মাদকাসক্তি

লিখেছেন লিখেছেন মোঃ মোরশেদুল আলম আরিফ ০৯ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬, ০৫:৪৮:৩০ বিকাল

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রায়ই বিভিন্ন অনুষ্ঠান, সেমিনার

এমনকি একনেক মিটিং বা কেবিনেট মিটিংয়েও এই

যুবসমাজের মাদকাসক্তির বিষয়টি নিয়ে পরামর্শ দেন এবং এর

থেকে জাতিকে মুক্ত করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করার কথা

বলে থাকেন। গত জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার

বিতরণকালেও তিনি একই কথা বললেন ।

সত্যি কথা হলো, চলচ্চিত্র এমনই গণমাধ্যম যার সাহায্যে জাতির

যুবসমাজকে মাদকাসক্তির অভিশাপ থেকে মুক্ত করার জন্য

একটি শক্তিশালী মাধ্যম হিসেবে কাজ করতে পারে কারণ

চলচ্চিত্রের দর্শক-শ্রোতা হচ্ছে সব শ্রেণির মানুষ,

সেখানে আছেন বাবা, মা, আছেন ভাই-বোন, আছেন

আত্দীয়-স্বজন, বন্ধুবান্ধব- সবাই মিলেই ছবি দেখেন।

ছবির কাহিনীতে যদি দেখানো যায় কীভাবে একটি

ছেলে/মেয়ে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে মাদকাসক্ত

হয়ে পড়তে পারে, কীভাবে সেই ছেলেটি বা

মেয়েটি সব পরিবারকে ধ্বংস করে দিতে পারে আবার

ঠিক অপরদিকে কীভাবে তাকে আবার পরিবারের স্নেহ,

ভালোবাসায় এবং চিকিৎসার মাধ্যমে সমাজে ফিরিয়ে আনা

সম্ভব এবং কীভাবে একজন মাদকাসক্তকে বোঝা বা

দোষী হিসেবে বিবেচনা না করে তার দোষত্রুটি

শুধরিয়ে আবার স্বাভাবিক জীবনযাপন অর্থাৎ পড়াশোনা বা

কর্মস্থলে ফিরিয়ে আনা যায়। আর এ ধরনের চলচ্চিত্র নির্মাণ

হলে পিতা-মাতারা বা অভিভাবক ও শিক্ষকরা জানতে পারবেন

মাদকাসক্তির কারণ ও লক্ষণগুলো। তাই চলচ্চিত্রের

মাধ্যমেই তারা সঠিক সময়ে তাদের সন্তানদের ব্যাপারে

আরও সচেতন হতে পারবেন এবং এভাবেই একটি

পরিবারকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করতে পারবেন।

আমাদের সমাজে কিন্তু মাদকাসক্ত ছেলেমেয়েদের

নিয়ে অনেক ঘটনাই ঘটেছে। যেমন- ২০১৩ সালের ১৪

আগস্ট আমাদের ঢাকা শহরে মর্মান্তিক সেই ঐশীর ঘটনাটি

ঘটেছিল এবং তা সারা দেশে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল,

আমরা জানতে পেরেছিলাম কীভাবে একটি মাদকাসক্ত

মেয়ে পিতা-মাতাকে খুন করতে পারে। আবার কিছুদিন না

যেতেই ২২ মার্চ পঞ্চগড়ে মা-বাবাকে হত্যা করল

মঞ্জুরুল হাসান নামে এক মাদকাসক্ত ছেলে। নেশার টাকা না

পেয়ে পঞ্চগড় জেলা সদরে বাবা-মাকে এলোপাতাড়ি

কুপিয়ে হত্যা করেছে মাদকাসক্ত ছেলে। হয়তো

আরও অনেক পরিবারে এমন ঘটনা ঘটেই যাচ্ছে,

হয়তোবা আমরা তা সংবাদপত্রে দেখি না। সুতরাং মাদকাসক্তির

কারণে এভাবে লোমহর্ষ ঘটনা একটির পর একটি ঘটতেই

থাকবে, যদি না আমরা এর বিরুদ্ধে কার্যকর ভূমিকা নিতে না পারি।

বাংলাদেশে বর্তমানে মাদকাসক্তি পরিস্থিতি কিন্তু সত্যিই

ভয়াবহ। এখানে নেশায় জড়িয়ে পড়ছে তরুণ যুবসমাজের

সঙ্গে শিশু-কিশোররাও। রাজধানীর নামিদামি স্কুল-

কলেজের শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে রাস্তায়

বেড়ে ওঠা শিশুটিও ঝুঁকছে মাদকে। নতুন ক্রেতা

পেতে সুপরিকল্পিতভাবে জাল পাতছে মাদক ব্যবসায়ীরা।

আর সেই জালেই আটকা পড়ছে শিশু-কিশোররা।

বাংলাদেশে এখন কত মাদকাসক্ত তা সরকারও জানে না। তবে

২০১২ সালের তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে ৪ লাখ ৪৫ হাজার

পথশিশু রয়েছে এবং রাজধানীতে আছে ৩ লাখেরও

বেশি। এসব পথশিশুর বেশির ভাগই মাদকাসক্ত। বাংলাদেশ শিশু

অধিকার ফোরামের তথ্য মতে, শতকরা ৮৫ ভাগ পথশিশুই

কোনো না কোনো মাদক গ্রহণ করে এবং অন্যদিকে

এসব শিশুর বেশির ভাগই কোনো না কোনো

অপরাধের সঙ্গে জড়িত। আর কিশোরীরা জড়িয়ে

পড়েছে অনৈতিক কর্মকাণ্ডে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের

তথ্য অনুযায়ী দেশের ৪৪ ভাগ পথশিশু মাদক গ্রহণ ও

বিক্রির সঙ্গে জড়িত। ৩৫ শতাংশ পথশিশু পিকেটিংয়ের সঙ্গে,

বোমাবাজির সঙ্গে জড়িত ১৬ ভাগ পথশিশু, ১২ শতাংশ

হাইজ্যাকের সঙ্গে। আন্ডারগ্রাউন্ড সন্ত্রাসীদের

সোর্স হিসেবে ৫ শতাংশ এবং অন্যান্য অপরাধের সঙ্গে

শতকরা ২১ ভাগ পথশিশু জড়িত। মাদকব্যবসা এখন সারা দেশেই

ছড়িয়ে পড়ছে। সাম্প্রতিক এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানা যায়

যে, কেরানীগঞ্জে মাদকব্যবসার জেরে এক বছরে

খুন হয়েছে ৪০ জন। তা ছাড়া সর্বনাশা মাদক ইয়াবায় ছেয়ে

গেছে সারা দেশ। সারা দেশে প্রতি বছর ইয়াবাসহ বিভিন্ন

ধরনের মাদক বিক্রি হচ্ছে হাজার কোটি টাকারও বেশি।

মিয়ানমারের সীমান্ত দিয়ে চোরাই পথে অবাধে

প্রবেশ করছে ইয়াবা। ইয়াবা ছাড়াও মাদক বাজারের প্রধান

নেশার উপকরণ হচ্ছে ফেনসিডিল, হেরোইন, মদ,

গাঁজাসহ বিভিন্ন নেশাজাতীয় ট্যাবলেট এবং চেতনানাশক

ইনজেকশন।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী (২০১৩)

বাংলাদেশে গত ছয় বছরে মাদক হিসেবে ইয়াবার ব্যবহার

বেড়েছে ৭৭ গুণ (সাত হাজার ৬২১ শতাংশ)। তবে অন্যান্য

মাদক যেমন ফেনসিডিল ও হেরোইনের ব্যবহার কিছুটা

কমেছে। গাঁজার ব্যবহার সামান্য বেড়েছে। ২০০৮ সালের

তুলনায় ২০১৩ সালে ইয়াবা উদ্ধারের পরিমাণ বেড়েছে ৭৭

গুণ। অধিদফতরের হিসাবে, বাংলাদেশে মাদক সেবনে

বছরে ব্যয় হয় প্রায় ৪ হাজার মিলিয়ন মার্কিন ডলার বা প্রায় ৩১

হাজার কোটি টাকা। দেশে প্রায় ৫০ লাখ মানুষ মাদক সেবন

করছে। কোনো কোনো বেসরকারি সংস্থার মতে

তা ৮০ লাখেরও বেশি। মোট মাদকসেবীর ৫০

ভাগেরও বেশি ইয়াবা ব্যবহার করছে ।

দেশের যুবসমাজকে আমাদেরই রক্ষা করতে হবে,

কারণ এরাই জাতির প্রাণ। এই যুবসমাজের সহযোগিতায় বাংলাদেশ

আজ এগিয়ে যাচ্ছে। বর্তমান বিশ্বে বাংলাদেশের

ক্রিকেট দল আজ গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা রাখছে।

তেমনিভাবে আইটি সেক্টরেও যুবসমাজ আজ অনেক

উন্নত বিশ্বের কাছাকাছি। চার দশকে বাংলাদেশের

উৎপাদনশীলতা বেড়েছে ৭০ ভাগ। মাথাপিছু আয়

বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি, রেমিটেন্স ছাড়িয়েছে

১৪ বিলিয়ন ডলার। অমর্ত্য সেন একাধিকবার বলেছেন, সামাজিক

সূচকে বাংলাদেশের অগ্রগতি ভারতের চেয়েও বেশি।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক জেপি মরগান ডেজ, আমাদের

পুঁজিবাজার সম্ভাবনা বিবেচনায় বলেছিল, উদীয়মান বাজারে

পাঁচটি প্রধান বিকাশমান দেশের একটি বাংলাদেশ। মানবসম্পদ

উন্নয়নে ১৮টি দেশের তালিকায় বাংলাদেশ প্রথম। বিশ্বে

সবচেয়ে বেশি রেমিটেন্স আয় করে এমন শীর্ষ

১০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ সপ্তম অবস্থানে। সুতরাং এই

উন্নয়নশীল ধারাকে অব্যাহত রাখতে আমাদের দরকার

যুবসমাজ। যারা তাদের মেধা, মনন ও দেশপ্রেম নিয়ে

আমাদের দেশকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাবে। কিন্তু তার

জন্য প্রয়োজন তাদের সঠিকভাবে পরিচালিত করা। তাই আজ

আমাদের দেশের এই সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ ও মাদকাসক্তির মূল

উৎপাটন করতে হবে এবং সে জন্য প্রয়োজন দ্রুত কিছু

পদক্ষেপ নেওয়া। যেমন মাদকাসক্তি প্রতিরোধে

গণসচেতনতা চলচ্চিত্র নির্মাণের পাশাপাশি অবৈধ মাদকদ্রব্য

পাচারের যে রুটগুলো বাংলাদেশকে ব্যবহার করছে তা

বন্ধ করা। এ জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে অগ্রাধিকার

ভিত্তিতে কিছু দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি ।

সবশেষে আশা করব, প্রধানমন্ত্রী যেভাবে সন্ত্রাস

ও মাদকাসক্তির বিরুদ্ধে আমাদের সোচ্চার ও তৎপর হতে

আহ্বান জানাচ্ছেন তেমনিভাবে প্রতিটি মন্ত্রণালয়ও যেন

তৎপর হয় । তবে সবচেয়ে বড় কথা হলো, মাদকাসক্তি

প্রতিরোধে পরিবারের ভূমিকা সর্বাগ্রে। তাই পিতা-মাতাকে

সন্তানের প্রতি আরও বেশি নজর দিতে হবে। তাদের

প্রতিদিনের রুটিন কাজগুলো দেখাশোনার পাশাপাশি তাদের

অভাব-অভিযোগ ও আবদারকেও প্রাধান্য দিতে হবে।

সেই সঙ্গে প্রতিটি ভালো কাজের প্রশংসার পাশাপাশি খারাপ

কাজের জন্য তিরস্কার ও শাসন করতে হবে। কারণ 'শাসন করা

তাকেই মানায় সোহাগ করে যে'।

বিষয়: বিবিধ

৯৮৭ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File