আওয়ামী লীগের যোগ-বিয়োগ:
লিখেছেন লিখেছেন সোনা পাতা ০৭ জানুয়ারি, ২০১৩, ০৪:৩৪:০৮ বিকাল

কেমন হলো আওয়ামী লীগের নতুন নেতৃত্ব?
কেউ বলছেন, চমক নেই; কেউ বলছেন, যেমনটি হওয়ার কথা তেমনটিই হয়েছে। আবার কারও মতে, আওয়ামী লীগে সাবেক কমিউনিস্টরা ঢুকে দল ও দেশের বারোটা বাজাচ্ছেন। তাঁরা হয়তো আওয়ামী লীগকে একটি প্রগতিশীল দল হিসেবে দেখতে চান না। পঞ্চাশের দশকের আওয়ামী মুসলিম লীগের পুনরাবির্ভাব চান। সাবেক কমিউনিস্টদের আওয়ামী লীগে প্রবেশের পথ বন্ধ করলে সাবেক ডেমোক্রেটিক লীগাররা জায়গা দখল করে নেবেন। সেটাই হয়তো কারও কারও বাসনা।
আওয়ামী লীগের মতো একটি বিশাল দলের কাউন্সিল ও কমিটি নিয়ে ভেতরে-বাইরে জোর আলোচনা হওয়াটা স্বাভাবিক। কিন্তু সেই আলোচনা যদি পাওয়ার উল্লাস কিংবা না-পাওয়ার গভীর বেদনা তাড়িত করে, তাহলে সঠিক মূল্যায়ন সম্ভব নয়। সঠিক মূল্যায়ন সম্ভব নয়, যদি কেউ আগে থেকে ধরে নেন যে বনেদি আওয়ামী লীগার ছাড়া নেতৃত্বে যাওয়ার হক আর কারও নেই।
যেসব বিজ্ঞ সমালোচক বলেছেন, আওয়ামী লীগের নতুন কমিটিতে চমক নেই, তাঁরা কী ধরনের চমক আশা করেছিলেন, তা বোধগম্য নয়। তাঁরা কি আশা করেছিলেন, সভানেত্রীর পদ থেকে শেখ হাসিনা ও সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকে সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম সরে দাঁড়াবেন এবং কোনো বনেদি আওয়ামী লীগারদের দিয়ে এই দুটি শূন্য পদ পূরণ করা হবে। আওয়ামী লীগের সভাপতির পদে এখনো শেখ হাসিনার বিকল্প কাউকে ভাবা যাচ্ছে না। অন্তত দলের কর্মীরা ভাবছেন না। তিনি সভানেত্রীর পদ ছেড়ে দিলে তিন মাসের মধ্যে আওয়ামী লীগ তিন টুকরো হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে। এমনকি নানা দুর্বলতা সত্ত্বেও সাধারণ সম্পাদক পদেও সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের বিকল্প নেই। আওয়ামী লীগের কাউন্সিলের আগে এই পদে যেসব নাম আসছিল, তাতে কর্মীরা শঙ্কিত হয়ে পড়েছিলেন। তাঁদের কারও দল পরিচালনার দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা নেই, কর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ নেই। আছে পদের অভিলাষ।
সম্মেলনের চার দিনের মাথায় পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে এবং কমিটির অধিকাংশ পদে ‘সাবেক বহাল’ থাকলেও যে কটি পদে পরিবর্তন এসেছে, তা একেবারে গুরুত্বহীন ভাবার কারণ নেই। রাজনৈতিক মহলে একটি কথা চালু আছে, শেখ হাসিনা কারও কথা শোনেন না, জনগণের সমালোচনার তোয়াক্কা করেন না। কিন্তু আওয়ামী লীগের নতুন কমিটিতে যোগ-বিয়োগের খতিয়ান দেখলে সেই ধারণা বদলে যাবে। নতুন কমিটি দেখে এমনটি ভাবার কারণ আছে যে তিনি জনগণের সমালোচনা, দলীয় নেতা-কর্মীদের অভিযোগ-অনুযোগকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়েছেন। বিশেষ করে যাঁদের কারণে দলের ও সরকারের ভাবমূর্তি বিনষ্ট হয়েছে, তাঁদের ব্যাপারে কঠোর সিদ্ধান্ত নিতেও শেখ হাসিনা দ্বিধা করেননি। আবার যাঁদের দ্বারা দল লাভবান হয়েছে, তাঁদের পুরস্কৃতও করেছেন।
২০০৯ সালের আওয়ামী লীগের সম্মেলন থেকে এবারের সম্মেলনের চরিত্রগত পার্থক্য আছে। ২০০৯ সালের সম্মেলন হয়েছিল দলের ভেতরে সংস্কারপন্থী ও হাসিনাপন্থীদের মনস্তাত্ত্বিক লড়াইয়ের পটভূমিতে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে যাঁরা শেখ হাসিনার পাশে ছিলেন, কমিটিতে তাঁদেরই প্রাধান্য ছিল। এবারে সেই পন্থী-বিতর্ক অনেকটাই অসার হয়ে গেছে। সবাই শেখ হাসিনাকে নেতা মেনেই আওয়ামী লীগে আছেন, কেউ তাঁর নেতৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করছেন না। সে ক্ষেত্রে ‘সংস্কারপন্থী’ ও ‘অসংস্কারপন্থী’ নির্বিশেষে সবাই কমিটিতে স্থান পেলে তা দলের ও সরকারের জন্য ভালো হতো। কিন্তু রাজনীতিতে সব চাওয়াই পূরণ হয় না। দ্বিতীয়ত, বিএনপিতে যেভাবে সংস্কারপন্থীরা খালেদা জিয়াকে চ্যালেঞ্জ করে আলাদা কমিটি করেছিলেন, আওয়ামী লীগে সে রকমটি কেউ করার সাহস পাননি। কয়েকজন জ্যেষ্ঠ নেতা দলীয় কাঠামোয় পরিবর্তন আনতে বিকল্প প্রস্তাব দিয়েছিলেন মাত্র। আবার তৎকালীন শাসকদের অত্যাচার-নির্যাতনের ভয়েও অনেকে সংস্কারের কথা বলেছেন, কেউ কেউ রাজনীতি থেকে অবসর নেওয়ারও ঘোষণা দিয়েছিলেন।
এখন নতুন প্রেক্ষাপটে আওয়ামী লীগে সংস্কারপন্থী ও হাসিনাপন্থী—এই বিভাজন এখন অর্থহীন। কথিত সংস্কারপন্থীরা যদি আওয়ামী লীগের নীতি ও আদর্শ এবং শেখ হাসিনার নেতৃত্ব মেনে দলে ভূমিকা রাখতে চান, তাঁদের সাদরে বরণ করাই হবে প্রাজ্ঞ নেতৃত্বের কাজ। ২০১৩ সালটি আওয়ামী লীগের জন্য কঠিন চ্যালেঞ্জ। নির্বাচনের বছর। সবাইকে নিয়ে সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে পারলে দল অনেক বেশি লাভবান হবে।
সংস্কারপন্থীদের ব্যাপারে শেখ হাসিনার নীতি ছিল ‘ফরগিভ, বাট নট ফরগেট’। ক্ষমা করলেও তিনি ভুলে যাননি। কিন্তু এবার কমিটি গঠন করতে গিয়ে তাঁকে কোনো কোনো ক্ষেত্রে আরও কঠোর হতে দেখা গেছে। বিশেষ করে যাঁদের কারণে দল ও সরকারের সমূহ ক্ষতি হয়েছে, তিনি তাঁদের ক্ষমা করেননি। প্রায় ১০ বছর ধরে আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক সম্পাদক ছিলেন সৈয়দ আবুল হোসেন। কিন্তু বর্তমান কমিটিতে নতুন মুখ এসেছেন। এমনকি কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যও হতে পারেননি সৈয়দ আবুল হোসেন। বিশ্লেষকদের মতে, গত চার বছরে বিরোধী দল সরকারের যতটা না ক্ষতি করেছে, তার চেয়ে বেশি ক্ষতি করেছেন সৈয়দ আবুল হোসেন। পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির যে অভিযোগ উঠেছে, তার সঙ্গে তাঁর সম্পৃক্ততা কতটা, সেটি দুদকের মামলার তদন্ত ও বিচার শেষ হলে জানা যাবে। কিন্তু এত বড় বিশাল মন্ত্রণালয় ও প্রকল্প পরিচালনা করার জন্য যে যোগ্যতা, দক্ষতা ও সৃজনশীলতা দরকার, তা যে সৈয়দ আবুল হোসেনের ছিল না, সেটি তিনি পদে পদে প্রমাণ দিয়েছেন। মন্ত্রী থাকাকালে তিনি দলের জ্যেষ্ঠ নেতাদের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করেছেন। নিজের ব্যর্থতার দায় অন্য মন্ত্রীদের ওপর চাপিয়েছেন। বর্তমান যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের আলাদিনের চেরাগ নিয়ে আসেননি, হঠাৎ করে তাঁর মন্ত্রণালয়ে বরাদ্দও বাড়েনি। কিন্তু মানুষ মনে করছে, তিনি সমস্যা সমাধানে আন্তরিক। সেই আন্তরিকতা সৈয়দ আবুল হোসেন দেশবাসীকে দেখাতে পারেননি। আমাদের মতো উঠতি অর্থনীতির দেশে ব্যবসায়ীরা কীভাবে সাফল্য দেখান, শনৈঃ শনৈঃ উন্নতি করেন, তা অজানা নয়। কিন্তু রাজনীতিতে সফলতা দেখাতে হলে আরও কিছু গুণ থাকা দরকার।
কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতিমণ্ডলী থেকে বাদ পড়েছেন তিন প্রবীণ নেতা—ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন, রাজিউদ্দিন আহমেদ ও মহীউদ্দীন খান আলমগীর। এর মধ্যে রাজিউদ্দিন আহমেদের বিরুদ্ধে নরসিংদীর পৌর মেয়র লোকমান হোসেন হত্যার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ আছে। এলাকার অধিকাংশ নেতা-কর্মী তাঁর ওপর ক্ষুব্ধ। আওয়ামী লীগপন্থী আইনজীবীদের মধ্যে বিরোধ উসকে দেওয়ার অভিযোগ আছে ইউসুফ হোসেন হুমায়ুনের বিরুদ্ধে। সেই অভিযোগের সত্যাসত্য প্রমাণসাপেক্ষ। কিন্তু গত কয়েক বছরে বিভিন্ন স্তরে আইনজীবী সমিতিগুলোর নির্বাচনে সরকারপন্থীদের পরাজয়ের দায় তিনি এড়াতে পারেন না। মহীউদ্দীন খান আলমগীর যখন সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য হন, তখন মন্ত্রী ছিলেন না, কয়েক মাস আগে তিনি মন্ত্রী হয়েছেন এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পেয়েছেন। এই মন্ত্রণালয় নিয়ে তাঁকে সার্বক্ষণিক ব্যস্ত থাকতে হয়। সভাপতিমণ্ডলী থেকে তাঁকে উপদেষ্টামণ্ডলীতে পাঠানো এটাও কারণ হতে পারে।
কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যপদ থেকে সম্পাদকমণ্ডলীতে কিংবা সম্পাদকমণ্ডলী থেকে সভাপতিমণ্ডলীতে যাঁরা উন্নীত হয়েছেন, তাঁরা তাঁদের কাজের স্বীকৃতি পেয়েছেন বলেই ধারণা করি। এখানে সাবেক কমিউনিস্ট কিংবা সাবেক ছাত্র ইউনিয়ন খোঁজা আহাম্মকি ছাড়া কিছু নয়। ওবায়দুল কাদের বরাবরই আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের রাজনীতি করে আসছেন। যাঁরা আওয়ামী লীগে সাবেক কমিউনিস্টদের অনুপ্রবেশ বেড়েছে বলে মাতম করছেন, তাঁদের একটু পেছনে তাকাতে বলব। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের ট্র্যাজেডির পর অনেক জাঁদরেল আওয়ামী লীগারের টিকিটি খুঁজে না পেলেও ন্যাপ, ছাত্র ইউনিয়ন, কমিউনিস্ট পার্টির নেতা-কর্মীরাই প্রথম প্রতিবাদ করেছিলেন।
দলের নেতৃত্বে আসার জন্য প্রয়োজন সততা, নিষ্ঠা ও যোগ্যতা। সারাক্ষণ বঙ্গবন্ধুর নাম জপ করলে বা মুজিব কোট পরিধান করলে ব্যক্তির ভাবমূর্তি বাড়লেও দল লাভবান হয় না। আমরা ধারণা করি, আওয়ামী লীগের কমিটিতে যোগ-বিয়োগ হয়েছে কাজের ভিত্তিতে, সততার ভিত্তিতে। যাঁরা পদোন্নতি পেয়েছেন, তাঁরা নিজেদের যোগ্যতা ও দক্ষতা দেখাতে পেরেছেন। আর যাঁরা সেটি দেখাতে পারেননি, তাঁদের পদাবনতি হয়েছে। তবে সম্পাদকমণ্ডলী থেকে বাদ পড়েছেন একজনই—সৈয়দ আবুল হোসেন।
দলের একজন জ্যেষ্ঠ নেতা ব্যক্তিগত আলাপে বলেছেন, ‘আওয়ামী লীগের মতো দলের কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার বিষয়টি যেমন গুরুত্ব পায়, তেমনি তাদের সমালোচনাও। অনেক বেশি সমালোচিত হয়েছেন অথচ দল তাঁকে পদোন্নতি দিয়েছে, এবারের কমিটিতে এ রকম একটি নজির নেই।’
অনেকেই মনে করেছিলেন, গত কমিটিতে সংস্কারপন্থী হিসেবে যাঁরা বাদ পড়েছিলেন, এবার তাঁদের সসম্মানে দলে ফিরিয়ে আনা হবে, সেই সুযোগ এখনো শেষ হয়ে যায়নি। সভাপতিমণ্ডলী ও সম্পাদকমণ্ডলীর যেসব পদ খালি আছে, সেসব পদে তাদের কেউ কেউ আসতেও পারেন। ভবিষ্যতে দল পরিচালনা ও নির্বাচনী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় তাঁদের প্রয়োজন আছে। আশা করি, আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্ব বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করে দেখবেন। কেননা একবার যাঁরা আওয়ামী লীগ করেন, তাঁদের সমস্যা হলো, বিএনপি, জাতীয় পার্টি বা অন্য কোনো ডানপন্থী দলে যেতে পারেন না। আওয়ামী লীগার হয়েই তাঁরা মরতে চান।
বিষয়: বিবিধ
১৫১৪ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য






































পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন