তুমি ছিলে গো মোর প্রার্থনায়
লিখেছেন লিখেছেন রেহনুমা বিনত আনিস ২০ মে, ২০১৪, ১২:০৯:১১ দুপুর
ক্যাল্গেরী ডাউনটাউন মূলত ক্ষুদ্র একটি বাণিজ্যিক এবং প্রশাসনিক এলাকা। এই অল্প জায়গাতেই বেশ কয়েকটি মসজিদ রয়েছে যার প্রত্যেকটিতে প্রাত্যহিক এবং জুমার নামাজ হয়। মসজিদগুলো বেশ প্রশস্ত হলেও ডাউনটাউনে কর্মরত মুসলিমদের সংখ্যাধিক্যের কারণে প্রতি শুক্রবার মসজিদগুলোতে শুক্রবারে অন্তত দু’টো করে জামাত হয়। এক জামাত শেষ হবার আগেই পরবর্তী জামাতের জন্য রাস্তায় মুসল্লীদের লাইন লেগে যায়। আমার অফিসের পাশের বিল্ডিংয়েই মসজিদ। এই মসজিদের খুতবা বেশ ভাল হয়, যদিও আমার বাসার কাছে আকরাম জুমা, যেটি ক্যাল্গেরীর সবচেয়ে বড় মসজিদ, তেমন নয়। এই মসজিদের ইমাম সাহেব এক শুক্রবার খুতবায় এই গল্পটি বলেছিলেন, দু'আর তাৎপর্য বুঝানোর জন্য। জীবন থেকে নেয়া গল্পটি অসম্ভব ভাল লেগেছিল। বিশেষ করে যেহেতু পরে এই গল্পের পাত্র পাত্রীর সাথে দেখা হয়েছিল।
ইমাম সাহেব বললেন, একবার একজন শ্বেতাঙ্গ ক্যানাডিয়ান নও মুসলিম ইসলাম গ্রহনের পর ইসলামের মূলনীতি এবং চর্চার ওপর সপ্তাহব্যাপী ট্রেনিং সম্পন্ন করলেন। তিনি বিদায় নেয়ার সময় ইমাম সাহেব তাঁকে আশ্বাস দিলেন এর পরেও আর কোন সাহায্য লাগলে তিনি সহযোগিতা করতে চেষ্টা করবেন। তখন নতুন ভাইটি বললেন, ‘আপনি আমাকে একটি বিষয়ে সাহায্য করতে পারেন’।
ইমাম সাহেব উৎসুক হয়ে বললেন, ‘বলুন, আমি আপনার জন্য কি করতে পারি’।
নতুন ভাইটি বললেন, ‘আমার একজন স্ত্রী প্রয়োজন’।
ইমাম সাহেব বললেন, ‘আমাদের প্রচুর অবিবাহিতা মুসলিমা বোন রয়েছেন, সুতরাং সমস্যা হবেনা ইনশা আল্লাহ। আপনি স্ত্রী হিসেবে কি ধরনের মেয়ে পছন্দ করেন?’
ভাইটি বললেন, ‘আমি একজন কুর’আনে হাফেজাকে বিয়ে করতে ইচ্ছুক যেন তিনি আমাকে বিশুদ্ধভাবে কুর'আন পড়তে সহযোগিতা করতে পারেন’।
ইমাম সাহেব মনে মনে ভাবলেন, ‘একজন শ্বেতাঙ্গ নও মুসলিমকে এমন মেয়ে কেন বিয়ে করবে যে কুর’আনে হাফেজা?’ কিন্তু তিনি সেটা প্রকাশ না করে বললেন, ‘আপনার আর কোন পছন্দ অপছন্দ আছে কি?’
তখন ভাইটি জানালেন তিনি একজন আরবী মেয়ে বিয়ে করতে ইচ্ছুক যেন স্ত্রীর কাছে আরবী শিখে তিনি কুর'আনকে এর অরিজিনাল ভাষায় বুঝতে শিখতে পারেন।
ইমাম সাহেব মুখে কিছু না বললেও মনে মনে প্রমাদ গুনলেন, একজন শ্বেতাঙ্গ নও মুসলিমের জন্য এমন মেয়ে জোগাড় করা অসম্ভব ব্যাপার। কিন্তু তিনি ভাইটিকে নিরাশ করতে চাইলেন না, তাই তিনি খুঁজবেন বলে আশ্বাস দিয়ে ভাইটিকে বিদায় জানালেন।
এর এক সপ্তাহ পর ভাইটির সাথে ইমাম সাহেবের দেখা হোল। তিনি মনে মনে ভাবছিলেন তাঁকে কি বলা যায়। কিন্তু ভাইটি তাঁকে সুখবর দিলেন, তিনি বিয়ে করেছেন। ইমাম সাহেব হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। তিনি কথায় কথায় জিজ্ঞেস করলেন কার সাথে বিয়ে হোল, মেয়ে কেমন ইত্যাদি। নতুন ভাইটির জবাব শুনে ইমাম সাহেব হতভম্ব হয়ে গেলেন। তিনি বিয়ে করেছেন যাকে তিনি কুর’আনে হাফেজা, আরবীভাষী। ইমাম সাহেব তাঁকে ধরলেন, এই অসাধ্য কিভাবে সাধন হোল তা তাঁকে বলতেই হবে। তখন তিনি জানালেন, ইসলাম গ্রহণ করার আগে থেকেই তিনি শয়নে স্বপনে জাগরনে আল্লাহর কাছে এমন একজন সঙ্গিনীর জন্য দু’আ করতেন যে আল্লাহর পথে তাঁর সাথী হবে। তখনই তিনি সাব্যাস্ত করেন এমন মেয়েই তাঁর প্রয়োজন যে তাঁকে কুর’আনের অর্থ বুঝতে সহায়তা করবে, যেন তিনি আল্লাহর নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে পারেন। দিনের ব্যাস্ততায়, অবসরে, রাতে ঘুম ভেঙ্গে গেলে, প্রতিটি মূহূর্তে তিনি আল্লাহর কাছে এমন একজন সঙ্গিনীর জন্য প্রার্থনা করতেন। ইসলাম কবুল করার দিন কয়েকের ভেতর আল্লাহ তাঁর এই দু’আ কবুল করেন। এমন মেয়েও পাওয়া গেল যে একজন নও মুসলিমকে পথ দেখাতে আগ্রহী, এমন পরিবারও পাওয়া গেল যারা একজন সাধারন নও মুসলিমকে নিজেদের পরিবারের অংশ হিসেবে কবুল করে নিতে ইচ্ছুক।
এর কিছুদিন পর ‘ওয়ান উম্মাহ কনফারেন্সে’ এই দম্পতির সাথে আমাদের পরিচয় হয়। ভাইটি নিজের অভিজ্ঞতার ফলে বুঝতে পারেন নও মুসলিমদের ইসলাম শিক্ষার জন্য কতখানি সাহায্য প্রয়োজন। সুতরাং, তিনি এবং তাঁর স্ত্রী মিলে একটি সংস্থা গড়ে তোলেন যারা নও মুসলিমদের শিক্ষাগত, মানসিক, আর্থিক ইত্যাদি সকলপ্রকার সহযোগিতা প্রদান করে। কারণ যারা নতুন নতুন ইসলাম গ্রহণ করে এরা অধিকাংশই সামাজিক, পারিবারিক এবং অন্যান্য অনেক দিক থেকে নিগ্রহের শিকার হয়ে থাকে। আমরা জানালাম আমরা তাঁদের যেকোনপ্রকার সাহায্য করতে প্রস্তুত। পাশাপাশি তখন আমরা বাচ্চাদের একটি অনুষ্ঠান আয়োজন করছিলাম। তাঁদের অনুরোধ করলাম সেখানে ভাইটির ইসলাম গ্রহনের কাহিনী বর্ণনা করতে।
এর একমাস পর তাঁরা আমাদের বাসায় আসেন; ষাটজন বাচ্চার সামনে ভাইটি তাঁর ইসলাম গ্রহনের কাহিনী, কার্যকারণ, ফলাফল এবং অনুভূতি তুলে ধরেন। এক পর্যায়ে তিনি টিনেজ ছেলেমেয়েদের বলেন, তিনি যখন অমুসলিম ছিলেন তখনও তিনি সামাজিক গড্ডালিকা প্রবাহে ভেসে না গিয়ে নিজের সততা বজায় রাখেন, তাঁর কখনোই কোন গার্লফ্রেন্ড ছিলোনা, বরং তিনি নানাবিধ সমাজসেবা এবং সচেতনতামূলক কাজের সাথে নিজেকে জড়িত রাখেন, ইউনিভার্সিটির পড়াশোনা এবং কল্যাণকর উদ্যোগসমূহে নিজেকে নিয়োজিত করেন এবং সত্য পথ অনুসন্ধানে নিজেকে ব্যাপৃত করেন। ফলে তিনি যখন ইসলাম গ্রহণ করেন তখন তিনি এর সুফল লাভ করতে শুরু করেন। তাঁর স্ত্রীও বাচ্চাদের জানান, তিনি নিজেকে সৌভাগ্যবতী মনে করেন যে তাঁর স্বামী তাঁর আগে অন্য কোন মেয়ের সাথে সম্পর্কিত ছিলোনা, তিনি এমন একজনের স্ত্রী যিনি বিয়ের আগে এবং পরে উভয় অবস্থাতেই তাঁর প্রতি বিশ্বস্ত ছিলেন। আমাদের ছেলেমেয়েরা যারা এই সমাজে নিজেদের সততা বজায় রাখতে হিমশিম খায় তারা এই বক্তব্যে উজ্জীবিত বোধ করে, বুঝতে পারে- সবুরে মেওয়া ফলে, অতীব মিষ্ট এবং প্রাচুর্যময় মেওয়া।
সুতরাং, যারা উত্তম সঙ্গী চান তাঁদের জন্য দু’আর কোন বিকল্প নেই, কারণ শ্রেষ্ঠ নির্বাচক তো তিনিই যিনি আমাদের পরস্পরকে সৃষ্টি করেছেন জুটি হিসেবে। পাশাপাশি বিশ্বস্ততা কেবল বিয়ের পরেই নয়, বিয়ের আগেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি ব্যাপার- মানসিক, শারীরিক, চারিত্রিক সকল দিক থেকে, কারণ নইলে আমরা এমন একজনের সাথে জড়িয়ে পড়তে পারি যে আদতেই আমাদের উপযুক্ত সঙ্গী নয়, ফলশ্রুতিতে বিয়ের পর বাকী জীবন কেটে যেতে পারে হা হুতাশ এবং না পাওয়ার বেদনায়। বিয়ের ব্যাপারে এমন দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে অগ্রসর হলে আমরাও পেতে পারি আমাদের কাঙ্খিত সেই উত্তম সঙ্গী। তবে আমাদের প্রাপ্তি নির্ভর করে আমাদের প্রচেষ্টা, সততা এবং নিয়াতের শুদ্ধতার ওপর।
(আমার পূর্ববর্তী পোস্টের ৫৭ নং মন্তব্যের জবাবটি এভাবে দেয়াই সঙ্গত মনে হোল, হয়ত কেউ এতে ভাল কিছু খুঁজে পেতে পারেন)
বিষয়: বিবিধ
১৯৩৬ বার পঠিত, ৩৪ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
"তবে আমাদের প্রাপ্তি নির্ভর করে আমাদের প্রচেষ্টা, সততা এবং নিয়াতের শুদ্ধতার ওপর।"
বিয়ের আগে কিভাবে জানা সম্ভব? জানতে হলে কি করা উচিত, কতটুকু?
মানুষের পক্ষে কিছুই কি নিশ্চিত করে জানা সম্ভব? তাই তো দু'আর প্রয়োজন, যেন যিনি সব জানেন তিনি আমাদের নিরাপদ রাখেন। পাশাপাশি আমাদের বলা হয়েছে যে দু'জন ব্যাক্তি পরস্পরের সাথে সংসার করবে তারা যেন পরস্পরের সাথে কথা বলে একে অপরের মানসিকতা যাচাই করে নেয়। আমাদের বিয়েগুলোতে এখন মানসিকতা ছাড়া আর সবই যাচাই করে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। তবে সবচেয়ে কার্যকর হোল নিজের আচরণ নিয়ন্ত্রণ করা যেন আল্লাহ আমাদের ওপর অসন্তুষ্ট হয়ে বিয়েকে আমাদের জন্য শাস্তি বানিয়ে না দেন।
@ হ্যারিঃ আপনি সাইজ দেখে পোস্ট পড়েন! তাহলে মান কোন ব্যাপার না
অমন করেন কেন আপু? আমার মাথায় এখন কিরকম করতেছে আমিতো বয়সে জ্ঞানে সবদিকথেকেই ছোট্ট.... বুঝিয়ে বলেন প্লীজ...
সুন্দর ঘটনাটা শেয়ার করার জন্য ধন্যবাদ আপু আপনাকে
------------------------
@রেহনুমাপু - কোন চিন্তা নাই আমার প্রশ্নের জবাবা চাই ই চাই। আমি কানাডায় আসলে অথাবা আপনি দেশে আসলে সামনাসামনি ক্ল্যারিফাই করেদেবেন
@হারিকেন: প্রশ্নে এত প্যাঁচ কেন? আমি তো প্রশ্নই ঠিকমত বুঝতে পারছিনা: হারিকেন আপনার বিবাহ বিষয়ক মাসলা–মাসায়েল বই কই! খুঁজে দেখেন। না বুঝলে রেহনুমাপুর দেশে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে
আর আগেই বলেছি আমাদের দেশের নারিরা বিয়ের আগে থাকে এক রকম পরে একেবাড়ে ১৮০ ডিগ্রি উল্টা!!
একটি ব্যাক্তিগত তিক্ত অভিজ্ঞতা দিয়ে সারা দেশকে যাচাই করে ফেললে? তাহলে হতভাগার আর দোষ কি?
জাযাকাল্লাহ, আল্লাহ আপনার মেধা ও মননে আরো বরকত দিন। অনেকদিন আমাদের ভাই সাহেবের দেখা সাক্ষাৎ নেই। উনি কি ব্লগের উপর রাগ না কি আমাদের উপর??
তবে এই নামে নয় "ফাতিমা" নিক নিয়ে...
ব্লগ বাড়ি চেন্জ করার আইডিয়াটা পেলাম রোজারু আপিদের কাছ থেকে... এখন থেকে আমরা দুইজন একই ব্লগ বাড়িতে...
মন্তব্য করতে লগইন করুন