গিলোটিন, ফায়ারিং স্কোয়াড এবং মানুষ
লিখেছেন লিখেছেন রিদওয়ান কবির সবুজ ০৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৫, ০১:২২:১৮ রাত
১৭৮৯ সালে সংঘটিত ফরাসি বিপ্লব কে বলা হয় বিশ্বের ইতিহাসের প্রধান মোড় গুলির একটি। স্বাধিনতা,সাম্য ও ভাতৃত্ব এই স্লোগান দিয়ে ফরাসি দেশে প্রচলিত নোবেলিটি বা বুর্জোয়া সামন্ত, একই ধরনের ক্ষমতাধারি ধর্মিয় যাজকতন্ত্র এবং সকলের উর্ধে অবস্থিত রাজতন্ত্রকে উচ্ছেদ করে গনতন্ত্র স্থাপন এর উদ্দেশ্য ছিল এই বিপ্লবের। যদিও প্রকৃতপক্ষে এই বিপ্লবে অংশগ্রহনকারি সকল এর উদ্দেশ্য এক ছিলনা। এই বিপ্লবের ফলে ১৭৮৯ থেকে ১৭৯৯ সাল পর্যন্ত ফ্রান্স একটি অস্থির অবস্থা অতিক্রম করেছিল। যার মধ্যে ১৭৯৩ সাল এর সময় টিকে ঐতিহাসিক রা অভিহিত থাকেন ”রেইন অফ টেরর” বা ভয়ংকর শাসন বলে। এই সময় প্রায় বিনা বিচারে বা নামমাত্র বিচারের প্রহসন করে মৃত্যদন্ড দেওয়া হয় প্রায় ৪০০০০ এর মত মানুষকে। দন্দযুদ্ধ এবং গ্রেফতার এর সময় বাধা (ক্রসফায়ার!) এ মারা যায় আরো প্রায় সমপরিমান মানুষ। গিলোটিন আর ফরাসি বিপ্লব এখন প্রায় সমার্থক হয়ে গিয়েছে এই বিশাল হত্যাযজ্ঞের জন্য। ফরাসি বিপ্লবের প্রধান নেতা দের মধ্যে সবচেয়ে কঠোর পন্থি খ্রবেসপিয়ের ও দ্যাঁতো ছিলেন এই রেইন অফ টেরর এর প্রধান উদ্যোক্তা। ভাগ্য এই যে তারা দুজনই এক পর্যায়ে তাদের সৃষ্ট আইনের ফাঁদে পরে গিলোটিন ও ফাঁসিতে মৃত্যুবরন করেন। ফরাসি বিপ্লবের অন্যতম একটি আদর্শ ছিল ধর্মহিনতা। যেই আদর্শ ফ্রান্স এখনও বহন করছে। এবং এই কারন দেখিয়ে ফ্রান্স হিজাব কে নিষিদ্ধ করেছে। বিপ্লব এর পর পর প্রায় সকল ধর্মিয় ব্যক্তিত্ব কে হত্যা করা হয়। এমনকি বিয়ে নিষিদ্ধ করা হয়ে ছিল সল্প সময় এর জন্য হলেও! এই ধরনের বিশাল হত্যাযজ্ঞ পরিচালনা করেও সেই বিপ্লব স্থায়ি হয়নি। নেপোলিয়ান তার যোগ্যতার বলে ফ্রান্স এর এক নায়ক হিসেবে ক্ষমতা গ্রহন করেছিলেন ১৫ বছর এর মধ্যেই।
বিশ্বের ইতিহাসে দ্বিতিয় যে বিপ্লবের কথা বিশেষ ভাবে আলোচিত হয় সেটা ছিল ১৯১৭ সালের অক্টোবর এ রাশিয়া তে বলিশেভিক বিপ্লব। যদিও রাশিয়াতে সেটি ছিল দ্বিতিয় বিপ্লব। অক্টোবর বিপ্লব (মূলত বর্তমান ক্যালেন্ডার অনুযায়ি ডিসেম্বর মাস রাশিয়াতে তখন জুলিয়ান ক্যালেন্ডার অনুসরন করা হতো) তার আগে রুশ ক্যালেন্ডার এর ফেব্রুয়ারি মাসে আরেকটি বিপ্লব হয়েছিল। যে বিপ্লবের ফলে রাশিয়াতে একটি সাংবিধানিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। যদিও সেটা ছিল শুধু নিদৃষ্ট কিছূ গোষ্ঠি ও অভিজাত তন্ত্রের ভোটে নির্বাচিত। তবে সেই সময় কিন্তু গনতন্ত্রের প্রধান দুই কেন্দ্র বৃটেন ও যুক্তরাষ্ট্রের সকল মানুষের ভোটাধিকার প্রতিষ্টিত হয়নি। কিন্তু লেলিন ও ষ্টালিন এর নেতৃত্বাধিন রাশিয়ান সোস্যালিষ্ট পার্টি সেই সরকার কে সামরিক বাহিনির সমর্থনে উচ্ছেদ করে। একটি বিশেষ অনুধাবন এর বিষয় হচ্ছে যে এই বিপ্লব কিন্তু বিশাল রাশিয়া ব্যাপি কোন বিপ্লব ছিলনা। ছিল শুধু মস্কো ভিত্তিক। রাশিয়ার সর্বময় ক্ষমতার অধিকারি জার এর আগেই সাইবেরিয়াতে নির্বাসিত হয়েছিলেন। আর রাশিয়ার বেশিরভাগ সৈনিক ই তখন ১ম বিশ্বযুদ্ধে নিযুক্ত বিভিন্ন ফ্রন্টে। সেনাবাহিনির একটি অংশ ও প্রশিক্ষিতি রেডগার্ড দের নিয়ে গঠিত এই সরকারের বাহিনি বিশ্বযুদ্ধের সুযোগে রাশিয়ার বিস্তির্ন অঞ্চল দখল করে নেয়। ১ম বিশ্বযুদ্ধ সমাপ্তির পর এই বিপ্লবকে রক্ষা করার জন্য লেলিন এবং তার প্রধান সহযোগি ষ্টালিন এক ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেন। তারা গ্রাস করেন রাশিয়ার প্রতিবেশি মধ্য এশিয়া এবং বাল্টিক সাগর এর রাষ্ট্রগুলি। লেলিন এর মৃত্যুর পর ষ্টালিন সোভিয়েট ইউনিয়ন এর প্রায় ২০ লক্ষ মানুষ কে হত্যা করেন এবং এর দ্বিগুন মানুষকে প্রেরন করেন সাইবেরিয়ার শ্রম শিবিরে। এই বিশাল হত্যাযজ্ঞ চালিয়েও সোভিয়েট ইউনিয়ন টিকে থাকতে পারেনি। ১৯৯১ সালে এর চুড়ান্ত পতন ঘটে। ২০১৫ সালে যার ২৫ বছর পুর্তি হতে যাচ্ছে।
পৃথিবির ইতিহাসের প্রথম এবং একমাত্র রাষ্ট্রিয়ভাবে ধর্মহিন বা নাস্তিক বলে ঘোষিত রাষ্ট্র ছিল আলবেনিয়া। একসময় তুর্কি সাম্রাজ্যের অধিন মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ট এই দেশ টিতেও দ্বিতিয় মহাযুদ্ধের সুযোগে রুশ সহায়তায় এনভার হোজ্জা নামের এক ব্যাক্তি ক্ষমতা দখল করেন। প্রায় চল্লিশ বছর এর শাসন কালে এই ব্যাক্তি ধর্মকে আলবেনিয়া থেকে উচ্ছেদ করার জন্য সবকিছু করেন। এমনকি নাম রাখাও নিষিদ্ধ করেন! নতুন ধর্মহিন নামের তৈরি ও করেন তিনি। তার ক্ষমতায় আসার সময় আলবেনিয়াতে ৩০০ এর বেশি ক্যাথলিক খৃষ্টান যাজক ছিলেন যার মধ্যে মাত্র ৩০ জন জিবিত অবস্থায় পালাতে পেরেছিলেন। মুসলিম আলিমদের অবস্থা তার চেয়েও খারাপ ছিল। ধর্মহিনতা প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে এই ব্যাক্তি বিজ্ঞান এর অনেক বিখ্যাত ব্যাক্তির নামও মুছে দিতে চেয়েছিলেন । একটি সত্য ঘটনা ছিল সেই সময় আলবেনিয়ার পদার্থবিজ্ঞান বিষয়ে ও এই বিষয়ে এনভার হোজার অবদান সম্পর্কে পড়ান হতো! একাধিকবার নিজের প্রধান সহযোগি সহ নিজের পার্টির সদস্যদেরও হত্যা করেছিলেন এই অত্যাচারি একনায়ক। ১৯৮৫ সালে মৃত্য বরন করার পর হঠাত করেই দেখা যায় একক কতৃত্বে পরিচালিত এই আলবেনিয়া অর্থনৈতিকভাবে সম্পুর্ন ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। সেই সময় যে রাজনৈতিক সমস্যা দেখা দিয়েছিল তা থেকে এখনও মুক্ত হতে পারেনি আলবেনিয়া।
এই তিনটি উদাহরন থেকে কয়েকটি শিক্ষা নেওয়া উচিত আমাদের। প্রথম টি হচ্ছে ধর্মের জন্য যত মানুষ হত্যা হয়েছে ধর্মবিরোধিতার জন্য হত্যা হয়েছে তারও অনেক বেশি। বস্ততপক্ষে কম্যুনিজম কখনই কোথাও জনগনের সমর্থন নিয়ে কায়েম হয়নি। আর ধর্মহিনতা বা ধর্মনিরপেক্ষতা কোথাও প্রকৃত উন্নয়ন ঘটাতে পারেনি। ফ্রান্স হিজাবের ব্যাপারে যতই ধর্মনিরপেক্ষতা দেখাক প্রকৃত প্রস্তাবে তারা যথেষ্ট ধর্মানুসারি খৃষ্ট ধর্মের ক্ষেত্রে। আরেকটি শিক্ষা হচ্ছে অত্যাচারি শাসক রা যতই নিজেদের সব কিছু থেকে নিরাপদ মনে করুন কিন্তু তাদের সাম্রাজ্যও একদিন ভেঙ্গে পরতে বাধ্য। সত্যকে গ্রহন করতে সাধারন মানুষ বিলম্ব করেনা। রাষ্ট্র যতই ক্ষমতা প্রয়োগ করুক মানুষের হৃদয়কে সে কখনই জয় করতে পারেনা।
বিষয়: বিবিধ
১৯২১ বার পঠিত, ২৪ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
ধন্যবাদ মন্তব্যটির জন্য।
অনেক ধন্যবাদ সুন্দর মন্তব্যটির জন্য।
খুব কম মানুষই পারে এর প্রভাব থেকে বের হতে।
একশতভাগ প্রমানিত সত্য উদাহরণ তুলে ধরেছেন, অনেক ধন্যবাদ
অনেক অনেক ধন্যবাদ অনেক কিছু জানলাম ।
সত্যি অনেক না জানা বিষয় জানলাম।
শুকরিয়া ভাইয়া।
ইতিহাস থেকে শিক্ষা না নিয়ে মানুষ ইতিহাসে নিন্দিত হয়।
বা একটা পোষ্ট দিতে পারেন।
আমি বই সংগ্রহ করছি তো তাই।
জাজাকাল্লাহু খাইরান।
ধন্যবাদ।
এটা হাসিনারও জানা উচিত।
অর্থ দিয়ে ক্রিতদাসের হাসি কেনা যা্য়না।
মন্তব্য করতে লগইন করুন