পোশাকশিল্প নিয়ে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র!
লিখেছেন লিখেছেন ঢাকাটাইমস ২৮ জানুয়ারি, ২০১৩, ০৪:৪০:১৪ বিকাল
তৈরি পোশাক শিল্প বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য সোনার ডিম দেয়া হাঁসের মতো। বাংলাদেশ প্রতিবছর এ শিল্প থেকে ৫-৭ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি অর্জন করছে। অর্থনৈতিক ব্যাপক বিশ্বমন্দাবস্থার মধ্যেও বাংলাদেশে কোন প্রভাব পড়ছেনা, এর বড় কারণ তৈরি পোশাকশিল্প। কিন্তু বর্তমানে পোশাকশিল্পে অব্যবস্থাপনা ও শ্রম অধিকারের প্রতি যত্নবান না হওয়ার ফলে বিশ্বের অনেক দেশে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের বিরুদ্ধে প্রচারণা শুরু হয়েছে। আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রও রয়েছে। দেশীয় একটি লোভী শ্রেনী ও আন্তর্জাতিক চক্রান্তকারি গোষ্ঠী এক হয়ে সোনার ডিম দেয়ার মতো এই পোশাকশিল্পকে গলা টিপে মেরে ফেলার পাঁয়তারা করছে। এ অবস্থায় দেশের এই গুরুত্বপূর্ণ শিল্পটিকে বাঁচাতে সরকার বা মালিকপক্ষ কেউই তেমন গুরুত্বের সঙ্গে নিচ্ছে না বলে মনে করছেন বিশিষ্টজনেরা।
কিছুদিন আগে তাজরীন ফ্যাশনসে আগুনে পুড়ে ১১১ জন শ্রমিকের মর্মান্তিক মৃত্যুর খবর বিশ্বের পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। শনিবারও রাজধানীর মোহাম্মদপুরে একটি গার্মেন্টে অগ্নিকাণ্ডে ৭ জন শ্রমিক নিহত হয়েছে। পাশাপাশি হতাহতের ঘটনাও ব্যাপক। সবার অভিযোগ, এমন সব পোশাক বিক্রি হচ্ছে, যার সুতোয় লেগে আছে অভুক্ত শ্রমিকের ঘাম ও নিহত শ্রমিকের রক্ত। তাজরীন ফ্যাশনসে অগ্নিকাণ্ডের পর চাপ আসছে ওয়াল-মার্ট ও সিয়ার্সের মতো বড় কোম্পানিগুলোর ওপর। যাতে তারা বাংলাদেশের সঙ্গে লেনদেন কমিয়ে ফেলে, অথবা সরবরাহকারীদের ওপর আরও শক্ত শর্তারোপ করে। সেসব শর্ত মেনে না চললে বাংলাদেশ থেকে আমদানি বন্ধ করার কথাও বলা হচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায় তৈরি পোশাক কারখানার কর্মপরিবেশ নিয়ে বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে পড়েছে বাংলাদেশ। শ্রমিকদের কর্মপরিবেশ ও শ্রম-অধিকার প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্র তাদের দেশে পণ্য রপ্তানিতে বাংলাদেশের শুল্কমুক্ত বাজারসুবিধা (জিএসপি) বাতিল করতে যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র সরকারের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে তা জানিয়েও দেয়া হয়েছে।
গত ২৪ জানুয়ারি মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান ডব্লিউ মজিনা বলেছেন, বাংলাদেশে শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার না থাকাসহ বিভিন্ন শর্তপূরণে ব্যর্থ হওয়ায় জিএসপি সুবিধা প্রত্যাহার করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। তবে তা এখনও কার্যকর হয়নি। বাংলাদেশ সরকার আর শিল্প মালিকরা যদি মার্চের মধ্যে এ শর্তগুলো পূরণ করেন তাহলেই জিএসপি সুবিধা অব্যাহত থাকবে।
বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রসহ পুরো ইউরোপের বাজারে পণ্য রপ্তানিতে যে বিশেষ শুল্কমুক্ত বাজারসুবিধা পায়, তার নাম জেনারালাইজড সিস্টেম অব প্রেফারেন্স বা ‘জিএসপি’। এই সুবিধা বাতিল করার প্রক্রিয়া শুরু করছে যুক্তরাষ্ট্র সরকার। এর অংশ হিসেবে শিগগিরই সরকারি প্রজ্ঞাপন (ফেডারেল রেজিস্টার) জারি করা হবে। এ বিষয়ে গত ২১ ডিসেম্বর ও ২৭ ডিসেম্বর পৃথক চিঠিতে মার্কিন বাণিজ্য প্রতিনিধি
(ইউএসটিআর) রন কার্ক বাংলাদেশ সরকারের বাণিজ্যমন্ত্রী জিএম কাদের ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনিকে জিএসপি বাতিলের প্রক্রিয়া শুরুর কথা জানিয়ে দেন। চিঠিতে রন কার্ক বলেছেন, বাংলাদেশের জন্য জিএসপি সুবিধা বাতিলের আবেদনপত্রে বলা আছে, এই সুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্রে সব শর্ত বাংলাদেশ পূরণ করছে না। বিশেষ করে শ্রমিক অধিকার প্রশ্নে বাংলাদেশের বড় ধরনের ঘাটতি রয়েছে। এসব ব্যাপারে বিভিন্ন সময় যুক্তরাষ্ট্র সরকারের পক্ষ থেকেও বাংলাদেশ সরকারের কাছে উদ্বেগের কথা জানানো হয়েছিল। বাংলাদেশে শ্রমিক অধিকারের বিষয়ে অগ্রগতি তো হয়ইনি, বরং পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে। বাংলাদেশে শ্রমিকদের মজুরি নির্ধারণ ও কর্মপরিবেশ উন্নতিতে সংগঠিত ও নিবন্ধিত হতে দেয়া হচ্ছে না। এর পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র সরকারের কাছে বিশ্বাসযোগ্য তথ্য আছে যে, যেসব শ্রমিক সংগঠিত হতে চেয়েছেন তাদের চাকরিচ্যুত অথবা কালো তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। চিঠিতে রন কার্ক সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনায় যুক্তরাষ্ট্র যে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে জিএসপি সুবিধা বাতিল করার কথা বিবেচনা করছে তা জানিয়ে দেন। পাশাপাশি খুব দ্রুত পরস্থিতির উন্নয়নে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক শ্রমিক সংগঠনের ইউনিয়ন আমেরিকান ফেডারেশন অব লেবার অ্যান্ড কংগ্রেস অফ ইন্ডাস্ট্রিয়াল অর্গানাইজেশন (এএফএল-সিআইও) ২০০৭ সালে বাংলাদেশকে জিএসপি-সুবিধা বাতিলের আবেদন করেছিল। তখন ওবামা প্রশাসন আবেদনটি গ্রহণ না করলেও আবেদনটি এবার গ্রহণ করেছে। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগ করা হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে। এর মধ্যে রয়েছে শ্রমিক ইউনিয়ন করতে না দেয়া, শ্রমিকনেতা আমিনুল ইসলাম হত্যা ও হত্যার ঘটনায় কোনো ব্যবস্থা না নেয়া। পাশাপাশি সাম্প্রতিক তাজরীন ফ্যাশনসে অগ্নিকাণ্ডে শতাধিক শ্রমিক নিহত হওয়ার কথাও উল্লেখ করা হয়েছে রন কার্কের চিঠিতে।
বাংলাদেশ অনেক দিন ধরেই যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে পোশাকপণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার চাইছে। এ জন্য তৈরি পোশাক খাতের মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ বিপুল পরিমাণ অর্থ খরচ করে লবিস্ট প্রতিষ্ঠানও নিয়োগ দিয়েছিল। অথচ বাংলাদেশ এখন সেই সুবিধা তো পাচ্ছেই না, বরং অন্যান্য পণ্যের শুল্কমুক্ত সুবিধাও বাতিল হয়ে যাচ্ছে। এতে পোশাক খাতের বাইরে অন্যান্য পণ্যের বহুমুখীকরণও বাধাগ্রস্ত হবে।
যুক্তরাষ্ট্র পোশাকপণ্যে জিএসপি-সুবিধা না দিলেও ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) হিসেবে বাংলাদেশকে তা দিচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র জিএসপি বাতিল করলে ইইউর ওপর সরাসরি কোনো প্রভাব পড়বে না। কিন্তু এর ফলে সারা বিশ্বে একটি বার্তা যাবে যে, বাংলাদেশের পোশাক কারখানার কর্মপরিবেশ উন্নত না। এতে পোশাক খাতের ক্রেতারা একধরনের নেতিবাচক সংকেত পাবেন বলে ব্যবসায়ীরা মনে করছেন।
বিজিএমইএর উধ্বর্তন এক কর্মকর্তা এ বিষয়ে বলেন, বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে দেখতে হবে। বাংলাদেশ কর্মপরিবেশ উন্নতির জন্য কাজ করছে। অনেক অগ্রগতিও আছে। আবার বিজিএমইএও চায়, আমিনুল ইসলাম হত্যার সুষ্ঠু তদন্ত হোক। বিষয়গুলো সরকারের সঙ্গে বসে যুক্তরাষ্ট্রকে জানানো হবে বলেও তিনি জানান।
এ বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, মার্কিন বাণিজ্য প্রতিনিধির চিঠির জবাব দেয়ার বিষয়টি বিবেচনায় রয়েছে। কারণ, রন কার্ক যে কথাগুলো চিঠিতে লিখেছেন, সে ব্যাপারে সরকারের পক্ষ থেকে পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। বিষয়গুলো সরকারের পক্ষ থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে জানাতে চিঠি লেখার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চার হাজার ৮৮০টি পণ্যে ১২৯টি দেশকে শুল্কমুক্ত বাজারসুবিধা দিয়ে আসেছে। এ দেশগুলোর মধ্যে শীর্ষ ৫০ রপ্তানিকারক দেশের তালিকায় বাংলাদেশ আছে। ২০১২ সালের জানুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্র সিøপিং ব্যাগ রপ্তানিতে বাংলাদেশের জিএসপি সুবিধা বাতিল করেছিল। এ ছাড়া একই সময়ে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি উন্নতি হওয়ায় যুক্তরাষ্ট্র ক্রোয়েশিয়া ও ইকোয়াটরিয়াল গায়ানার জিএসপি সুবিধা বাতিল করে। কিন্তু বিভিন্ন অভিযোগের ভিত্তিতে একটি দেশের জিএসপি সুবিধা বাতিল সহসা যুক্তরাষ্ট্র করেনি বলে জানা গেছে।
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বাংলাদেশকে এখন যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগের বিষয়গুলো নিয়ে অগ্রগতি দেখাতে হবে। কর্মপরিবেশ উন্নতির ক্ষেত্রে এত দিন পর্যন্ত অর্জন যেমন দেখাতে হবে, তেমনি যেসব বিষয়ে পরিবর্তন আনতে হবে তার প্রতিশ্রুতিও থাকতে হবে। আর বাকি বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করতে হবে। বিষয়টি অবশ্যই গুরুত্বের সঙ্গে দেখতে হবে।
লেখাটি এর আগে এখানে প্রকাশিত
http://www.dhakatimes24.com/index.php?view=details&data=Host&news_type_id=1&menu_id=12&news_id=25444
বিষয়: বিবিধ
১২৮৭ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য






































পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন