ক্যানবেরা
লিখেছেন লিখেছেন দ্য স্লেভ ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৩, ০৯:২৯:২৩ রাত
এক বরীবারে আমরা ক্যানবেরার উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। সেখানে এক আত্মীয়ের বাড়িতে দুপুরে দাওয়াত। একদিনের জন্যে এ যাত্রা। সিডনী থেকে ক্যানবেরা যেতে তিন ঘন্টা ড্রাইভ করতে হয়,এ পথের দূরত্ব তিন’শ কি:মি:। আমরা হাইওয়েতে উঠে ১১০কি:মি: গতিতে চলতে শুরু করলাম। শুনেছি একটি স্থান আছে সম্ভবত কুইন্সল্যান্ডে যেখানে নিজের ইচ্ছামত গতিতে গাড়ি চালানো যায়। সেখানে অতিরিক্ত গতিতে গাড়ি চালানোর মত একটি চমৎকার রাস্তা তৈরী করা হয়েছে। এছাড়া অন্যান্ন স্থানের রাস্তায় সর্বোচ্চ একশত বিশ কি:মি: গতিতে গাড়ি চালানো যায়।
আমরা ম্যাকডোনাল্ডসে এসে একটা বিরতি নিলাম কারণ নাতি রয়েছে। আইসক্রিম,কোক ইত্যাদী খেলাম। শেল কোম্পানীর তেলে সবসময় কিছুটা ডিসকাউন্ট থাকে তাই তেলটা সেখান থেকেই কেনা হয়। আমরা আবার রওনা হলাম। আমাদের পাশ দিয়ে কয়েকটা গাড়িকে চলে যেতে দেখলাম। কারো কারো দীল বদতমিজ,তারা গতিসীমা মানেনা,,,,মানেনা,,,,। তারা অনুমান করে বা অভিজ্ঞতা থেকে জানে কোথায় কোথায় উচ্চ গতিতে গাড়ি চালালে পুলিশ ধরবে না বা কোনো মেশিনে ধরা পড়বে না। অনেক মোটরবাইক চালককেও এটা করতে দেখা যায়। তারা উচ্চশব্দ তৈরী করে রাস্তা কাপিয়ে চলতে পছন্দ করে। তবে পুলিশও চালাকি করে। তারা এমনসব রাস্তায় ওৎ পেতে থাকে যেখানে মানুষ অনেক সময় নিশ্চিন্তে উচ্চ গতিতে চলে। আর তখন পুলিশ ধাওয়া করে তাদেরকে শাস্তির আওতায় নিয়ে আসে। এসব কিছুর চাইতে নিয়ম মেনে গাড়ি চালানো ভাল।
আমরা অতিরিক্ত চমৎকার রাস্তা ধরে এগিয়ে চললাম। এটা তিন লেনের একমুখী রাস্তা,মাঝে বিশাল একটি ফাকা স্থান ,তার ওপাশে একই রকম ফিরতি রাস্তা। মাঝের স্থানে ফাকা রাখার কারণ হল,ভবিষ্যতে যদি রাস্তা আরও চওড়া করা প্রয়োজন হয় তাহলে সেটা যাতে করা যায়। সিডনী থেকে ক্যানবেরা পর্যন্ত দীর্য তিন’শ কি:মি: রাস্তার মধ্যে মাত্র কয়েকটা ফার্ম হাউস ছাড়া আর কোনো জনবসতি নেই। দুপাশে অতিরিক্ত সুন্দর ফাকা মাঠ যা সবুজ ঘাসে পূর্ণ এবং সেখানে কিছু গাছগাছালি রয়েছে। কখনও ছোট ছোট টিলা,যা সবুজে ঢাকা। কখনও পাথুরে টিলা। কখনও রাস্তার দুপাশ ধরে পাইন,ঝাউগাছের সারি। মসৃন চকচকে রাস্তা। কখনও বড় বড় ঘাসে পরিপূর্ণ উচু নীচু উপত্যকা যেখানে গরু চরে বেড়াচ্ছে। এসব দৃশ্য ভাল না লেগে উপায় নেই। আমরা একটি সমতল ভূমির ওপর দিয়ে চলমান রাস্তা ধরে এগিয়ে চলেছি। এখানে নাকি কিছু ফলের বাগান আছে যেখানে মানুষ গিয়ে গাছ থেকে চার ঝুড়ি ফল পেড়ে দিলে এক ঝুড়ি ফ্রি। অনেকে মজা করার জন্যে সেখানে যায়।
আমরা এখন যে সমতল ভূমীর ওপর দিয়ে চলেছি সেটার ওপাশে উচু টিলা আর সে টিলার ওপর উইন্ডমিল রয়েছে। এখানে প্রচন্ড বাতাস বয় তাই বাতাশ থেকে বিদ্যুৎ তৈরীর ব্যবস্থা। আমরা এখানকার একটি লুকআউটে থামলাম। রাস্তার পাশে উচু একটি জায়গা তৈরী করা হয়েছে চারিদিকে ঘিরে। আজ রৌদ্র প্রচন্ড কিন্তু বাতাসে ফেলে দেওয়ার চেষ্টা করছে। এমনকি নাতির মাথার ক্যাপ উড়ে গেল। রেলিং পেরিয়ে সেটা নিয়ে আসলাম। এখান থেকে চারিদিকটা খুব দারুন লাগে। সমতল ভূমীর ওপর সূর্য্যরে আলো পড়ে মনে হচ্ছে এটি একটি নদী। এটাই মরিচিকা,প্রতারিত না হয়ে উপায় নেই। এখান থেকে ক্যানবেরা একেবারে কাছে।
ক্যানবেরা হল অস্ট্রেলিয়ার রাজধানী। এটি মাত্র পচিশ বছর পূর্বে তৈরী এবং খুবই পরিকল্পিত শহর। আমরা সংসদ ভবনে আসলাম। এটা খুবই চমৎকারভাবে তৈরী করা হয়েছে। এটা না দেখলে বুঝানো যাবেনা কতটা সুন্দর। এর চারিদিকে ফাকা থাকায় স্থাপত্য নিদর্শনটিকে ভালভাবে উপভোগ করা যায়। ঢাকার সংসদ ভবনটি খুবই চমৎকার কিন্তু আশপাশের অবস্থা মোটেও সুন্দর না হওয়াতে পুরোটা তেমন চোখে পড়েনা। পাশ দিয়ে হেটে গেলেও অনুভব করা যায়না যে এটা আদৌ সুন্দর কিনা। কিন্তু এখানে এই ভবন অনেক দূর থেকেই দেখা যায় এবং মূল কাঠামো দূর থেকে চোখে পড়লেই সৌন্দর্য্য আচ্ করা যায়।
আমরা ভেতরে প্রবেশ করলাম। এখানে যে কেউ’ই ঢুকতে পারে। আয়তনে এটি ঢাকার সংসদ ভবনের থেকে অনেক ছোট কিন্তু এরা সৌন্দর্য্য চর্চা করে তাই এটা অনেক বেশী সুন্দর মনে হয়। ভেতরে দামী কাঠ আর মসৃন পাথরের কারুকাজ করা রয়েছে। শ্বেত পাথরের সিড়ি বেয়ে ওপরের তলায় গেলাম। চমৎকার কার্পেট এবং কাঠের তৈরী মেঝে। ভাল লাগল। ভেতরে ইংল্যান্ডের রানী ভিক্টোরিয়ার কিছু স্মৃতিচিহ্ন রাখা আছে।
সংসদের অধিবেশন থাকায় আমরা অন্দরমহলে ঢুকতে পারলাম না। তবে সেখানকার দরজায় পাহারাদার ছিলনা,ধাক্কা দিয়ে দেখলাম তা ভেতর থেকে বন্ধ। দেখা শেষ এবার বাইরে আসলাম। এখান থেকে দূরে একটি চমৎকার স্থাপনাসহ বাগান দেখা যায়। কিন্তু আমরা দেরী করে ফেলেছি। তাই ওদিকে এবার যাওয়া হবেনা। আমাদেরকে এখন সেই আত্মীয়ের বাড়িতে যেতে হবে।
ক্যানবেরাতে আমার বন্ধু মুস্তাফা থাকে। এককালে গুলশান পার্কে বাস্কেটবল খেলেছি প্রচুর। ওর ছোটভাই মেহেদীকে খুব পছন্দ করতাম। সেও আমাকে সাংঘাতিক পছন্দ করত। সে এখন বাংলাদেশ বিমানের পাইলট হিসেবে নতুন দায়িত্ব পালন করছে। অনেকদিন পর সংবাদটি শুনে ভাল লাগল। দীর্ঘদিন ওদের সাথে যোগাযোগ ছিলনা। ওর পিতাও একই পেশায় ছিল। সেদিন গুলশান লেক পার্কে দৌড়াতে গিয়ে ওর মায়ের সাথে দেখা হল দৌড়ানো শেষে মুস্তাফার ফোন নাম্বার নিলাম। ঢাকা থেকেই তার সাথে কথা হয়েছে। আজ আসছি এটাও সে জানে। তার সাথে দেখা করতে হবে কিন্তু আমি এমন সময়সূচীর আওতায় পড়লাম যে বুঝে উঠতে পারছি না তার সাথে দেখা হবে কিনা।
আমরা আত্মীয়ের বাড়িতে আসলাম। এটা খুবই দারুন একটা বাড়ি যা দেখে আকৃষ্ট হতে হয়। এরা ধনী,তার প্রমান এখানে সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। তবে খাবার সময় অনেক রকমের প্রিয় জিনিস দেখে ভাল লাগল। গরুর কলিজা ছোট ছোট করে কেটে ভূনা করা হয়েছে। এ জিনিসটি ছোটবেলা থেকেই আমার প্রিয়। খাসির মাংস ভুনা এবং আলু দিয়ে গরুর মাংস রান্না। এগুলো এমনভাবে রান্না করা হয়েছে যে মনে হচ্ছে জীবনে প্রথমবার খাচ্ছি। বিভিন্ন রকমের শাক সব্জী,সেটাও চমৎকার। কাবাব তৈরী হয়েছে ,এ জিনিস আমার অত্যধিক পছন্দের। সাথে বিভিন্ন রকমের জুস পুরো বিষয়টাকে পরিপূর্ণ করে দিল। কিন্তু খাবার পর অনেক রকমের মজাদার মিস্টিদ্রব্য বিষয়টাকে মনোরম না করে পারল না। একেকটা খাচ্ছিলাম আর ভাবছিলাম পূর্বেরটার চাইতে বেশী ভাল। তবে এতক্ষন যেভাবে আত্মীয়ের খাবারের প্রশংসা করলাম তাতে এটাই প্রমানিত হল যে,আমি হাভাতে জাতের প্রাণী। এটার অরেক অর্থ হতে পারে যে,রান্না যদি খারাপ হত এবং যদি আমার পছন্দের খাবার রান্না না হত তাহলে আমি সেই আত্মীয়ের প্রতি মোটেও সন্তুষ্ট হতাম না। আসলে ব্যাপার সেরকম নয়।
আন্তরিকতার যে নিদর্শন দেখেছি সেখান থেকেই বলতে পারি আমি বিগলিতপ্রাণ। আমাকে ঘাস খেতে দিলেও আমি তাদের প্রশংসা করতাম। আত্মীয়তা হয় অন্তর দিয়ে। সেটার পরিচয় আমি পেয়েছি। তাদের জন্যে দোয়া রইল। সু-মহান আল্লাহ তাদেরকে পৃথিবী এবং আখিরাতের মহা-কল্যান দান করুন !
বিকেল হয়ে গেছে। আমাদের আর বেশী সময় নেই। আমরা ট্যালেস্টা টাওয়ারে আসলাম। এটি একটি উঁচু টাওয়ার সম্ভবত ১৯৩মিটার উচু। ক্যানবেরার প্রায় সকল বাড়িই নীচু শ্রেণীর বা জাতের। উচু ভবন মাত্র কয়েকটা আছে তবে তেমন উঁচু নয়। এটি ছোট শহর এবং লোকসংখ্যাও কম। টাওয়ারের ওপরে উঠে পুরো শহরটাকে দেখলাম। শহরের বিভিন্ন স্থানে জলাধর তৈরী করা হয়েছে যাতে শহরের ব্যবহৃত পানি সেখানে প্রবাহিত করা যায়। টাওয়ারের ওপর থেকে টিলাময় এবং সমতল ভূমির সমন্বয়ে গঠিত ক্যানবেরাকে দেখলাম। প্রাকৃতিকভাবেই এটি খুব সুন্দর। সন্ধ্যা হয়ে গেল। মুস্তাফা ফোন করল কিন্তু দেখা করতে পারলাম না। সে ক্যানবেরা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যায়নরত এবং ওর বড় ভাই এখানকার প্রফেসর। দু:খ প্রকাশ করে সিডনীর পথ ধরলাম। মুস্তাফার জন্যে আমার খুব খারাপ লাগল।
বিষয়: বিবিধ
১৫৫৮ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন