চিঠি- ৩২ (সত্য ঘটনা অবলম্বনে)
লিখেছেন লিখেছেন নকীব আরসালান২ ৩১ আগস্ট, ২০১৬, ১২:৫১:৪১ দুপুর
গ্রীষ্মকালীন ছুটি হয়েছে, দেখা দিল বিপত্তি। ফেরদৌসী হাসানদের বাড়িতে যাবে না। কারণ মোবারক তার নামে গিল্লা গেয়েছে, এখন সে বাড়িতে গিয়ে মুখ দেখাতে পারবে না। ওদিকে ফেরদৌসীর মাও ঘর তালাবদ্ধ রেখে সারা বছর মেয়েদের বাসায় বাসায় ঘোরেন, তিনিও বাড়িতে নাই যে সেখানে যাবে। অগত্যা সে স্ত্রীকে বলে কয়ে রাজি করাল- আরে চল তো, আমাদের বাড়ির মানুষ এমন না, গিয়ে দেখবে তাদের কিছুই মনে নেই, তোমাকে কেউ কিছু জিজ্ঞেসও করবে না। বাড়িতে পৌঁছে দেখে মা অসুস্থ। ফেরদৌসি কাপড় চোপড় খুলে গিয়ে রান্না ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাসানের ছোট ভাই- বউয়ের সাথে আলাপ শুরু করল। হাসান তার মায়ের খেদমতে লাগল, বসে বসে পা টিপে মাথা টিপে আর বউকে ডাকে, কিন্তু সে আসে না। উঠানে গিয়ে বলল- এই তাড়াতাড়ি আস, আম্মাকে ঔষধ খাওয়াতে হবে, মাথায় পানি দিতে হবে- বলে সে আবার গিয়ে পা টিপে কিন্তু আসল না। আবার উঠোনে গিয়ে তাড়া দিলে বলল, আসছি কিন্তু আসল না। তৃতীয়বার গিয়ে ধমক দেয়ার পর এসে পানি দেয়া শুরু করল।
হাসান অন্য সময়ও দেখত এরা দুজন চুপিসারে আলাপ করত কিন্তু কি আলাপ বুঝত না। পরে বুঝেছিল এরা শ্বাশুড়ির সমালোচনা করত। হাসানের মা আগেরকার দিনের সহজ সরল একজন মানুষ। বউদের নিজের মেয়ের চেয়েও বেশি আদর করতেন। কিন্তু ফেরদৌসী এবং তাদের পরিবারের মেয়েরা ছিল ভয়ঙ্কর শাশুড়ি বিদ্বেষি, এরা শ্বশুর শাশুড়ির দেখাশুনা তো দুরের কথা সর্বদা তাদের থেকে পৃথক থাকত। ফেরদৌসী বাড়িতে গিয়ে ছোট বউয়ের কাছে খুটিয়ে খুটিয়ে শ্বাশুড়ির দোষ ত্রুটির কথা জিজ্ঞেস করত আর চুপিসারে সমালোচনা করত। এভাবে সে ছোট বউটাকে পর্যন্ত নষ্ট করে দিয়েছিল। শুধু তাই নয়। হাসানের দ্বিতীয় ভাইটা ছিল উগ্র, বউকে বকা-ঝকা করত। ফেরদৌসী বউকে শিখাল- আমাকে কিছু বললে পায়ে ধরিয়ে ছাড়ি তুমি পার না? জামাই কিছু বললে পায়ে ধরাবে, না হয় চলে যাবে। জামাইকে কোনদিন লেম দিবে না তাহলে সমস্যা আছে। এভাবে সে ছোট বউটাকেও নষ্ট করে দিয়েছিল।
একান্নভুক্ত সংসার। বাড়ির মেয়েরা শুধু রান্না বান্নার কাজ করে, ধান ও অন্যন্য কাজ ছেলেরা ও কাজের লোকেরা করে। বাড়ির মেয়েরা কখনো দেউরির বাইরে যায় না, রান্না ছাড়া অন্য কোন কাজ করে না। ছোট বউটাই সারা বছর রান্না বান্না করে। কিন্ত বড় বউ গেলে সে কিছুটা আরাম করতে চাইত, ভাবত সেও সংসারের জন্য কিছুটা করুক। কিন্তু তার তো রান্না ঘরে গিয়ে নাচন উঠত। যে স্বামীকে দিয়ে বাসার সব কাজ করায় সে কিনা করবে বিশাল ফ্যামিলির রান্না-বান্না? মুখটা বিষ করে কথায় কথায় শ্বাশুড়িকে বলে- আপনাদের কাজের মেয়ে রাখার ক্ষেম (ক্ষমতা) নাই নাকি, বউদের দিয়ে কাজ করান কেন? মা বলতেন- কাজের মেয়ে পাব কোথায়, সব তো গার্মেন্টসে চলে যায়। তোমার জন্য না এত খোজা হল পাওয়া তো গেল না। আর রান্নার কাজ তো কাজের মেয়েরা করবে না, বউদেরই করতে হয়। সে বলত- বউয়েরা কাজ করবে কেন? এ নিয়ে শ্বাশুড়ির সাথে তর্ক বাধিয়ে দিত। অগত্যা ছোট বউকেই গিয়ে রান্নার কাজ করতে হত।
এদিকে হাসানের তখন উভয় সংকট, বউয়ের পক্ষালম্বন করলে হয়ে যাবে স্ত্রৈণ, আর গ্রামাঞ্চলে স্ত্রৈণের খাওয়া নাই। গাঁয়ের মহিলারা চোখ ঠারাঠারি করবে আর ভাইয়েরা ছেঃ ছেঃ করতে করতে বাড়ি ছাড়া করবে। আবার বউকে তাকাদা দিয়ে কাজ করালে বাসায় এসে লবণ মরিচ লাগাবে। অগত্যা সে মাকে বুঝায়- সকলের ছোট বোন তো বেশি আদরের, কাজ কর্ম করে অভ্যাস নাই, কয়েকদিন থাকবে কাজ নাইবা করল। বউকে বলত- দেখ বদনাম করো না, ছোট বউটা সারা বছর রান্না- বান্না করে, তুমি একটু আধটু করলে মরে যাবে না। সে মুখ ভেংচিয়ে বলত- এ গোস্টি সুদ্ধু মাইনষের কাজ করানোর জন্য তুমি আমারে নিয়া আইছ, তোমার কাজ করমু, তোমার গোস্টির কাজও করমু, আমি কিনা দাস নাকি? শুরু হত ঝগড়া।
থাকা নিয়ে ঝগড়া হত। বাড়িতে আগে থেকেই হাসানের আলাদা একটা রুম ছিল, গাছের নীচে থাকায় রুমটি প্রাকৃতিক এয়ারকন্ডিশন্ড, সব সময় ঠাণ্ডা থাকত। সে এ রুমে থাকতে চাইত আর ফেরদৌসি ভিতরে বাতাস লাগে না এমন একটি গরম রুমে থাকতে চাইত। মেয়েকে নিয়ে টানা হেঁচড়া শুরু হত। হাসান নিয়ে আসত তার রুমে সে নিয়ে যেত ভেতরের রুমে। শুরু হত ঝগড়া। স্ত্রী খেকিয়ে উঠত- বোকা ছোদা, ভাইয়েরা সব কিছু লোটেপোটে খাচ্ছে আর তোমার একটা আলাদা ঘর করারও মুরোদ নাই, তাইলে বিয়ে করেছিলে কেন? বাড়িতে নিয়ে আস কেন? আলাদা ঘর না করলে আর জীবনেও বাড়িতে আসব না। তারপর ঘরের জন্য স্বামীকে শপথ করাত, ঘর না করা পর্যন্ত বাড়িতে নেয়ার কথা বলবে না। মুনীরা তখন বেশ মোটা সোটা নাদুস নুদুস। চাঁদের মত চেহারা, ফুট ফুটে সুন্দর। তার মা তাকে ছেড়ে রাখত, উঠোনে ধান নিয়ে খেলত, রৌদ্রে ঘোরাফিরা করত। তখন হাসানের ভায়েরা কোলে নিয়ে বেড়াত, পাড়া সুদ্ধু ঘুরত আর বলত- এ এত সুন্দর কেমনে হল?
একদিন সন্ধ্যার পর ফেরদৌসী এশার নামায পড়তে বসেছে। হাসান বারান্দায় দাঁড়িয়ে তার মায়ের সাথে আলাপ করছে। ফেরদৌসীদের আত্নীয়া একটা মেয়ের সাথে তার বিয়ের আলাপ হয়েছিল। সে মাকে বলল- আমার জন্য ঐ যে মেয়েটার বিয়ের আলাপ হয়েছিল না- আমাদের এলাকাতেই একটা ছেলের সাথে বিয়ে হয়েছে। তারপর ছেলেটার পরিচয় দিল। এর মধ্যে ফেরদৌসী এসে বলল- আপনি না পুবের ভিটা দেখাতে চেয়েছিলেন, চলেন দেখব। হাসান বলল এত তাড়াতাড়ি নামায শেষ? সে বলল হা। আসলে শুধু ফরযটুকু পড়েছে। স্বামী বলল- চল তাহলে। বউ যতবার বাড়িতে গেছে ততবারই বেলেছে- চল পুবের ভিটাটা দেখে আসি, প্রচুর ফল ফলাদির গাছ, পুকুর আরো অনেক কিছু আছে কিন্তু সে কোন দিন যায়নি। আজ যখন স্বেচ্ছায় যেতে চাইছে সে আগ্রহ সহকারেই নিয়ে গেল। হাসানের মনে কোন সন্দেহ উদয় হয়নি।
কিন্তু ভিটার পুর্ব প্রান্তে পুকুরের পুর্ব পারে গিয়ে সে মুখ খুলল- আপনে ঐ মেয়েটাকে ভালবাসেন, আমাকে ভাল বাসেন না, আমি আপনের ঘরে থাকমু না চলে যামু- বলেই মাটিতে গড়িয়ে পড়তে চাইল। সে ছিল যথেষ্ট লম্বা। হাসান দ্রুত অর্ধেক কাত হয়ে যাওয়া দেহটাকে পাঞ্জা দিয়ে ধরে সোজা করতে চাইছে, আর সে- আমি থাকব না চলে যাব- বলছে, কাঁদছে আর মাটিতে শুয়ে পড়তে চাইছে। এই লম্বা ভারি দেহটা টেনে সোজা করে বুকের সাথে পাঞ্জা দিয়ে ধরল। তারপর হাফাতে হাফাতে কাতর সুরে বলল- মাফ কইর্যা দেও, আমি বুঝতে পারিনি তুমি মনে কষ্ট পাইবা। তাহলে বলতাম না, ঐ মেয়েকে ভালবাসলে তো ওকেই বিয়ে করতাম। তোমাকে ভালবেসেছি বলেই তো ওকে না করে তোমাকে বিয়ে করেছি। তবুও রাগ করছ কেন ইত্যাদি তাফাতং দিয়ে দিয়ে, পুরা মুখ-মণ্ডল ও শরীরে হাত বুলিয়ে, চুমু দিয়ে, আদর সোহাগ ছড়িয়ে দিয়ে একটু শান্ত করল।
এখান থেকে দক্ষিনে বহুদুর বিস্তৃত তাদের জমি। দক্ষিণ দিকে গিয়ে বড় একটা আল ধরে বাড়িতে ফিরা শুরু করল। পথে সেই একই ডায়লগ। আপনি ওকে ভালবাসেন, ওকে নিয়ে থাকেন গিয়ে আমি চলে যাব। সে শতবার বুঝাল কিন্তু শান্ত হল না। বাড়িতে এসেই শ্বাশুড়ির হাতে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল- আপনে অনেক আদর করেছেন, আপনের ঋণ কোন দিন শোধ করতে পারমু না, মাফ কইর্যা দেন, আমি থাকমু না, চলে যামু। মা মনে করেছেন হাসান মাঠে নিয়ে গালি দিয়েছে বা মেরেছে, তিনি ছেলের দিকে চোখ বড় করে তাকালেন। সে হেসে উঠে বলল- আপনার সাথে ঐযে মেয়েটির বিয়ের কথা বলেছি এতেই তার আঁতে ঘা লেগে গেছে। মা ইতিপুর্বেই বউকে চিনে ছিলেন, অভ্যাস অনুযায়ী বললেন- আরে বেক্কল বেটি এইটা একটা কথা হইল, এর জন্য কাঁদতে হয়, এইটা তো যে কেউ কইতে পারে, কেঁদো না কেঁদো না- বলে মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে আদর করতে লাগলেন। তারপর দৌড়ে রান্না ঘরে গেলেন, নিজের হাতে দুধ গরম করে নিয়ে এলেন। তারপর খাটের পাশে বসে ডান হাতে মুখে গ্লাস তুলে তুলে দুধ খাওয়াচ্ছেন আর বাম হাতে মাথায় ও পিঠে হাত বুলিয়ে বুলিয়ে আদর করছেন। বাঃ, অপুর্ব দৃশ্য ! পৃথিবীর খুব কম মেয়ের ভাগ্যেই এমন শাশুড়ি জোটে।
বস্তুত ফেরদৌসীর অভিপ্সা হল স্বামী হবে সম্পুর্ন ক্রীতদাস, সাফ কাওলার গোলাম। সে প্রত্যেক কাজ স্ত্রীর ইচ্ছানুযায়ী করবে। তার কোন বাক স্বাধীনতা থাকবে না, স্ত্রীর মনে লাগতে পারে এমন কোন কথা বলবে না। এছাড়া তার অভিপ্রায় হল- সে খাটের উপর বসে বসে পা নাচাবে আর খাবে। স্বামী শাশুড়ি দেবর সবাই তাকে পুজো করবে, পেন্নাম করবে, এটা ওটা এনে খাওয়াবে, স্তুতি বাক্যে তাকে স্ফিত করে রাখবে- যেভাবে আগেকার রানীরা দাসী-বাদী পরিবেষ্টিত হয়ে স্তুতি বাক্যে সর্বদা স্ফিত হয়ে থাকত।
এখানেও সেই বাসার অবস্থা, সাধারণ টুকটাক কাজ নিয়ে শ্বাশুড়ির সাথে তর্ক লেগেই থাকত। হাসান আড়ালে আবডালে তাকে বুঝাত আর তখনি শুরু হত ঝগড়া, এসব মা দেখতেন, বুঝতেন অথচ কোন দিন তিনি বউকে একটা তিক্ত কথা বা কটু কথা বলেননি। হাসানদের বাড়িতে প্রচুর আম, আগের অভ্যাস অনুযায়ী প্রায় প্রতিদিন মা তাকে আম কেটে দিতেন। সেদিন বেলা এগারটার দিকে বউকে বললেন- হাসানকে আম কেটে দাও। সে খাটে শুয়ে বসে আছে, মেয়েকে নিয়ে খেলছে, গাল- গপ্প করছে। ওদিকে মা আম কাটার জন্য বারবার তাকাদা দিচ্ছেন কিন্তু সে শুনেই না। হাসান বারবার বলছে- যাও যাও, আম্মা মাইন্ড করবে। কিন্তু বাসায়ও যে অবস্থা এখানেও একই অবস্থা। মা ছেলে বারবার বলছে তবুও তাদের কথা তার কানেই ঢুকল না। এভাবে দু’ঘন্টা পর্যন্ত বারবার তাকাদা দিতে দিতে অবশেষে যহুরের আযান দিয়ে দিল। তখন মা একটু বিরক্তির স্বরে বললেন- তোমার আর আম কাটতে হবে না, যহুরের আযান দিচ্ছে যাও গোসল করে নামায পর গিয়ে। সে আর আম কাটলই না, অবশেষে মা-ই কেটে দিলেন। কিন্তু এখানে দুনিয়ার তাবৎ শ্বাশুড়ি- বউ এবং তামাম ইনসানিয়্যতের জন্য শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে। হাসানের মা বউকে এতটুকু রাগ দেখালেন কেন- এ জন্য সে বাসায় গিয়ে এমন এক জঘন্য মন্তব্য করে বসল- যার রেশ ধরে পরবর্তিতে শুধু সংসারটাই ভাঙ্গেনি কয়েকটা জীবনের পতন ঘটেছিল। কয়েক দিন পর তাকে নিয়ে বাসায় এসে পরল। কিন্তু এ তারিখে আসার পর সে পুরাপুরি পাগল হয়ে গেল।
দ্রষ্টব্যঃ আমার আম্মা এবং ছোট ভাই মোবারক ( যার কথা ২১-২২ নং পোস্টে বলা হয়েছে) হজ্বে যাচ্ছে, তিন তারীখে প্লাইট, সকলের কাছে দোয়া প্রার্থী। সঙ্গত কারণে লেখাটা কয়েক দিন বন্ধ থাকতে পারে।
বিষয়: বিবিধ
১৬৬৩ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন