স্বপ্ন-খুঁটির বোবা কান্না

লিখেছেন লিখেছেন চাটগাইয়া নওজোয়ান ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৮, ০৮:১৫:০৫ রাত







১৯৬৩ সালের নভেম্বর মাস


আমার সদ্য বিবাহিত বাবা শ্বশুর বাড়ী তৎকালীন সাতকানিয়া থানার অন্তর্গত আধুনগর গ্রামে বেড়াতে গিয়ে গ্রামের এ মাথা ও মাথা চযে বেড়াতে লাগলেন সাথে স্হানীয় শ্যালক এর দল.. নানা ও নানার গায়েঁর মানুষেরা শহুরে ব্যবসায়ী জামাতার সন্তুষ্টির জন্য এমন কিছু নাই যা করেননি.

বাবা সদলবলে আজ পাখি শিকারে যান তো পরদিন যান মাছ শিকারে ..

এভাবে একদিন হাজির হন একদল কৃষকের ধান কাটা দেখতে. বাবা ধান কাটা দেখতে দেখতে ধান কাটা শ্রমিকদের সাথে আলাপ জুড়ে দিলেন এ শ্রমিকরাও এই গায়েঁরই মানুষ . কথা বলতে বলতে এক পর্যায়ে বাবার দৃষ্টি পড়লো একটি কংক্রিটের পিলারের উপর..

ধানি জমির মাঝখানে পিলার কেন তা বাবার বোধগম্য না হওয়ায় ঊপস্হিত একজনকে জিজ্ঞাসা করলেন এখানে পিলার কেন জবাবে লোকটি আনন্দ মিশ্রিত কন্ঠে বললেন এটি পিলার নয় এটি আমাদের ভাগ্যের দরজা. বাবা তার কথার আগামাথা কিছুই না বুঝায় আবার জিজ্ঞাসা করলেন কেমন ভাগ্যের দরজা ?

এবার লোকটি জানাল এখানে খুব শীগগীর রেললাইন হতে যাচ্ছে এই রেললাইন স্হাপিত হবে দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত তাই পাকিস্তান রেলওয়ে অধিঃগ্রহন করে এখানে পিলার স্হাপন করেছে .. এবার বাবার মুখে হাসি ফুটল. তিনি পিলারের কাছে গিয়ে চারকোনা পিলারের চারপাশ ঘুরে দেখতে লাগলেন. সত্যিইতো পিলারের চারপাশে ইংরেজী "পি আর" লেখা বাবা খুব খুশীমনে ওখান থেকে বিদায় নিলেন ..

বাবার খুশী হবার কারন হলো তখনকার দিনে যোগাযোগ ব্যবস্হা খুব খারাপ ছিল. চট্টগ্রাম শহর থেকে দোহাজারী পর্যন্ত রেল যোগাযোগ ও মোটামুটি মানের সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্হা ছিল, কিন্তু দোহাজারীর পর অর্থাৎ সাঙ্গু নদীর অপর প্রান্ত থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত যোগাযোগ ব্যবস্হা ছিল খুব খারাপ. বাবা অত্যন্ত খুশী মনে শ্বশুরালয় থেকে বিদায় নিয়ে নতুন দিনের অপেক্ষা করতে লাগলেন দিন যায় মাস গিয়ে বছর পার হয়,

দেশ স্বাধীন হয়ে নতুন নাম ধারণ করে "বাংলাদেশ" ..

অবশ্য ১৯৬৮ সালে সাঙ্গু সেতু নির্মিত হলে সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্হা মোটামুটি সহজ হয়.



আগে যেখানে নানার বাড়ী আধুনগর পৌঁছতে বার যন্টা লাগত সাঙ্গু সেতু নির্মিত হওয়ায় তা চার ঘন্টায় নেমে আসে. এর পরেও রেলের প্রতি আগ্রহ অথবা আকুলতা বিন্দুমাত্র কমেনি. ধীরে ধীরে সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্হা আরো উন্নত হয়. আর ঝাপসা হতে হতে অন্ধকারে তলিয়ে যায় রেল যোগাযোগের স্বপ্ন ..



স্বপ্ন যতই পুরোনো হোক না কেন তা না পাওয়া পর্যন্ত বুকের ভিতর হাহাকার থেকে যায়. আলোচ্য পিলারের পাশ্ববর্তী বাড়ীতে আমার মেজো খালার বিয়ে হয় ১৯৬৯ সালে. খুব সম্ভবত ১৯৮০ সালে এক পৌযের বিকালে আমরা ভাইবোনরা খালাত ভাইবোনদের সাথে খেলাধূলা করছিলাম সামান্য দূরে পুকুর পাড়ে বাবা ও খালু গল্প করছিলেন, এক পর্যায়ে উক্ত পিলারটি যখন আমাদের নজরে আসে ততক্ষনে আমি ও বড় ভাইয়া পিলার নিয়ে গবেষনা শুরু করে দিয়েছি...

ভাইয়া তখন অষ্টম আর আমি সপ্তম শ্রেনিতে অধ্যয়নরত, পিলার সম্পর্কে দুজনের দুই রকম মত হওয়াতে বাবাকে জিজ্ঞাসা করলে তিনি জানান এটি রেললাইনের পিলার. তখন পুনরায় আমাদের সমবেত জিজ্ঞাসা কোথায় রেললাইন ?

প্রতি উত্তরে বাবা বললেন আমি ১৮ বছর অপেক্ষা করেও রেললাইনের দেখা পেলাম না আর তোমরা ৫ মিনিটেই তা পেতে চাইছ ? কথাটার সারমর্ম না বুঝায় আমরা দুভাই বাবার দিকে ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম এরপর খালু বাবার বিয়ে থেকে শুরু করে প্রথম পিলার দেখা সহ অনেক কিছু বর্ণনা করলেন বাদ গেলনা মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে তাদের অভিজ্ঞতার কথাও ...

সবশেষে খালু কৌতুক মিশ্রিত কন্ঠে বললেন আমরা বিগত ১৮ বছরে রেললাইন দেখতে না পেলে কি হবে অনাগত বছরে তোমাদের পুত নাতি ঠিকই এই রেললাইনের উপর দিয়েই কক্সবাজারে যেতে পারবে , উনার কথা শুনে আমরা দুই ভাই লজ্জা পেয়ে পালিয়ে যাই .

সেদিন থেকে ঐ পিলারটির প্রতি আমার এক ধরনের ভালবাসা জন্মে. আমি যখনি নানার অথবা খালার বাড়ী যেতাম অন্তত একবার হলেও পিলারটি দেখে আসতাম. সুযোগ পেলেই বাবাকে রেললাইনের অগ্রগতি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করতাম বাবা হাসিমুখে সব প্রশ্নের উত্তর দিতেন .

আমার বাবা ছিলেন অত্যন্ত আশাবাদী মানুষ নিরাশা বাবাকে কোনকালেই স্পর্শ করতে পারেনি. বাবা আমাকে আশ্বস্ত করে বলতেন ধৈর্য ধরো দেখবে কিছুদিনের মধ্যেই রেললাইন স্হাপনের কাজ শুরু হবে, আমিও রেললাইনের আশা নিয়ে স্বপ্নের বীজ বুনতে থাকি...

আমি শৈশব ছাড়িয়ে কৈশোর পেরিয়ে যৌবনে উর্ত্তীন হই, তখনো রেললাইনের দেখা নেই. ততদিনে বাংলাদেশ ও বিশ্ব রাজনীতি, অর্থনীতি, ও সামাজিক প্রেক্ষাপট সম্পর্কে মোটামুটি জ্ঞান হয়েছে. ১৯৯০ সালে আমি জীবিকার উদ্দেশ্যে মধ্যপ্রাচ্যে পাড়ি জমাই, দীর্ঘ ১৩ বছর চাকুরী শেষে ২০০৩ সালে দেশে চলে আসি. কাজের ব্যস্ততা ও নানাবিধ কারনে রেললাইনের চিন্তা মাথা থেকে সরে যায় তবে পিলারটির কথা মনে পড়তো...

প্রবাস থেকে প্রতি দুই বছর অন্তর অন্তর দেশে এলে নানার বাড়ী,খালার বাড়ী বেড়াতে যেতাম তবে পিলারের কাছে যাওয়া হয়ে উঠেনি. তবে একটি কারনে আবার আমাকে ঐ পিলারের কাছে যেতেই হলো..



২০০৮ সালে খালার বাড়ীতে বেড়াতে যাই, এক বিকালে আমার ৬ বছর বয়সী কন্যা আমার ভাতিজা ভাতৃকন্যা সহ অন্য সমবয়সীদের সাথে খেলাধূলা করছিল. মেয়ে এসে আমাকে পিলারের কাছে টেনে নিয়ে শুরু করল ঐতিহাসিক জিজ্ঞাসাবাদ, আব্বু এটা কি ? এখানে কেন ? ইত্যাদী..

আমি জানি জবাব দিয়ে কুলিয়ে উঠতে পারব না তবুও তার সান্তনার জন্য বললাম এটা একটা পিলার এখানে রেল লাইন হবে তার পুনরায় প্রশ্ন কখন হবে আব্বু ?

আমি বললাম হয়ত ৪০/৫০ বছরের মধ্যে হবে সে কি বুঝল কে জানে, তবে আমার মনের মাঝে তখন তুফান শুরু হয়ে গেছে. আমি ইচ্ছা করেই পিলার কাহিনী শোনালাম না, আমার প্রতীক্ষার রেশ তাকেও স্পর্শ করুক তা আমি চাইনা, কারণ বর্তমান প্রজম্মের কাছে প্রতিশ্রুতি ও প্রতীক্ষা একটি হাস্যকর বিষয়. মেয়ে তার সাথীদের নিয়ে আরেক দিকে চলে গেলে আমি ধীর পায়ে আবার পিলারের কাছে যাই হিসাব করলাম প্রায় ১৮ বছর পর এলাম আবার এই ঐতিহাসিক স্তম্ভ দেখতে. ইতিমধ্যে আমার বাবা ও বড় ভাই দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন. প্রায় ৪ ফুট উচ্চতার স্তম্ভ এখন ২ ফুটে এসে ঠেকেছে কারণটা বুঝলাম . প্রতি বছর বর্ষায় পার্শ্ববর্তী হাতিয়া খালের বাঁধ ভেঙ্গে এখানে বন্যা হয়, বন্যার পানিতে আসা পলি ও বালি জমে ভুমি উচু হওয়াতে এই দশা হয়েছে. পিলারের গায়ে হাত বুলিয়ে মনে মনে ভাবতে থাকি এখানে হয়ত কোন কালেই রেল যোগাযোগ স্হাপন হবে না. অতঃপর তারপর দিন শহর ফিরে এসে দৈনন্দিন কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ি. কিছু কিছু স্বপ্ন আছে যা বাস্তবের কাছাকাছি অবস্হান করে . ২০১০ সালে সেই স্বপ্ন পথের দিশা খুজে পায়, অর্থাৎ বর্তমান সরকারের প্রচেষ্টায় স্বপ্নের প্রকল্প আলোর মুখ দেখে. এবার স্বপ্নের পরিধি আরেকটু দীর্ঘ অর্থাৎ কক্সবাজার নয় টেকনাফ পর্যন্ত হবে এই রেলপথ....



ঐ বছরেই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কক্সবাজার এসে প্রকল্পের কাজের উদ্বোধন করলেন বলা হলো বিশেষ অগ্রাধিকার প্রকল্প হিসাবে এই রেলপথ ২০১৩ সালে রেল চলাচলের জন্য খুলে দেয়া হবে জেনে খুব ভাল লাগল....



দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্নের বাস্তবায়ন হচ্ছে দেখে মনে আর কোন শংকা রইলনা. দেখতে দেখতে ২০১৩ সাল এসে গেল....

২০১২ সালে আমার মায়ের সাথে পবিত্র হজ্ব পালন করি, পবিত্র মক্কা নগরে পবিত্র আরাফাত থেকে পবিত্র মিনা পর্যন্ত হাজী সাহেবানদের সুবিধার্থে সদ্য প্রতিষ্ঠিত আধুনিক যে ট্রেন সার্ভিস চালু করা হয়েছে তা দেখে আমাদের দেশের অতি প্রাচীন রেল ব্যবস্হার জীর্ণতার কথা ভেবে দুঃখ হয়. হজ্ব শেষে দেশে ফিরে এসে নানার বাড়ী বেড়াতে যাই যাবার আগের দিন স্হানীয় ও জাতীয় পত্রিকায় লেখা বের হয় চট্টগ্রাম টু টেকনাফ রেল যোগাযোগ প্রকল্প নাকি প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকার প্রকল্প থেকে বাদ পড়েছে. গত ৩ বছরে কাজ হয়েছে নাকি শতকরা মাত্র ১ ভাগ. মোটেও অবাক হইনি. নানার বাড়ী গিয়ে পরদিন বিকালে রেল সড়ক স্হাপনের অগ্রগতি দেখতে বের হই, জানতাম কোন কাজ হয়নি তবুও মনকে সান্তনা দেয়ার জন্য দেখা আর কি . কাজের অবস্হা দেখে মনটা খারাপ হয়ে গেল.. রেলসড়ক তো দূরের কথা এখনো এক কোদাল মাটিও পড়েনি সেখানে. রেল লাইন সংক্রান্ত কোন কাজ না হলেও একটি কাজ ঠিকই চোখে পড়লো তা হলো পুরাতন পিলারের পাশাপাশি আরো অনেক নতুন পিলার দেখা গেল, পুরাতন পিলারটি নতুন গুলির পাশে বড্ড বেমানান মনে হলো. ২০১৮ সাল বিদায়ের পথে কিন্তু স্বপ্ন এখনো অধরা .... আমি মনে মনে ভাবলাম কোন চঞ্চল শিশু তার বাবাকে প্রশ্ন করার জন্য এর চাইতে ভাল উপকরন আর কি হতে পারে ?



সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসলো আমি ফেরার পথ ধরলাম, ফেরার আগে পিলারটিকে জড়িয়ে ধরার ইচ্ছে হলো, করলামও তাই, কিছুদূর আসার পর আবার পিছনে ফিরে তাকালাম.. তিন প্রজম্মের স্মৃত্বি বিজড়িত পিলারটিকে দেখে মনে হলো সে অঝোর ধারায় কাঁদছে আর বলছে, অবাস্তব আশা নিয়ে থেকোনা অযথা এখানে এসে নিজেকে কষ্ট দিওনা .

আমি চলতে শুরু করলাম বেশ কিছু দূর আসার পর পিছনে তাকালাম গাঢ় অন্ধকার ও কুয়াশায় ঢেকে গেছে নতুন ও পুরাতন পিলার দুটি .....

.... মোহাম্মদ মুজিবুল হক

বিষয়: বিবিধ

৭১২ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

385865
২২ সেপ্টেম্বর ২০১৮ রাত ১২:৪৯
কুয়েত থেকে লিখেছেন : পৃথিবীর বহু উন্নত দেশ ঘুরে দেখার সুযোগ আমার হয়েছে আমার জন্ম ভূমি বাংলাদেশ আল্লাহর নেয়ামতে ভরপুর একটি সুন্দর তম বিশ্ব সেরা এই বাংলাদেশ। শুধু সৎলোকের শাসন ব্যবস্থা কায়েম থাকলে আমরাই হতাম বিশ্বের সেরা ধনী। এখন আমরাতো ডাকাতদের শাসনের কারনেই ক্ষতবিক্ষত ডিজিটাল বাংলাদেশ উন্নয়ন এর যে গতি কত জন্ম চলে যাবে তার হিসেব রাখা অসম্ভব। আল্লাহ্ আমাদেরকে অবৈধ জালিম সরকারের কবল থেকে রক্ষা করুন আমিন আপনাকে ধন্যবাদ
385866
২২ সেপ্টেম্বর ২০১৮ রাত ১২:৪৯
কুয়েত থেকে লিখেছেন : পৃথিবীর বহু উন্নত দেশ ঘুরে দেখার সুযোগ আমার হয়েছে আমার জন্ম ভূমি বাংলাদেশ আল্লাহর নেয়ামতে ভরপুর একটি সুন্দর তম বিশ্ব সেরা এই বাংলাদেশ। শুধু সৎলোকের শাসন ব্যবস্থা কায়েম থাকলে আমরাই হতাম বিশ্বের সেরা ধনী। এখন আমরাতো ডাকাতদের শাসনের কারনেই ক্ষতবিক্ষত ডিজিটাল বাংলাদেশ উন্নয়ন এর যে গতি কত জন্ম চলে যাবে তার হিসেব রাখা অসম্ভব। আল্লাহ্ আমাদেরকে অবৈধ জালিম সরকারের কবল থেকে রক্ষা করুন আমিন আপনাকে ধন্যবাদ

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File