গডফাদারময় (Godfather) বাংলাদেশ -২ (শেখ আফিল উদ্দিন-যার ত্রাসে যশোহর কাঁপে)
লিখেছেন লিখেছেন বার্তা কেন্দ্র ১৭ জানুয়ারি, ২০১৬, ০৭:৪০:১৫ সন্ধ্যা
১ নং নিউজ :
শার্শার মৃত্যুপরীতে শেখ আফিলের শাসন :
গত সাড়ে পাঁচ বছরে যশোরের শার্শা উপজেলায় খুন হয়েছেন ৬০ জন। এর ৪০ জনই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী। আহত হয়েছেন শত শত। পুরো উপজেলায়ই এখন পরিচিতি পেয়েছে মৃত্যুপুরী হিসেবে। আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা এখন ভয়ে বাড়ি থেকে বের হন না, যোগ দেন না কোনো কর্মসূচিতেও। জরুরি কাজে বাড়ি থেকে বের হলেও বিকাল বা সন্ধ্যার আগেই বাড়িতে ফিরে গিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস নেন। তারা ভয়ে এতটাই কুঁকড়ে আছেন যে, সাংবাদিকদের সঙ্গেও কথা বলতে ভয় পান।
শার্শা উপজেলার বাগআঁচড়া ইউনিয়ন ছাত্রলীগের নেতা আহমেদ আলী শান্তি নিজ দলের ক্যাডারদের হাতেই নির্যাতনের শিকার হয়েছেন কয়েক দফা। তিনি অভিযোগ করেন, স্থানীয় এমপি শেখ আফিল উদ্দিনের ছত্রছায়ায় থাকা বকুলবাহিনী পুরো বাগআঁচড়া ইউনিয়নে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে রেখেছেন। এ বাহিনীর সদস্যরা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সহ-সভাপতি খোরশেদ আলমকে প্রকাশ্যে হাটের মধ্যে মারধর করে লাঞ্ছিত করেন। অপমান সহ্য করতে না পেরে এক সপ্তাহের মাথায় তিনি মারা যান। বাগআঁচড়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলাম বাবুকে নিজের বাড়ির ছাদ থেকে ফেলে হত্যা করা হয়। ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা সিরাজুল ইসলাম এদের হাতে কয়েকবার মারধরের শিকার হয়েছেন। তিনি এখন দলীয় কর্মকাণ্ড বন্ধ রেখে বাসায়ই অবস্থান করেন। ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ডা. সাধনকে মারধর করে পা ভেঙে দেওয়া হয়, তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানেও ভাঙচুর চালানো হয়।
উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মিজানুর রহমানকে সাতমাইল বাজারে মারধর করা হয়। উপজেলা যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মোশাররফ হোসেন মিন্টু, ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রহমান রবি, উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য মোক্তার আলী সরদারকে নির্যাতন করেন এ বাহিনীর সদস্যরা। ভুক্তভোগীদের ভাষ্যমতে, এদের হাতে এভাবে দুই শতাধিক নেতা-কর্মী নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। আরও কত মানুষ যে লাঞ্ছিত-মারধরের শিকার হয়েছেন তার হিসাব নেই। উপজেলা আওয়ামী লীগের একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা নাম না প্রকাশ করে বললেন, বাগআঁচড়ার মতো শার্শার প্রতিটি ইউনিয়নে স্থানীয় এমপি তার নিজস্ব বাহিনী তৈরি করেছেন। লক্ষ্মণপুরে কামালবাহিনী, বাহাদুরপুরে মফিজবাহিনী, বেনাপোলে ওয়াহিদবাহিনী, পুটখালিতে সিরাজবাহিনী, গোগায় রশিদবাহিনী, কায়বায় টিংকুবাহিনী, উলসীতে আইনালবাহিনী ও শার্শায় সোহরাব ও হাসান বাহিনী দলীয় নেতা-কর্মীদের জীবন অতিষ্ঠ করে তুলেছে। ওই নেতা অভিযোগ করেন, স্থানীয় এমপি তার খেয়ালখুশিমতো না চললেই এসব বাহিনীর সদস্যদের দিয়ে নেতা-কর্মীদের ওপর অত্যাচার-নির্যাতন চালান। গত সাড়ে পাঁচ বছরে শার্শা উপজেলায় যত খুন-জখমের ঘটনা ঘটেছে, তার সিংহভাগই এসব বাহিনীর হাতে হয়েছে।
উপজেলা আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের আরেক নেতা বললেন, উনি (এমপি আফিল উদ্দিন) ব্যবসা ভালো বোঝেন। ব্যবসার পরিধি বাড়ানোর জন্যই রাজনীতিতে এসেছেন। সবাইকে তার কর্মচারী মনে করেন। তার সঙ্গে যারা সবসময় থাকেন, তারা সবাই জামায়াত-বিএনপি থেকে আসা। আওয়ামী লীগের পোড় খাওয়া নেতাদের অনেক দূরে ঠেলে দিয়েছেন। সমাজবিচ্যুত ও অরাজনৈতিক লোকজনকে কাছে টেনে সরকারি সব সুযোগসুবিধা তাদেরই দিচ্ছেন। হাটে, মাঠে, ঘাটে_ সব স্থানেই তার পকেটের লোকজন। উপেক্ষিত দলের পরীক্ষিত নেতা-কর্মীরা। উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আবদুল মালেক বলেন, কয়েক বছর ধরে শার্শা আতঙ্কের জনপদে পরিণত হয়েছে। দলীয় নেতা-কর্মীরা ভয়ে বিকালের পর কেউ বাইরে বের হন না। কোনো কর্মসূচি দিলেও কর্মীরা ভয়ে আসেন না।
উপজেলা আওয়ামী লীগের আরেক নেতা বলেন, শার্শার মানুষ মনে করত দেশের বিশিষ্ট শিল্পপতি শেখ আকিজ উদ্দিনের ছেলে শেখ আফিল উদ্দিনের কোনো অভাব নেই। অথচ এখন মনে হচ্ছে তার চেয়ে অভাবী আর কেউ নেই। পুটখালি গরু চোরাচালান ঘাট সবসময় স্থানীয় দলীয় নেতা-কর্মীসহ কয়েক হাজার মানুষ ভোগদখল করতেন। এখন সেখানে সংসদ সদস্য তার পছন্দের লোকদের বসিয়েছেন। এতে তিনি নিজেও উপকৃত হচ্ছেন। খুলনা অঞ্চলের সবচেয়ে বড় গরুর হাট শার্শার সাতমাইল হাট। নিজের পছন্দের লোককে এ হাট পাইয়ে দিতে তিনি নানারকম বিশৃঙ্খলা তৈরি করেছেন। মাস্তান দিয়ে বেনাপোল বন্দর লেবার শ্রমিক ইউনিয়নেও তিনি নানারকম হস্তক্ষেপ করেন, যা নিয়ে শ্রমিক অসন্তোষও তৈরি হয়।
উপজেলা আওয়ামী লীগের দফতর সম্পাদক আজিবর রহমান বলেন, সংসদ সদস্যের কারণেই শার্শা আওয়ামী লীগ স্থবির। গঠনতন্ত্রের তোয়াক্কা না করে নিজের ইচ্ছা অনুযায়ী দল পরিচালনা করতে গিয়েই এ অবস্থার সৃষ্টি। বছর পার হয়ে গেলেও উপজেলা কমিটির একটি মিটিংও হয়নি। কেন্দ্রীয় সব কর্মসূচিই দায়সারাভাবে ঘরের মধ্যে পালন করা হয়। আজিবর রহমান বলেন, গত সাড়ে পাঁচ বছরে দলীয় নেতা-কর্মীরা যেভাবে অত্যাচার-নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, তাদের প্রায় সবাই এখন নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছেন।
গত সরকারের আমলে পুলিশ পিটিয়ে সারা দেশে সমালোচিত হয়েছিলেন শেখ আফিল উদ্দিন। ২০১০ সালের ১৫ আগস্ট শার্শা থানার তৎকালীন ওসি এনামুল হক, এসআই আসাদসহ ছয় পুলিশকে ডেকে নিয়ে মারধর করেছিলেন বলে সে সময় পত্রপত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে আবারও বিতর্কের ঝড় তোলেন শেখ আফিল উদ্দিন। নিজে যশোর-১ আসন থেকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। পাশের আসন যশোর-২ তথা ঝিকরগাছা-চৌগাছা উপজেলায় তারই আত্দীয় মনিরুল ইসলামকে বিজয়ী করতে জোর প্রচেষ্টা চালান। এক নির্বাচনী সভায় তিনি মাইকে তার কর্মীদের ভোটকেন্দ্র দখল করে মনিরুল ইসলামের পক্ষে জাল ভোট দেওয়ার নির্দেশনা দেন। তার এ বক্তব্যের অডিও নির্বাচন কমিশনে গেলে বিষয়টি নিয়ে তদন্ত হয়। আচরণবিধি লংঘনের অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে। দুজনের শপথ নেওয়াও স্থগিত হয়ে যায়। পরে অবশ্য দুজনই সংসদ সদস্য হিসেবে শপথ নিয়েছেন। এর আগে বেশ কয়েকবার জেলা আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা প্রকাশ্যেই শেখ আফিল উদ্দিনের সমালোচনা করেছিলেন। তারা সে সময় অভিযোগ করে বলেছিলেন, আত্দীয়স্বজন আর নিজের কর্মচারী দিয়ে দল চালাতে চাইছেন শেখ আফিল। এভাবে দল চলতে পারে না।
এসব বিষয়ে কথা বলার জন্য যশোর-১ (শার্শা) আসনের সংসদ সদস্য শেখ আফিল উদ্দিনের মোবাইল ফোনে গতকাল সন্ধ্যায় যোগাযোগ করা হয়। এমপি আফিল তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ শতভাগ মিথ্যে বলে দাবি করেন। অন্যদিকে যারা অভিযোগগুলো তুলছেন তারা দলের সাবেক বলেও তিনি মন্তব্য করেন। বকুল বাহিনীর বিরুদ্ধে ত্রাসের অভিযোগও তিনি উড়িয়ে দেন। এমপি দাবি করেন, চেয়ারম্যান বকুল জনপ্রিয় বলেই ইউপি নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছেন। এবং তিনি বর্তমানে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকও।
(দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন-২১ জুন ২০১৪)
২নং নিউজ :
যশোরের শার্শা-বেনাপোল এলাকায় সরকারদলীয় সংসদ সদস্য আফিলের তত্ত্বাবধানে সৃষ্টি হয়েছে খুনোখুনির সাম্রাজ্য। সেখানে গত কয়েক বছরে এক উপজেলায় অন্তত ৬৪ জন হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে ৪৪ জনই হচ্ছেন আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী। ওই জনপদে প্রভাবশালী এমপি শেখ আফিল উদ্দিনের বিপক্ষে গেলে তার আর নিস্তার নেই। শার্শার প্রতিটি এলাকায় তার নিয়ন্ত্রিত একটি করে নিজস্ব সশস্ত্র বাহিনী আছে। যেমন বাগচড়ায় বকুলবাহিনী, লক্ষণপুরে কামালবাহিনী, বাহাদুরপুরে মফিজবাহিনী, বেনাপোলে ওয়াহিদবাহিনী, পুটখালীতে সিরাজবাহিনী, গোগায় রশিদবাহিনী, কায়বায় টিংকুবাহিনী, উলশিতে আইনালবাহিনী, শার্শায় সোহরাব ও হাসান বাহিনী।
২০১০ সালের ১৫ আগস্ট শার্শা থানার ওসিসহ ছয় পুলিশকে এমপি আফিল নিজ হাতে পিটিয়ে আহত করে ব্যাপক সমালোচিত হন। তাদের তিনি হুমকি দিয়ে বলেন, 'এখানে থাকতে হলে আমি যা বলব তা-ই শুনবি। নতুবা মেরে আমার মিলের ভিতর পুঁতে রাখব।' এ ব্যাপারে ওসি এনামুল হক বাদী হয়ে এমপি শেখ আফিল ও মুসা মাহমুদসহ চারজনের বিরুদ্ধে শার্শা থানায় জিডি করেছেন। জিডি নম্বর ৫৪৬/১০, তারিখ ১৫.১০.২০১০। জিডিতে উলি্লখিত অন্য দুজন হচ্ছেন এমপির পিএস আসাদ ও কামাল।
আওয়ামী লীগের এ সংসদ সদস্যের গাড়িবহরে অভিযান চালিয়ে র্যাব অবৈধ বিদেশি অস্ত্রশস্ত্র ও শার্শা উপজেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক সোহরাব হোসেনসহ (৪০) যুবলীগের পাঁচ কর্মীকে আটক করে। আটক অন্যরা হলেন যুবলীগ কর্মী বেনাপোলের বড়আঁচড়া গ্রামের বাবলু রহমান (৩৫), শার্শার উত্তর বুরুজবাগান গ্রামের জাকির হোসেন (৩০), রুহুল আমিন (৩৫) ও সাইফুল ইসলাম (২৮)। এদিকে বেনাপোল পৌরসভার প্যানেল মেয়র, শার্শা উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি তারিকুল আলম তুহিনের (৩৮) রহস্যজনক অপহরণ ও গুমের ঘটনায়ও এমপি আফিলকে দায়ী করেন অনেকে। ঢাকার শেরেবাংলা নগরে ন্যাম ভবনে যশোর-১ শার্শা আসনের এমপি শেখ আফিল উদ্দিনের বাসা (এমপি হোস্টেল) থেকে ২০১৩ সালের ৭ মার্চ বেলা ১১টার দিকে নিখোঁজ হন তুহিন। ১৬ মাস পার হলেও এখন পর্যন্ত তার কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি। তুহিন বেনাপোল পৌরসভার ভবারবেড় গ্রামের আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সহ-সভাপতি ডা. ইউসুফ আলমের ছেলে। ঘটনার সময় এমপি আফিলের সঙ্গে তুহিনের খারাপ সম্পর্ক যাচ্ছিল। তাকে বশ মানিয়ে নিজের আজ্ঞাবহ বানাতেই তুহিনকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন এমপি। ঢাকায় এসে তুহিন আর বাড়ি ফিরে যেতে পারেননি। জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি এমপি শেখ আফিল উদ্দিনের বিরুদ্ধে শুধু শার্শা নয়, ঝিকরগাছা উপজেলায় সন্ত্রাসে মদদের অভিযোগ রয়েছে। তার কথার অবাধ্য হলে সরকারি চাকরিজীবী থেকে শুরু করে নিজ দলের নেতা-কর্মী কেউই রক্ষা পান না। শেখ আফিলের অনিয়ম-সন্ত্রাসের বিপক্ষে অবস্থান নেওয়ায় মেয়র লিটনকে নানাভাবে হয়রানি করা হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। সম্প্রতি মেয়র লিটন যশোরে সংবাদ সম্মেলন করে এ ধরনের ইঙ্গিত দেন। একই কথা বলেন সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান আবদুল মান্নান মিন্নু। তাকে রাজনীতিতে কোণঠাসা করতে নাভারণ বাজারে হামলা ও লাঞ্ছিত করা হয় বলে অভিযোগ তার। এপ্রিলে এমপির পোষ্য বকুলবাহিনী উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আলী আহম্মাদ শান্তিকে সাতমাইল বাজারে মারধর ও তার বাড়িতে বোমা হামলা করে। এমপি বাহিনীর ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন উপজেলা ছাত্রলীগের বর্তমান সাধারণ সম্পাদক আবুল হোসাইন।
আরো দেখুন :
http://www.jugantor.com/old/first-page/2015/06/02/272796
বিষয়: বিবিধ
১৩৯৪ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন