মহানবীর (স) মিরাজঃ মানবজাতির জন্য ১৪ দফা নির্দেশ এবং নামায কায়েমের বিধান [পর্ব-১]
লিখেছেন লিখেছেন ইঞ্জিঃ আবুল হোসেন রহমতুল্লাহ ২১ জুন, ২০১৩, ০৭:০৬:৩১ সন্ধ্যা

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম। সমস্ত প্রশংসা একমাত্র আল্লাহর এবং আল্লাহর অনুগ্রহ ও সাল।ম নবীদের নেতা বিশ্বনবী (স), তাঁর পরিবারবর্গ ও তার সাহাবীদের প্রতি।
[এ লেখাটি গত বছর রজব মাসে মহানবীর (স) মিরাজ উপলক্ষে ৪টি পর্বে ধারাবাহিকভাবে ফেসবুকে এবং সোনার বাংলাদেশ ব্লগ ওয়েব সাইট পত্রিকায় প্রকাশ হয়েছিল। মহান আল্লাহর দয়ায় এ বছর মহানবীর (স) মিরাজ উপলক্ষে আবার তা নতুন আঙ্গিকে প্রকাশ করার ইচ্ছা করলাম এবং মহান আল্লাহর সাহায্য কামনা করছি।]
প্রতি বছর ২৭ রজব আসলেই শবে মিরাজ উপলক্ষে মহানবীর (স) মিরাজের অলৌকিক ঘটনা ও ভ্রমন কাহিনী নিয়ে অনেক আলোচনা, মসজিদে রাত জেগে নফল নামাজ, জিকির এমন কি সরকারী অফিসে ঐচ্ছিক ছুটি ও স্কুল কলেজ বন্ধ থাকে। কিন্তু যে উদ্দেশ্যে মহানবীর (স) মিরাজে গিয়েছিলেন এবং সেখান থেকে পৃথিবীতে ফেরত এসে আমাদের জন্য কি নির্দেশ নিয়ে এসেছেন তা আমরা অনেকেই জানার চেষ্টা করি না এবং না জানার কারনে বাস্তবে পালন করি না।
বর্তমান যুগে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অনেক উন্নতি হওয়ায় এবং নতুন নতুন অনেক বৈজ্ঞানিক থিওরী আবিস্কৃত হওয়ায় বিজ্ঞানের একজন ছাত্র হিসাবে শুধুমাত্র মিরাজের বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষন নিয়ে শত শত পাতার রচনা লেখা যাবে ইনশাআল্লাহ; কিন্তু তাতে মহানবীর (স) মিরাজের উদ্দেশ্য সম্পর্কে তেমন কিছুই জানা যাবে না। তা ছাড়া মিরাজের বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষন নিয়ে দেশী বিদেশী বিভিন্ন ভাষায় ইতিমধ্যে অনেক গবেষণাধর্মী নিবন্ধ ও বই প্রকাশ হয়েছে। তাই ওদিকে আর যেতে চাই না, আজ মহানবীর (স) মিরাজের উদ্দেশ্য, আল্লাহর পক্ষ থেকে তিনি যে ১৪ দফা নির্দেশ এবং নামাজ কায়েমের বিধান নিয়ে এসেছেন এ তিনটি বিষয় শুধু সংক্ষেপে তুলে ধরতে চাই, যেন আমি সহ সবাই তা বাস্তবে পালন করতে পারি।
মহানবীর (স) মিরাজের ঘটনা কালঃ
যে রাতে মহান আল্লাহ বিশ্বনেতা মহানবীকে (স) বিশেষ ব্যবস্থায় তাঁর কাছে নিয়ে যান এবং পৃথিবী থেকে আল্লাহর আরশ পর্যন্ত ভ্রমন করান, আল্লাহর পরম সান্নিধ্য এনে তাঁর সাথে কথা বলেন, জান্নাত ও জাহান্নাম সহ বিভিন্ন নিদর্শন দর্শন করান সেই রাতকে ইসলামের পরিভাষায় ‘লাইলাতুল মিরাজ’, ফারসীতে ‘শবে মেরাজ’ এবং বাংলায় ‘মেরাজের রজনী’ বলা হয়।
মহানবী (স) ফেরেস্তা জিবরাইলের (আ) সাথে ‘বোরাক’ নামক যানবাহনে মক্কার মসজিদুল হারাম বাইতুল্লাহ (কাবা শরীফ) থেকে জেরুজালেমের মসজিদুল আকসা ভ্রমণ এবং সেখান থেকে ‘রফরফ’ নামক যানবাহনে উর্ধ্বলোকে মহাশূন্য ভ্রমন করেছন।
এই মিরাজ কবে সংঘটিত হয়েছিলো এ সম্পর্কে সীরাত রচয়িতা এবং ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে। যেমন-
(১) তিবরানী বলেছেনঃ যে বছর রসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে নবুয়ত দেয়া হয় সে বছরই।
(২) ইমাম নববী ও ইমাম কুরতবী লিখেছেনঃ নবুয়তের পাঁচ বছর পর।
(৩) হিজরতের ষোল মাস আগে অর্থ্যাৎ নবুয়তের দ্বাদশ বছরে রমযান মাসে।
(৪) নবুয়তের দশম বর্ষের ২৭শে রজব। আল্লামা মুনসুরী এ অভিমত গ্রহণ করেছেন।
(৫) হিজরতের আগে এক বছর দুই মাস আগে, অর্থ্যাৎ নবুয়তের ১৩তম বর্ষের মহররম মাসে।
(৬) হিজরতের এক বছর আগে অর্থ্যাৎ নবুয়তের ১৩তম বর্ষের রবিউল আউয়াল মাসে।
ঐতিহাসিক ঘটনাক্রম এবং সূরা বনী ঈসরাইল নাযিলের সময়কাল ও পটভূমি বিশ্লেষন করে উল্লেখিত বক্তব্য ও মতামত সমুহের মধ্যে অধিকাংশের মতে নবুয়তের দশম বর্ষের ২৭শে রজব মিরাজ সংঘটিত হয়েছিল বলে ধারনা করা হয়।
এখানে একটি বিষয় আমাদেরকে অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে, যদি শবে মিরাজ আনুষ্ঠানিক ভাবে পালনের নিয়ম থাকতো তা হলে মিরাজের ঘটনার সময়কাল নিয়ে এতগুলি মত ও বক্তব্য আসতো না, রাসুলু্ল্লাহ (স) অবশ্যই নির্দিষ্ট দিন তারিখ উল্লেখ সহ নির্দেশ দিতেন। যেমন শবে কদর, ঈদুল ফিতর, ঈদুল আযহা, হজ্জ ইত্যাদি নির্দিষ্ট দিন তারিখ উল্লেখ সহ আনুষ্ঠানিক ভাবে পালনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বিধায় এসব আনুষ্ঠানিক ইবাদতের সময় কাল ও তারিখ সম্পর্কে কোন মতবিরোধ নাই।
অতএব শবে মিরাজ আনুষ্ঠানিক ভাবে পালনের জন্য নয় যেভাবে আমরা পালন করে থাকি এবং কবে কোন বছর কত তারিখে মিরাজ ঘটেছিল সেটা মূল বিষয় নয়। মূল বিষয় হল, যে উদ্দেশ্যে মহানবী (স) মিরাজে গিয়েছিলেন সেই উদ্দেশ্য ও শিক্ষা বাস্তব জীবনে পালন করা এবং তা কেবল মাত্র বছরের নির্দিষ্ট একটি দিন বা রাতে নয়, প্রতিদিন ও সারাজীবন তা পালন করতে হবে।
মহানবীর (স) মিরাজের উদ্দেশ্য
প্রতি বছর শবে মিরাজ উপলক্ষে মহানবীর (স) মিরাজের অলৌকিক ঘটনা ও ভ্রমন কাহিনী নিয়ে অনেক আলোচনা হলেও মিরাজের উদ্দেশ্য নিয়ে আলোচনা তেমন দেখা যায় না। অথচ দৈনন্দিক জীবনে আমারা উদ্দেশ্য ছাড়া কোন কাজই করি না এবং যে কোন কাজ করার পূর্বে ঐ কাজের উদ্দেশ্য ভালভাবেই জেনে নেই, এতবড় শেয়ানা আমরা! যেমন ধরুন যদি প্রশ্ন করা হয় মানুষ ঘর বাড়ী বানায় কেন এবং তার উত্তরে যদি বলা হয় স্থাপত্য শিল্প প্রকাশের জন্য যাতে ঐ ঘর বাড়ীর স্থাপত্য সৌন্দর্য্য দেখে মানুষ মুগ্দ হয়ে যায়, এটাই কি ঘর বাড়ী বানাবার উদ্দেশ্য? তাহলে ভাঙ্গা কুড়ে ঘরে এমন কি স্থাপত্য সৌন্দর্য্য আছে? স্থাপত্য শিল্প প্রকাশ যদি একমাত্র উদ্দেশ্য হয়ে থাকে তাহলে যে সব গরীব লোক দুবেলা খাবার কেনার পয়সা পায় না তারা কোন যুক্তিতে কষ্ট পরিশ্রম করে ও টাকা ধার দেনা করে কুড়ে ঘর বানাবে? কুড়ে ঘর বানাোর পিছনে ঐ টাকা বেহুদা খরচ না করে খাবার কিনে পেট ভরতে পারে এবং বাইরে খোলা যায়গায় বসবাস করতে পারে। ঘর বাড়ী বানাবার মূল উদ্দেশ্য হল রোদ বৃষ্টি থেকে বেচেঁ থেকে নিরাপদে বসবাস করা, আর এ মূল উদ্দেশ্য নিয়েই ধনী গরীব সবাই যার যার সামর্থ্য অনুযায়ী ঘর বাড়ী বানায়, আর যার টাকা পয়সা ও সামর্থ্য বেশী সে আরো অনেক টাকা খরচ করে চোখ ধাঁধানো স্থাপত্য সৌন্দর্য্য যোগ করে তার বাড়ীটি তৈরী করে। ঘর বাড়ী বানাবার মূল এ উদ্দেশ্য একজন পাগল এবং অবুঝ শিশুও বুঝে; অথচ এর চেয়েও হাজার গুন বেশী অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় মহানবীর (স) মিরাজের উদ্দেশ্য আমরা অনেকেই বুঝি না এবং জানারও চেষ্টা করি না।
মনে করুন বানিয়াচং থানার ওসিকে পুলিশের আইজি ঢাকা পুলিশ হেড কোয়ার্টারে ডেকে তার সাথে সাক্ষাতের ব্যবস্থা করল, পুলিশ প্রশিক্ষন কেন্দ্র ঘুরে দেখান হল, অপরাধীদেরকে কিভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হয় তা শেখানোর জন্য কেন্দ্রীয় তদন্ত দপ্তর পরিদর্শন করে কিছু অপরাধীদের অবস্থা দেখনো হল এবং সব শেষে একটি কাগজে কয়েকটি নির্দেশনামা হাতে দিয়ে বলা হল বানিয়াচং থানার সব পুলিশ সদস্যরা যেন এই নির্দেশগুলি মেনে চলে। এপর ঐ ওসি বানিয়াচং থানায় ফিরে গিয়ে বানিয়াচং থেকে সিলেট পর্যন্ত কিছু দূরত্ব টেম্পু ও কিছু দূরত্ব বাসে ভ্রমন করে সিলেট থেকে ঢাকা পর্যন্ত উড়োজাহাজে এবং ঢাকা বিমান বন্দর থেকে পুলিশ হেড কোয়ার্টার পর্যন্ত ট্যাক্সিতে ভ্রমন করল, ভ্রমন পথে কি কি দেখল, ঢাকায় কোথায় কোথায় পরিদর্শন করল ও কি কি দেখল বিস্তারিত বর্ননা করার পর আইজির নির্দেশনামা পড়ে শুনিয়ে প্রত্যেক পুলিশ সদস্যদের এক কপি করে দিল। এখন যদি ঐ বানিয়াচং থানার পুলিশ সদস্যরা আইজির নির্দেশনামা ফাইলে অথবা টেবিলের ড্রয়ারে যত্ন করে রেখে দিয়ে শুধু ওসির ভ্রমন কাহিনী বর্ননা করতে থাকে আর নির্দেশনামার নির্দেশগুলি আদৌ পালন না করে, তা হলে পুলিশের আইজি কি তাদের উপর সন্তুষ্ট হয়ে পুরস্কৃত করবে? না কি চরম অসন্তুষ্ট হয়ে চাকরী থেকে বরখাস্ত করে উপযুক্ত শাস্তি দেবে?
আমাদের অবস্থাও হয়েছে ঠিক তাই। প্রতি বছর ২৭ রজব আসলেই শবে মিরাজ উপলক্ষে মহানবীর (স) মিরাজের অলৌকিক ঘটনা ও ভ্রমন কাহিনী নিয়ে অনেক আলোচনা, মসজিদে রাত জেগে নফল নামাজ, জিকির এমন কি সরকারী অফিসে ঐচ্ছিক ছুটি ও স্কুল কলেজ বন্ধ থাকে। কিন্তু যে উদ্দেশ্যে মহানবীর (স) মিরাজে গিয়েছিলেন এবং সেখান থেকে পৃথিবীতে ফেরত এসে আমাদের জন্য কি কি নির্দেশ নিয়ে এসেছেন তা আমরা অনেকেই জানার চেষ্টা করি না এবং না জানার কারনে বাস্তবে পালনও করি না।
মহানবীর (স) মিরাজের উদ্দেশ্য কি ছিল? আসুন কুরআন শরীফে আল্লাহ কি বলেন তা জেনে নেই। কুরআন শরীফে আল্লাহ বলেন, "পবিত্র তিনি (আল্লাহ) যিনি নিজের এক বান্দাকে নিয়ে গেছেন এক রাতে মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদুল আক্সা পর্যন্ত, যার পরিবেশকে তিনি বরকতময় করেছেন, যাতে তাকে তাঁর কিছু নিদর্শন দেখান। আসলে তিনিই সবকিছুর শ্রোতা ও দ্রষ্টা" (সূরা বনী ঈসরাইলঃ ১)
এ আয়াতে আরবী “আয়াতিনা” শব্দের অর্থ “আমার (আল্লাহর) নিদর্শন” ইংরেজীতে sign অর্থাৎ এমন একটা স্মারক বা চিহ্ন যা বাস্তব উদাহরন সহ হাতে কলমে পালন করার বিষয়। তাই উপরোক্ত আয়াতে মিরাজের উদ্দেশ্য হল খুব নিকটে থেকে আল্লাহর কিছু স্মারক চিহ্ন দেখে এসে হৃদয়ে তা গভীরভাবে ধারন করে বাস্তব উদাহরন সহ পালন করা। যেহেতু এ উদ্দেশেই মহানবী (স) আল্লাহর অতি নিকটে গিয়ছিলেন, তাই তাঁর এ ভ্রমন ভূপৃষ্ঠে সচরর সাধারন ভ্রমনের মত ছিল না, আল্লাহর বিশেষ ব্যবস্থাপনায় অতি দ্রুততম গতিতে তাঁকে অনেকগুলি আকাশ এবং অসংখ্য গ্রহ নক্ষত্র, ছায়াপথ ও বিশাল মহাশূন্য পাড়ি দিয়ে আল্লাহর দরবারে পৌঁছতে হয়েছে, আর এ কারণেই মিরাজের রাতে তাঁর এ ভ্রমনটি ছিল মহা অলৌকিক ও অতি আশ্চর্য্যময় একটি ভ্রমন।
চলবে ইনশাআল্লাহ >>>>> পর্ব-২
[পরবর্তি পর্বের জন্য অপেক্ষা করুন]
বিষয়: বিবিধ
৩৪৭৪ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য






































পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন