষিত হল-----২
লিখেছেন লিখেছেন দ্য স্লেভ ১৪ জুন, ২০১৪, ১০:৫৪:৩৯ সকাল

খলিফা হযরত ওমর বিন আব্দুল আজিজ প্রথম হাদীস সংগ্রহ করে গ্রন্থাকারে লিপিবদ্ধ করার প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করেন। তিনি হাদীস সংগ্রহের জন্যে আবু বকর মুহাম্মদ ইবনে হাজাম(রহ
এবং সাঈদ ইবনে ইব্রাহিমকে(রহ
একাজে নিযুক্ত করেন। ফলে খলিফার এ সংক্রান্ত ঘোষণার পর সর্বপ্রথম ইবনে শিহাব যুহরী(রহ
গ্রন্থাকারে হাদীস লিপিবদ্ধ করেন। সাঈদ ইবনে ইব্রাহিম(রহ
বলেন- খলিফার নির্দেশে আমরা স্বতন্ত্র স্বতন্ত্র দফতরে হাদীস লিপিবদ্ধ করেছিলাম,এবং সেগুলো খিলাফতের প্রত্যেক অঞ্চলে প্রেরিত হয়েছিল।
(সূত্র: ইবনে আবদিল বার,জামিউ বয়ানিল ইলম-বৈরুত:দারুল জীল-১৯৭৪,পৃ-৩৬)
ওমর ইবনে আব্দুল আজিজের আদেশে সর্বপ্রথম ইবনে শিহাব যুহরী হিজরী প্রথম শতাব্দীর শেষভাগে হাদীস সংকলন করেন। এরপর থেকে হাদীস শাস্ত্রের গ্রন্থ সংখ্যা ব্যপকভাবে বাড়তে থাকে।
-(ফুতহুল বারী)
ইবনে শিহাব যুহরী’ই(রহ
সর্ব প্রথম হাদীস এবং সীরাত বা নবী চরিতকে পৃথকভাবে সন্নিবেশিত করেন। তিনি ঈমাম যুহরী নামে ইতিহাস প্রসিদ্ধ। তবে তার হাদীস গ্রন্থটি বিধিবদ্ধ নিয়ম অনুযায়ী বা রাবীদের সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা ধারার ভিত্তিতে রচিত ছিল না। সর্ব প্রথম ঈমাম মালিক(রহ
‘মুয়াত্তা’ হাদীস গ্রন্থটি বিধিবদ্ধ নিয়ম অনুযায়ী রচনা করেন বা হাদীস সংকলন করেন বলে ইতিহাসে উল্লেখ আছে। সমসাময়িক অন্যান্য প্রখ্যাত আলিমগণ হাদীস শাস্ত্রে ব্যপক অবদান রেখেছেন। ঈমাম মালিক(রহ
সহ আরও বহু প্রখ্যাত আলিম ছিলেন তার সুযোগ্য ছাত্র। ইমাম মালিকের() মুয়াত্তা হাদীস গ্রন্থ প্রথম শেণীর মর্যাদা লাভ করে। এরপর ইমাম আবু হানীফার() দুই সুযোগ্য সহচর ঈমাম মুহাম্মদ(রহ
এবং ঈমাম আবু ইউসুফ(রহ
আবু হানীফার(রহ
রেওয়ায়েতগুলো একত্র করে ‘কিতাবুল আসার’ সংকলন করেন। এ যুগের আরও কয়েকটি উল্লেখযোগ্য হাদীস সংকলন হচ্ছে- ‘জামি’-সুফিয়ান সওরী(রহ
,জামি-ইবনুল মুবারাক(রহ
,জামি-ঈমাম আওযাই(রহ
,জামি-ইবনে জুরাইজ(রহ
। পরবর্তীতে আসে বুখারী,মুসলিম,তিরিমিযি,আবু দাউদ,নেসাঈ,ইবনে মাজাহ,মুসনাদ,কিতাবুল উম্ম,ইবনে হিব্বান,ইবনে খুজাইমা,দারু কুতনী,তাবারানী ইত্যাদী প্রখ্যাত হাদীস গ্রন্থ।
পরবর্তীতে হাদীস শাস্ত্রের বিশুদ্ধতা পরিক্ষায় আসমাউর রেজাল শাস্ত্র রচিত হয়। এটি ইতিহাস পরিক্ষার এমন একটি পদ্ধতি,যা পৃথিবীর ইতিহাসে একমাত্র উদাহরণ। এখানে বর্ণনার সত্যসত্য নির্ধারনে যে পদ্ধতি ব্যবহৃত হয়েছে তার নাম উসূলুল হাদীস। এখানে উল্লেখিত আছে কি কি দোষ থাকলে বক্তব্য গৃহীত হয়না, কি কি গুণ থাকলে তা গৃহীত হতে পারে, কি কি গুনের কারনে সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয় ইত্যাদী।
যিনি ঘটনা বর্ণনা করছেন,তাকে প্রত্যক্ষদর্শী হতে হয় বা প্রত্যক্ষভাবে রসূলের(সাঃ) কাছ থেকে জানতে হয়। ঘটনা যেখানে লিপিবদ্ধ হচ্ছে সেখানে প্রথমজন থেকে শেষ পর্যন্ত বর্ণনাকারীর বিস্তারিত তথ্য,জীবনী লিপিবদ্ধ থাকে। এখানে তার ব্যক্তিগত পূর্ণাঙ্গ পরিচয়,স্বভাব-চরিত্র,জীবিকা অন্বেষনের পদ্ধতি,কখনও মিথ্যা বলেছেন কিনা,তার জ্ঞানের পরিধী,ংৎরঃর ংড়শঃর কেমন ইত্যাদী সকল বিষয়ে লিপিবদ্ধ থাকে। তার চারিত্রিক কোনো ত্রুটি পরিলক্ষিত হলে তার কাছ থেকে প্রাপ্ত সঠিক বক্তব্যও গ্রহণ করা হয়না, অথবা হলেও সেটি দূর্বল হিসেবে গ্রহণ করা হয়। এভাবে প্রত্যেকটি হাদীস অনুসন্ধান করে তার সত্যাসত্য নির্ধারণ করা যায়।
তবে কিছু কিছু হাদীস এমন আছে যেগুলোকে কোনো কোনো আলিম সঠিক বলেছেন এবং কেউ কেউ সন্দেহযুক্ত বলেছেন অথবা বাদ দিয়েছেন। এর অর্থ হল, উভয়েই এই বিষয়ে ব্যপক গবেষণা করেছেন এবং কেউ হয়ত দেখেছেন বর্ণনাকারীগণ বা রাবী তার ব্যক্তিগত কোনো বিষয়ে কখনও মিথ্যা বলেছেন বা এমন কৌশলের আশ্রয় নিয়েছেন যা উক্ত আলেম তার জ্ঞানে ভাল চোখে দেখেন না,তখন তিনি উক্ত রাবীর বর্ণনা পরিহার করেছেন। এমন ক্ষেত্রে তিনি যদি মনে করেন যে,এখানে সন্দেহের অবকাশ রয়েছে; তখন তিনি তার একটি যুক্তিসঙ্গত বা সুন্নাহসম্মত ব্যাখ্যাও দান করেন। আবার দেখা যায় একই হাদীস অনুসন্ধান করে আরেকজন আলেম তা গ্রহণ করছেন। এর কারণ হতে পারে, উক্ত রাবী হয়ত তার নিজের কোনো ব্যাপারে ছোট খাট মিথ্যা বলেছিলেন যেটি মিথ্যা হিসেবে বিবেচিত হওয়ার যোগ্য নয়, বা ততটা সীমা লঙ্ঘন করেনি,অথবা তিনি মিথ্যা বলেছেন কিনা সে ব্যাপারে হাদীস সংগ্রাহক আলিম পুরোপুরি নিশ্চিত নন,তবে রাবী পূর্ববর্তী যে সূত্র বা বর্ণনাক্রম উল্লেখ করেছেন তা পুরোপুরি সঠিক,আবার একই বিষয়ে একাধিক রাবীর বর্ণনা পাওয়া যাচ্ছে। এক্ষেত্রে উক্ত আলেম একই হাদীস গ্রহণ করছেন এবং তারও একটি যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যা দাড় করিয়েছেন। কোনো হাদীসের বর্ণনা একজন রাবীর কাছ থেকে পাওয়া গেলে সেটাকে গরীব হাদীস বলা হয়। (বিভিন্ন রকমের হাদীস রয়েছে,রাবীদের সম্পর্কে অনেক তথ্য রয়েছে,যা প্রায় প্রত্যেক হাদীসগ্রন্থের প্রথম দিকে বর্ণনা করা হয়ে থাকে,বিস্তারিত বর্ণনা আমার উদ্দেশ্য নয়)
তবে মুতাওয়াতীর হাদীস নিয়ে আপত্তি নেই। এটি হল এমন ধরনের হাদীস যার বর্ণনা রাবীগণ ভিন্ন ভিন্ন সূত্রে বর্ণনা করেন এবং তাদের একের সাথে অন্যের জানাশোনা নেই। বিষয়টা এমন- ধরুন রাস্তায় একটি দূর্ঘ্যটনা ঘটল,সেখানে দশ জন লোক প্রত্যক্ষদর্শী ছিল এবং তারা ছিল দশটি এলাকার এবং যাদের একের সাথে অন্যের কোনো সম্পর্ক ছিলনা। পরবর্তীতে উক্ত দশটি এলাকায় গিয়ে দশ জনের সাথে আলাদা আলাদাভাবে কথা বলে যদি উক্ত দূর্ঘ্যটনার ব্যাপারে তথ্য নেওয়া হয়,এবং যদি তারা সুবিস্বস্ত হয়,তাহলে তাদের বর্ণনার ভাষায় কিছু পার্থক্য থাকলেও সত্য বিষয়টি অবশ্যই জানা সম্ভব হবে। এই পদ্ধতির নাম মুতাওয়াতির। ‘শুধুমাত্র নিয়ত সম্পর্কিত বিষয়ে প্রায় ৭০০টি সনদ রয়েছে’-(তাদবীন-পৃ-৫৪)। বহু সংখ্যক মুতাওয়াতির হাদীস রয়েছে।
হাদীস শাস্ত্র নিয়ে কাজ করতে হলে আল-কুরআনের বিষয়েও ব্যপক জ্ঞান থাকা দরকার হয়। কোনো হাদীস কুরআনের কোনো আয়াতের বা ইসলামের মূল ভাবের বিরোধী হলে তা পরিত্যাগ করা হয়। এভাবে বহু উপায় উপকরণ রয়েছে হাদীসের সঠিকতা নির্ণয়ে। কিছু হাদীস রয়েছে সর্বসম্মতভাবে গ্রহণীয়, কিছু হাদীস কেউ গ্রহন করেছেন এবং কেউ কেউ করেননি, কিছু হাদীস কিছু আলিম গ্রহণ করেছেন দূর্বল হিসেবে,কিছু হাদীস মিথ্যা বা জাল প্রমানিত হওয়াতে বাতিল করা হয়েছে। কেউ হাদীস গ্রহনে অতিরিক্ত সতর্ক,আবার কেউ কিছুটা ছাড় দিয়েছেন,তবে সেগুলোকে দূর্বল/গরিব হাদীস বলেছেন। একটি ঘটনা উল্লেখ করা যায়, ইমাম বুখারী(রহঃ) বহু দূরের একটি অঞ্চলে একজন হাদীসের আলেমের কাছে গমন করলেন হাদীস সংগ্রহের জন্যে, কিন্তু তিনি তাকে দেখলেন কিছু ছোলা হাতে নিয়ে উক্ত আলিম তার ঘোড়াকে ডাকলেন এবং সেটাকে ধরলেন, কিন্তু ছোলাগুলো ঘোড়াকে খেতে দিলেন না। এটাকে ঘোড়ার সাথে প্রতারণা সাব্যস্ত করে তিনি সেই আলিমের কাছ থেকে হাদীস সংগ্রহ করা থেকে বিরত থাকলেন। আরেকবার এক আলিমের গরুর বাচ্চা মারা যাওয়াতে গরু দুধ দিবেনা এই চিন্তায় তিনি চামড়ার মধ্যে খড়কুটো ভরে গরুর সামনে রেখেছিলেন,যাতে গরু এটাকে তার বাছুর ভাবে এবং দুধ দোহনে সমস্যা না হয়। এটাকে গরুর সাথে একটি প্রতারতা আখ্যায়িত করে ঈমাম বুখারী(রহ
উক্ত আলিমের কাছ থেকে হাদীস গ্রহণ করেননি। এভাবে বহু সংখ্যক হাদীস শাস্ত্রের পন্ডিত ব্যক্তি সতর্কতা অবলম্বন করেছেন। তাদের ব্যাপারে অনেক অবিশ্বাস্য রকমের সত্য কাহিনী রয়েছে।
হাদীস শাস্ত্রে কিছু ঈমাম এমন অবদান রেখেছেন এবং এমনভাবে হাদীস সংগ্রহ করেছেন যে, তাদের ওপর সকল বিশেষজ্ঞের আস্থা রয়েছে। যেমন ঈমাম বুখারী(রহ
ও ঈমাম মুসলিম(রহ
। লক্ষ লক্ষ হাদীস থেকে তারা যে প্রক্রিয়ায় সঠিকটি বেছে নিয়েছেন তা এক কথায় অসাধারণ এবং অসম্ভব ধরনের। অতিরিক্ত কঠোরতায় তারা প্রতিটি হাদীস সন্নিবেশিত করেছেন। বুখারী ও মুসলিম হাদীস গ্রন্থের সূত্র উল্লেখ করার সময় এর পূর্বে সহীহ শব্দটি যুক্ত করা হয়, কারণ এই শাস্ত্রদ্বয়ের বিশুদ্ধতা নিয়ে আলিমদের মধ্যে দ্বিমত নেই। এছাড়া আরও অনেক হাদীস শাস্ত্র রয়েছে যার ওপর অধিকাংশ আলিমের আস্থা রয়েছে। একই হাদীস একাধিক কিতাবেও সন্নিবেশিত হয়েছে। কোনো কোনো হাদীস শাস্ত্রে মাত্র দু-একটি ছাড়া সবগুলোই সঠিক বলে প্রমানিত হয়েছে। তবে এখানেও পূর্বের বক্তব্যটি প্রদান করতে হচ্ছে। যিনি সঠিকতা নিরূপণ করছেন তিনি কোন কোন বিষয়ের ওপর গুরুত্ব দিয়ে একটি হাদীসকে গ্রহণ করছেন বা দূর্বল হিসেবে নিচ্ছেন বা পরিত্যাগ করছেন,সেটি লক্ষ্যনীয়।
এ বিষয়ে আমার ব্যক্তিগত অভিমত হল, আলিমদের মধ্যে কোনো কোনো হাদীস গ্রহণ করা না করার মধ্যে যে মতদ্বৈততা রয়েছে,তার ব্যাখ্যা আমাদের জন্যে সুফল বহন করে। কারণ এতে আমরা হাদীস শাস্ত্র নিয়ে গবেষণা করার সুযোগপ্রাপ্ত হই,সতর্ক হতে পারি। এতে উম্মাহ উপকৃত হয়। প্রখ্যাত আলেমগণ কখনই মতদ্বৈততাকে মত-বিরোধের দিকে নিয়ে যান না এবং নিয়ে যাননি। কারণ তারা জানেন সর্বোত্তম পদ্ধতিতে,অতি শ্রদ্ধার সাথে বিতর্ক করতে হয় বা নিজের মতামতকে উপস্থাপন করতে হয়,এটাই সুন্নাহ। মুসলিমের সাথে সত্য প্রচারে মতবিরোধে জড়িয়ে পড়া, অপ্রীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হারাম। যাইহোক রিজাল শাস্ত্র এমন একটি শাস্ত্র,যেখানে কোনো বাণী রসূলের(সাঃ) মূখ নিসৃত কিনা বা তার অনুমোদিত কিনা সেটা অনুসন্ধান করে খুঁজে পাওয়া সম্ভব। রিজাল শাস্ত্রটি এতটাই উৎকৃষ্ট মানের যে উচ্চারিত দু-একটি শব্দের সত্যতাও নিরূপণ করা সম্ভব।
বিষয়: বিবিধ
১৮৬৭ বার পঠিত, ২৯ টি মন্তব্য






































পাঠকের মন্তব্য:
http://www.onbangladesh.org/blog/blogdetail/detail/4370/theslave/47211#.U5vjEHJdWkw
http://www.onbangladesh.org/blog/blogdetail/detail/4370/theslave/47211#.U5vjEHJdWkw
হাদিস গবেষকদের সিন্সিয়ারিটির উদাহারনে ইমাম নব্বিকে আনতে পারেন, যিনি হাদিস সংকলন লেখায় পুরোপুরি মননিবেশের উদ্দেশ্যে বিয়েই করেন নি। উনি ফরটি হাদিস, রিয়াদুসসালেহিন ইত্যাদি সংকলন করেন।
কিন্ত ব্লগে মানুষ ফান খুজে,এসব লেখা পড়তে চায়না। ....ভাবছি লেখার শুধুমাত্র চুম্বক অংশই প্রকাশ করব। ...
কিন্ত ব্লগে মানুষ ফান খুজে,এসব লেখা পড়তে চায়না। ...
সহমত ।
????
খাওয়া দাওয়ার সময় আপনি একবার এবং আমি একবার খাবো মানে একসাথে ।
ইমাম বুখারী(রহ) ও ইমাম মুসলিম(রহ) লক্ষ লক্ষ হাদীস সংগ্রহ করে সেসব হতে বিশুদ্ধ হাদীস বাছাই করতে যে অমূল্য অবদান রেখেছেন তা অবিস্মরণীয়।
মুহাদ্দিসগণের ব্যাপক অধ্যবসায়, গবেষণা,নিরীক্ষণ ও যাছাই বাছাই সত্ত্বেও হাদীস জালিয়াতির প্রচেষ্টা থেমে নেই। সত্যানুসন্ধানীরা ও বসে নেই। এসব জালিয়াতি নিরীক্ষা করে তারা ঠিকই ধরে ফেলছেন।
রাসূল(সা) এর হাদীস যেখানে জাল করেছে জালিয়াতরা সেখানে কিছু আলেম কোন্ ভরসায় ইমামদের মাযহাবের অন্ধ অনুসরণ করেন? ইমামদের কথাতো আরো সহজে বিকৃত হয়েছে।
মন্তব্য করতে লগইন করুন