লেখা-লেখি হোক সমাজ সংস্কারের হাতিয়ার, সত্য প্রতিষ্ঠার মাধ্যম।

লিখেছেন লিখেছেন হককথা ১৬ জুন, ২০১৩, ১০:০৯:৪২ রাত



মুসলিম শাসনাধীনে থাকাবস্থায় ভারতবর্ষ ছিল সম্পদে আর ঐশ্বর্যে, বিত্তে আর বৈভবে, শিল্পে আর সংস্কৃতিতে, নীতি আর নৈতিকতায় পুরো বিশ্বে এক কল্পরাজ্য। হিন্দু মুসলমান বিভেদ ছিল অজানা, বরং মানবিক সম্পৃতিতে এ ভূখন্ডটি ছিল প্রোজ্জল! সেটিই শক্তি, শঠতা আর প্রবঞ্চণার জোরে দখল করে নেয় ইংরেজ বণীকরা। ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর হাত ঘুরে শেষ পর্যন্ত খোদ ব্রিটিশ সরকারের হাতে পড়ে ভারতবর্ষ।

ব্রিটেন নিজের ক্ষমতা শোষণ আর শাসন টিকিয়ে রাখতেই মুসলমানদের পথের ভিখিরীতে পরিণত করে এক- চীরস্থায়ী বন্দোবস্ত, দুই- সরকারি দাপ্তরিক ভাষা ফার্সির পরিবর্তে ও ইংরেজির প্রবর্তন, তিন- জমিদারী প্রথা প্রবর্তন, চার- ওয়াকফ বা লাখেরাজ সম্পত্তি বাজেয়াপ্তকরণ, পাঁচ- মুসলিম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সমুহকে পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান বন্ধ করা এবং ছয়- শিক্ষা ব্যবস্থার স্থায়ী পরিবর্তন করে সেকুল্যার শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তনের মাধ্যমে।

এর পাশাপাশি নিজেদের সহযোগী হিসেবে সেই একই মন মানসিকতা সম্পন্ন একটা প্রজন্ম গড়ে তোলে সুপরিকল্পিতভাবে। লর্ড মেকলে ব্রিটিশ সরকারকে ‘এখন আমাদেরকে এমন একটা শ্রেণী গড়ে তুলতে হবে, সমাজে যারা শাসক ও শাসিতের মধ্যে দোভাষীর কাজ করবে। তারা রক্ত-মাংসের গড়নে ও দেহের রংএ ভারতীয় হবে বটে; কিন্তু রুচি, মতামত ও বুদ্ধির দিক দিয়ে হবে খাঁটি ইংরেজ’ বলে যে পরামর্শ দিয়েছিলেন, তারই আলোকে।

এই ‘রক্ত মাংশে ভারতীয় কিন্তু রুচি, মন ও মননে খাঁটি ইংরেজ’ হতে এগিয়ে আসে ভারতের হিন্দুরা। এক হিন্দু ঐতিহাসিকের বর্ণনা মতে;

‘উনবিংশ শতাব্দীর বাংলাতে বৃহত্তর জনসাধারণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যারা অগ্রসর হলো, অর্থনৈতিক বিচারে তাদের নাম মধ্যবিত্ত শ্রেণী রাষ্ট্রনৈতিক বিচারে তাদের নাম ব্রিটিশের সহযোগী, সংস্কৃতিক বিচারে তাদের নাম পাশ্চাত্য শিক্ষিতশ্রেণী, সামাজিক বিচারে তাদের নাম হিন্দু স¤প্রদায়।’ (সুরজিত দাস গুপ্ত: ভারতবর্ষ ও ইসলাম; পৃ: ১৬৯)

এদের জন্যই ১৮০১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ। এর পরে অপ্রতিরোধ্য গতিতে ইতিহাস বদলে যেতে থাকে। ১৮১০ সাল থেকে শুরু করে ১৮২০ সাল, একটি দশকেই বাংলা ভাষায় প্রকাশিত হয় পনেরো হাজারেরও বেশী বই, যার সবগুলোর লেখকই হিন্দু!

মুসলমানরা তলিয়ে যেতে থাকে। উঠে আসতে থাকে বর্ণ হিন্দুরা। ইংল্যন্ড থেকে আসতে থাকে মিশনারী খৃষ্টান পাদ্রীরাও। নব্যধনী বর্ণহিন্দু ও ইউরোপীয় খৃষ্টান পাদ্রীদের যৌথ আক্রমণে পর্যুদস্থ হয়ে পড়ে ভারতীয় মুসলমান।

আর বাঙ্গালী মুসলমানদের অবস্থাতো আরও শোচনীয় পর্যায়ে চলে যায়। কিন্তু তারপরেও সেই ধ্বংসস্তুপের মধ্য থেকেই কলম হাতে দাঁড়িয়ে যান ক’জন সাহসী পুরুষ। নজরুল, নাজিরুল, কায়কোবাদ, মাওলানা আকরাম খাঁ, প্রিন্সিপ্যাল ইব্রাহিম, ড: শহীদুল্লাহ, মুন্সী মেহেরুল্লাহ’সহ আরও কয়েকজন।

তাঁদের যুগে লেখালেখির লোক কম ছিল, পাঠকও ছিল কম। আর যদিও বা লেখালেখি দু’চারটি হতো, বই পুস্তক, পত্র-পত্রিকা প্রকাশ-প্রচারের ব্যবস্থা ও সামর্থ ছিল আরও কম। তারপরেও তারা যে কাজটি করতে পেরেছেন, আজ আমাদের হাতের নাগালে পড়াশোনা, লেখালেখি, প্রকাশ ও প্রচারের সহজ সুযোগ থাকা সত্তেও, পাঠকের সংখা বহুগুণ বেশী থাকা সত্তেও সেই কাজটুকু করেতে পারছি না!

কারণ, তাঁদের লেখায় থাকত আত্মার খোরাক, মন আর মানসকে যা পরিপুষ্ঠ করত। পাঠক তার জীবনের লক্ষ্য আর উদ্দেশ্য সন্মন্ধ্যে একটা সুষ্পষ্ট ধারণা পেতেন। আজ আমরা লেখি বটে, কিন্তু তাতে কোন নির্দিষ্ট লক্ষ্য নেই, সুষ্পষ্ট বক্তব্যও নেই। পাঠক পড়তে চান না, পড়লেও তার মনে কোন স্থায়ী ছাপও পড়ে না, তার মনকে মোহাবিষ্ঠ করে না, বিচলিত করে না, ভেতরে কোন জ্বালাও ধরায় না!

পেশাদার লেখকরা ফরমায়েশী লেখা লিখেন, লিখেন বাজার বুঝে। অনেক লেখকের লেখাই এখন ‘পণ্য’ হয়ে গেছে। পাঠক খাবে কি না, বই মেলায় বিকোবে কিনা, সে চিন্তা তাকে করতে হয়। এরকম লেখক দিয়ে বিনোদন হয় বটে, সমাজ বদল হয় না।

এর বিপরিতে একজন ব্লগার কিন্তু অনেকটাই স্বাধীন। তার লেখা ‘পণ্য’ হবার কোন সম্ভাবনা নেই। তেমন লক্ষ্যও তার সামনে নেই। অথচ পাঠক এখানে তাৎক্ষণিকভাবে পড়তে ও তার ভালো লাগা না লাগা শেয়ার করতে পারছেন। লেখক ও পাঠকের এই যে ইন্ট্যারেকশন, এই সুযোগটা নজরুল, নাজিরুল, আকরাম খাঁ কিংবা ড: শহীদুল্লাহদের ছিল না।

আমাদের সৌভাগ্য যে, আমাদের সেটা আছে। এখন যদি কয়েকজন এমন লেখক তৈরী হয়ে যায়, যাদের লেখায় প্রাণের এমন উত্তাপ থাকবে, যা পাঠকের চেতনায় জ্বালা ধরিয়ে দেবে, তা হলেই শুরু হবে নীরব মনস্তাত্বিক ও বৃদ্ধিবৃত্তিক বিপ্লব।

সমাজ বদলের জন্য এমন একটা বৃদ্ধিবৃত্তিক বিপ্লব হলো সর্বপ্রথম পূর্বশর্ত। এই মৌলিক শর্তটির গোড়াপত্তন করা ও তা এগিয়ে নিয়ে যাবার সূবর্ণ সুযোগ রয়েছে ব্লগারদের সামনে, তারা হতে পারেন সমাজ বদলের প্রথামসারীর কারীগর, অগ্রদূত।

আসুন, আবার নতুন করে ভেবে দেখি বিষয়টা। কলম তুলে নেই হাতে, লিখে যাই জীবনের উপাখ্যান। আমাদের কলম থেকে বের হয়ে আসুক বিজয়ের শ্লোগাণ। ধর্ম-বর্ণ, দল-মত নির্বিশেষে সৃষ্টির সেরা জীব মানুষের জন্য মানবিকতা আর সমমর্যাদার আহ্বানকে যে কোন দলীয় ও গোষ্ঠিগত সংকীর্ণতার উর্ধে তুলে ধরি। আমাদের ব্লগিং হোক বিভেদ সৃষ্টি নয়, বরং কেবলমাত্র মানবিকতার জন্য।

বিষয়: বিবিধ

১৯১৩ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File