শেষ রোদন (ছোটগল্প)
লিখেছেন লিখেছেন আতিকুর রহমান ফরায়েজী ২৩ এপ্রিল, ২০১৩, ০৮:২৮:৩২ সকাল
বসন্তের মাঝামাঝি, চৌত্রের দুপুর। অর্থাৎ প্রচন্ড তাপমাত্রায় এরকম গরমটা পড়া একটুও অস্বাভাবিক নয়। আর সেই জের ধরেই রাস্তায় লোকজন চলাচল প্রায় বন্ধের পথেই বলা চলে। কেননা, পাব্লিক লাইব্রেরীর জানালা দিয়ে যা দেখতে পাচ্ছি তা হল জনশূন্যই শুধু নয়, একেবারে যানবাহন শূণ্য। এরকম দৃশ্য আমাদের দেশে আর একবার দেখা যায়। হরতাল। তবে তাতে মাঝে মাঝে মাছের ঝাঁকের মত হরতালে সমর্থনকারীদের ছুটে আসাই সম্পূর্ণরূপে একে সমর্থন করতেও পারছিনা। এমন অবস্থায় বই পড়তে কার-ই বা ভালো না লাগে! তাই বসে না থেকে বই পড়তে মনোনিবেশ করতে চাইলাম। এমন সময় আমার শিরদন্ডে ভয়ংকর শব্দে একটি বোম ফাঁটলো। বোমটা ঠিক বলব না, কারণ ওটি মতির হাত ছিলো। একটু রাগান্নিত দৃষ্টিক্ষেপন করলাম ওর দিকে। বেচারা, মনে হয় আমার অবস্থা বুঝতে পেরেছিলো। তাই দ্রুত অন্য টেবিলে গিয়ে বসলো। আমি আবার পড়ায় মন দিতে চাইলাম, পারলাম না। বার বার আমার মনটা কেন যেন উদাসী উদাসী হয়ে উঠছে। বইটা বন্ধ করে, অর্ণবকে বললাম, কি পড়ছিস?
অর্ণব। গোরা।
আমি। গোরা!
অর্ণব। হ্যাঁ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গোরা।
আমি একটু আধটু লেখালেখি করি। আবার রবীন্দ্রনাথ আমার প্রিয় লেখক। তার লেখা সম্পর্কে আমাকে জ্ঞান দানটা কেমন অপমানসূচক মনে হতে লাগলো। আমিও যে জানি, গোরা রবীন্দ্রনাথের লেখা সেটা সকলে জানুক এই লোভ আমি কোন মতেই সামলাতে পাড়লাম না। তাই স্বগৌরবে মহিমান্নিত্ব পুরুষের মত বাক্যভঙ্গিটাকে কন্ট্রোলে এনে বললাম, গোরা রবীন্দ্রনাথা ঠাকুরের লেখা সেটাতো আমিও জানি।
অর্ণব। হুম, তাতে কি হয়েছে?
এবার আমার দিকে একটু মুখ ফেরালো।
আমি। না, তেমন কিছু না। তুই যে রবীন্দ্রনাথ পড়বি একটু......
অর্ণব। অবাক হচ্ছিস? তা একটু হবারই কথা। দেখ, ভাবলাম অনেকের লেখাই পড়লাম। যদি এর একটিও না পড়ি তাহলে জ্ঞান বলে যে একটি বস্তু আছে তা তো আর থাকে না।
মতিটা একটু অন্য টাইপের মানুষ। যখন নিজে যা বোঝে তাই নিজের কাছে বড় মনে হয়, অন্যের উপর তা চাপিয়ে দিতে চায়। যেন পৃথিবীর সমস্ত জ্ঞান ওর একারই আছে! একটু বিরক্তের সুরে আমাদের লক্ষ করে বলে, অ্যাঁ, পড়তে দিবি না, না কি ?
বয়সে আমাদের বড় হবে এমন আসংখ্যা নেই বললেই চলে। কিন্তু যে শরীর আছে, তাতে আমাদের হার মানাবে। তাই ও যা বলে, আমরা তাই করি। কোথাও পিকনিক করতে গেলে বা কোন টিম তৈরি করলে ওই টিমলিডার হয়। আর টিমলিডারের কথা অমান্য করতে নেই। তাই চুপি চুপি আবার পড়তে চেষ্টা করলাম।
দুপুরের রোদ লাইব্রেরীর দরজা দিয়ে নির্দিধায় ভিতরে প্রবেশ করছে। পুরো রুমে একমাত্র আলোর উৎস প্রায় ওই দরজাটিই। যদিও একটি জানালা আছে, তাতে এত বড় রুমে তার সামান্য আলো প্রায় কোন প্রভাবই বিস্তার করতে পারে না। আবার তাও এখন মতির বক্ষদেশ দ্বারা আবৃত্ত। সুতরাং, সে সামান্য আলোটুকুও যে পাব তার আশাটুকু শুকনো গাছে ফুল ফোটানোর মত বোকামী ছাড়া আর কিছু না। পরিস্থিতির অবস্থা পিন পতন নিরবতার মতন। মাথার উপর ফ্যানের শ্ শ্ শব্দ বার বার কানে দোলা দিয়ে যাচ্ছে। এমন সময় সেই আলোর ভেতর হতে মানব ছায়ার এক অপূর্ব মূর্তি নিয়ে দরজায় এসে হাজির হলো এক যোড়শী। আলোকে পেছনে রেখে ভেতরে প্রবেশ করাই খুব একটু স্পষ্টভাবে শব্দ দেখতে পেলাম না। তবু যা দেখলাম, খুবই অসাধারণ লাগলো। নীল রঙের শাড়িতে লম্বা লম্বা লাল রঙের পাড়, কপালে লাল টিপ, হাতে লাল কাঁচের চুড়ি। মেয়েটি সোজা গিয়ে অর্ণবের সামনে দাড়ালো। আমরা সবাই ওদের দিকে তাকিয়ে। অর্ণব উঠে দাড়ালো। দিনের বেলা ভূত দেখলে সাধারণত মানুষের যেমন হবার কথা, অর্ণবের অবস্থাও ঠিক তাই।
অর্ণব। তুমি!
মেয়েটির হাতে ত্রিভাজযুক্ত একটি কাগজ ছিলো। কাগজটি অর্ণবের হাতে দিয়ে ফিরে গেল। আমার মন পুলকিত হয়ে গেয়ে উঠল-
“যাবার বেলায় চেয়ে যেও
একটু চোখের ভূল।”
কিন্তু তা আর হলো না। মেয়েটি শরতের মেঘের মত মিলিয়ে গেল। তখনও অর্ণব দাঁড়িয়ে আছে। আমি গিয়ে বললাম, অর্ণব দেখনা কি লিখেছে! অর্ণব যেন মৌন জগতের কেনা-বেঁচা শেষ করে পার্থিব জগতে ফিরে এলো- ও হ্যাঁ, বলে আমাদের শুনিয়ে পড়তে লাগলো। আমি একটু উঁকি দিয়ে দেখলাম- ছোট ছোট অক্ষরে অতি যন্তসহকারে পেনসিল দিয়ে লেখা-
“আমি সত্যি বুঝতে পারছিনা ঠিক কিভাবে শুরু করব। জীবনের তরীতে চলার পথে অনেক ঝড়, বাঁধা, বিঘœ পেরিয়েছি। পেয়েছি অনেককে, আবার হারিয়েছিও। কিন্তু কখনও কোন মুহুর্তে এতবড় অন্যায় করেছি বলে মনে পড়ে না। কালকের ঘটনার জন্য কোন অজুহাত আমি দেবনা। তবে, সত্যি, আমি আগে কখনও নিজের উপর থেকে এভাবে এতটা ঈড়হঃৎড়ষ হারাইনি। আপনাকে সবসময় একজন শুভাকাঙ্খী বন্ধু হিসেবেই দেখে এসেছি। তাইতো আপনার উপর কারণে অকারণে জোর করতে পারি যে কোন বিষয়ে। একজন অনন্য মানুষ হিসেবে আপনাকে মন থেকে শ্রদ্ধা করেছি। কিন্তু কখনও মুখে বা আচরণে তা প্রকাশ করিনি। বিলিভ মি, প্রতিটা কথা আমি মন থেকে বলছি। এজন্যই বোধ হয় কলকে, আপনার সাথে এমন ইধফ ইবযধাব করার পর এক মুহুর্তের জন্যও বিবেকের কটাক্ষের সামনে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারিনি। পারিনি আপনার দিকে তাকাতে। বাড়ি যাওয়ার সারাটা পথে নিজের অজান্তেরই চোখ থেকে জল ঝরেছে। কালকে সারা রাত আমি এই কথাটাই ভেবেছি। আর প্রচুর অপরাধবোধে ভূগেছি। মনে হচ্ছে, আপনার সামনে দাঁড়ানোর অধিকারও আমি হারিয়ে ফেললাম। যে পরিমাণ মানসিক চাপের মধ্যে আমি আছি, তা আপনাকে বোঝাতে পারবো না। আমি আর পারছিনা। প্লিজ আপনি আমাকে শাস্তি দিন। যে কোন শাস্তি মাথা পেতে নিতে আমি প্রস্তুত। আর শান্তি দেওয়ার পর প্লিজ মন থেকে ক্ষমা করে দেবেন। যদি তা না করে (সামাজিকতা রক্ষার জন্য) মুখে আমার সাথে কথা বলেন, তাহলে অনেক কষ্ট পাব। আপনার সাথে সরাসরি কথা বলার মত অবস্থায় আমি নেই। তাই খবঃঃবৎ দিলাম। প্লিজ কিছু মনে করবেন না।
- (মহা অপরাধী)”
চিঠিটা যখন পড়া শেষ হল অনাবৃষ্টির আকাশে কালো মেঘ এসে জমাট বাঁধতে শুরু করেছে। আর আমরা ছাঁয়ামূর্তির সম্মুখে কিছুক্ষণ নিরবতা পালন করালম। যেন কথ্য দেব আমাদের পরিত্যাগ করেছে। সেই সাথে নিরাবতা দেবীর কঠোর আবির্ভাব। আমি অর্ণবের চোখের দিকে একটু সাহস করে তাকালাম। ঘোর অন্ধকারে টর্চের আলো পড়লে বিড়ালের চোখ দুইটি যেরূপ দেখা যায়, তার থেকে সামান্য ভিন্নও আমার মনে হতে লাগলো না। তারপর ধিরে ধিরে মতির দিকে তাকালাম। মতি একটু গলায় খেকর দিয়ে বলল, অর্ণব কি হলো? অর্ণব নিজেকে সামলিয়ে নিয়ে- না, কিছু না। চল বাড়ি যাব।
আমি। বাড়ি যাবি !?
অর্ণব। হুঁম, চল।
আমি। গোরা পড়বি না?
অর্ণব। কাল আবার পড়বো।
অর্ণব বেড়িয়ে গেল। তখন মনে হলো বই পড়ার কথাটি বলা নিতান্তই অযোক্তিক হয়েছে। আমার মত বোকা আর একটিও বাংলায় আছে বলে মনে করতে পারলাম না। বোকামীতে ইতস্থ হতে লাগলো। আমি এবং মতিও একই উদ্দেশ্যে রওনা হলাম।
তারপর চার-পাঁচ দিন অতীত হলো। অর্ণবের কোন দেখা নেই। এর মধ্যে অর্ণবের ব্যাপারটাকে নিয়ে অনেক ঘাটাঘাটি করেছি। বিশ্লেষণে বিভিন্ন বিষয় উঠে এসেছে। যেমন, মেয়েটির নাম কি?, অর্ণবের সাথে পরিচয় কিভাবে এবং কত দিনের?, যে ঘটনার কথা মেয়েটি লিখেছে সে ঘটনাটি আসলি কি? ইত্যাদি ইত্যাদি। তবে আমরা সকলে নিশ্চিত মেয়েটি এবং অর্ণবের অনেক দিনের পরিচয়। এর মধ্যে ধীর পায়ে অর্ণবের প্রবেশ। মাথার চুল এলো, পোশাকে ভাঁজ নেই, বিষন্ন এবং মলিন মুখ, চোখ দু’টি বুঝিয়ে দিচ্ছে, বেশ ক’দিন নির্ঘুমে কেঁটেছে। এমন অবস্থায় সকল প্রাণীই হইত তার নিকটাত্মীয়দের শান্তনা দিয়ে থাকে। অথচ, অর্ণবের বেলায় ঘটল ঢেড় পরিবর্তন। মতি এসে প্রচন্ড গম্ভির মুখে ওর সামনে দাড়ালো। তারপর বলল, বস্। অর্ণব যেন বাধ্যতার এক অপূর্ব নাম। সে নিশব্দে বসে পড়লো।
মতি। দেখ অর্ণব, পৃথিবীটা অনেক কঠিন। বলতে পারিস রণাঙ্গণ, আর মানুষগুলো একেকটা রণদূত। এখানে জীবেন জন্য লড়তে হয়, দু’মঠো খাবারের জন্য লড়তে হয়, লড়তে হয অধিকার আদায়ের জন্য। যদি কেউ এগুলোতে মোহ আবদ্ধ করে ফেলে তার সাধনার পরিসমাপ্তি হয়। বাস্তবতা বড় কঠিন রে!
অর্ণব। তোর সাথে আমিও একমত। তবে শুধু সংগ্রাম দিয়ে জীবন চলে না। তাতে ভালবাসা না থাকলে জীবনের কোন মানেই নেই। জীবন বড় একঘেয়েমী হয়ে যায়।
মতি। ইতিহাস আমাদের যা বলে তা হলো, প্রেম, ভালবাসা শুধুই দুঃখ দেয়। তাতে হৃদয়ে বেদনার সৃষ্টি হয়। আর তার ফলে সৃষ্টি হয় একাকীত্ব।
অর্ণব। সে একাকীত্বকে প্রেমিক অকাতরে গ্রহণ করে। আমিও তাদের মত সাধারণ একজন হতে চাই।
আমি আগেই বলেছি, আমি একটু আধটু লেখালেখি করি। সুতরাং প্রেমের বিপক্ষে যাব এমন দুঃসাহস আমার নেই। তাই একটু অস্থির সুরেই বলালাম- অ্যাঁ থামতো, কি লাগালি কি তোরা?
এমন সময় সে পরিচিতার নিঃশব্দ পদচারনা। পুরোরুম শ্রাবণের মেঘের মত গম্ভীর হতে আরম্ভ করেছে। সারাজীবন স্ত্রী জাতিটাকে সম্মানকরে চলেছি। বিধায় নিজের চেয়ার ছেড়ে মেয়েটিকে বসতে দেবনা এমন দূর্ব্যবহার আমি করতে পারলাম না। উঠে দাড়ালাম- বসুন।
নিঃশব্দ ঝরঃ ফড়হি.
তারপর আলতোভাবে লাল রঙের ব্যাগটা টেবিলের উপর রাখলো। বের করলো একটি র্যাপিং করা প্যাকেট। সে উঠতে চেষ্টা করাতেই অর্ণব বলল, বসো, উঠলে যে!
মেয়েটি। ভাল থাকবেন।
অর্ণবসহ আমরা সবাই হতবাক হলাম। মেয়েটি যাবার সময় দু’বার ফিরে দেখেছিল। বেশ কিছুক্ষণ পর পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটলে অর্ণব র্যার্পি পেপারে জড়ানো প্যাকেটটি খুলল। দেখলাম, একটি চিঠি এবং একটি বই। বইটি ছিল হুমায়ুন আহমেদের- “রাবণের দেশে আমি এবং আমরা” বইয়ের কভারপাতা তুলতেই সেই চেনা হাতে লেখা-
“ কাউকে কোন উপহার দিলে মনে হয়
তাতে কিছু লিখে দিতে হয়। এই
মুহুর্তে মাথায় কিছু আসছে না, দুঃখিত।”
তারপর অর্ণব আলতোভাবে চিঠিটি খুললো। যা দেখতে পেলাম-
“আমরা স্বপরিবারে আমেরিকায় চরে যাচ্ছি। হইতো আপনার সাথে আমার আর কোনদিন দেখা হবেনা। হইতো পার্কের সেই বিকেলটার কথা বার বার মনে পড়বে। যদি পারেন, আমাকে ভূলে যাবেন। মনে করবেন, দু’দিনের অতিথি হয়ে এই বন্ধুটি আপনার জীবনে এসেছিলো। আবার সময়ের ¯্রােতে ভেসেও গিয়েছে। কিন্তু ভূল করেও সে ¯্রােতে আপনি লাফ দেবার চেষ্টা করবেন না। কারণ এ ¯্রােত খুব তীক্ষè, ধারালো। যতদূর জানি আপনি সে আঘাত সইতে পারবেন না।”
- শিঞ্জিনী”
তারপর শিঞ্জিনীর অনেক খোঁজ করার চেষ্টা করেছি আমরা। যদিও অর্ণব নিষেধ করতো, তবুও খোঁজ করেছি বহুবার। এখনো দেশের বাইরে গেলে আমরা খুঁজি সেই শিঞ্জিনীকে। কোথাও তার কোন আভাসটুকু পাইনা। ব্যর্থতার শেষ অব্দিও দেখেছি। আর অর্ণব? সে ওই ঘটনার পর জীবনে আর একটি বসন্ত পার করেছিলো। এখন তার কবরটি লাইব্রেরীর সামনে মাথা উচু করে দাঁড়িয়ে আছে। আর আমার চোখে ভেসে উঠে সেই মুহুর্ত যেটা ছিল অর্ণব এবং শিঞ্জিনীর শেষ দেখা।
০১ বৈশাখ ১৪২০
বঙ্গাব্দ।
বিষয়: সাহিত্য
১৬৬৪ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন