আত্মপক্ষঃ দেশী না প্রবাসী ?
লিখেছেন লিখেছেন মহুয়া ২৭ এপ্রিল, ২০১৫, ০৯:১২:০৫ রাত
ইসলামের আগমনে, মক্কা তথা আরবে প্রথম যে বিপ্লবটা ঘটেছিল, তাহল, গোত্রের উপরে গোত্রের শ্রেস্টত্বের যে কালচার ছিল, তা ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। একটা গোত্রের উপরে গোত্র নয়, কিম্বা একটা দেশের উপর কোন দেশ শ্রেষ্ট নয়। সাদা চামড়া যেমন কাল চামড়ার উপরে শ্রেষ্ট নয়, আরবও তেমন অনারবদের উপরে শ্রেষ্ট নয়! সবার উপরে শ্রেষ্ট হলেন তিনি, আল্লাহ্ পাক- আল্লাহু আকবর। এরপর আল্লাহর নির্ধারিত ব্যাক্তি, রাসূল (সাঃ)। তাঁর মতে –‘ তোমাদের মধ্যে সেই উত্তম, যার স্বভাব চরিত্র (আখলাক) উত্তম’! একজন মানুষের মানবিক প্রকৃতি, তার চারিত্রিক গুণাবলী, তার তাকওয়া’ই নির্ধারণ করবে মানুষ হিসেবে সে কেমন। কে কোন দেশে বা গোত্রে জন্মেছে, কে কোন অট্টালিকায় বাস করে, কে সোনার চামচ মুখে নিয়ে ঘোরে, মানুষের জন্য এটা মূল কোন পরিচয় নয়। এজন্য একজন বেলাল, একজন সালমান ফারসী আরব না হয়েও, কুরাইশ না হয়েও, অনেক কুরাইশের উপরে , অনেক আরবের উপরে, স্থান পেয়েছেন। জন্ম হোক যথা তথা, কর্ম হোক ভাল। মুসলিম হয়ে জন্মানোর চাইতে, মুসলিম হয়ে মৃত্যুবরন করতে পারাটাই সৌভাগ্যের বিষয়।
জাতীয়তাবাদ তথা কোন নির্দিষ্ট ভূখন্ডের মধ্যে নিজেকে আবদ্ধ করে, তার শ্রেষ্টত্বের গুণ গান করা এক ধরনের রোগ! অহংকার এই রোগের নাম। মিশরের ফারাও নিজের শ্রেষ্টত্ব দাবী করতে গিয়েই ধ্বংস হয়েছে। গ্রীক আলেকজান্ডার মারা গেলে শুন্য হাতদুটো কফিনের বাইরে রেখে দিতে বলেছিলেন, উদ্দেশ্য? মানুষ যেন জানে, শেষ বিদায়ের দিন কিছুই সঙ্গে যাবে না। অনেকে বলে, মানুষ যে বেশে এসেছে, সে বেশেই ফিরে যাবে। কথাটা সঠিক নয়, এসেছে কাপড় ছাড়া,খোলা চোখে; আর যাবে কাফনের কাপড় নিয়ে, চোখ মুখ ঢেকে! মিনহা খালাক্কনাক্কুম, ওয়া ফি হা নূঈদুক্কুম- তারাতান উখরা!
নেহায়েত সংখ্যা লঘু হিসেবে, বিদেশে থেকেও, আমি যখন সর্বদা আমার দায়িত্ব সম্বন্ধে সচেতন, আমার পরিবারের প্রতি, আমার প্রতিবেশীর প্রতি; আমি সহকর্মী বা প্রতিবেশীর মঙ্গল কামনা করি, প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে তাদের সাহায্য করি, কারো কোন ক্ষতি করি না এমনকি ক্ষতির চিন্তাও করি না। আমার ঘড়ের লাগোয়া রাস্তা বা ফুটপাতের বরফ পরিষ্কার সময়, তার ঘরের ফুটপাতের বরফও মাঝে মাঝে পরিষ্কার করি, সেই প্রতিবেশী এদেশের মিডিয়ার ইসলাম বিরোধী প্রচার বিশ্বাস করবে, নাকি তার প্রতিবেশীর প্রত্যক্ষ আচরণ বিশ্বাস করবে? এদেশে অনেক অমুসলিম, এত ইসলাম বিরোধী প্রচার চলার পরেও, ইসলাম গ্রহণ করছে। আমি যে মসজিদে জুমা আদায় করি, মাঝে মাঝে দুয়েক সপ্তাহ বাদ যায়, এছাড়া প্রায় জুম্মাতেই মানুষ ইসলাম গ্রহণ করছে, শাহাদা উচ্চারণ করছে – বিভিন্ন বর্ণের মানুষ, নারী- পুরুষ। ইমাম সাহেব জিজ্ঞেস করছেন, রুটিন হিসেবে, ‘তোমাকে কি কেউ বাধ্য করছে, নাকি নিজের ইচ্ছায় ইসলাম গ্রহণ করছ? সে উত্তর দিচ্ছে, নিজের ইচ্ছাতেই। আমরাও সাক্ষী হিসেবে, তাকবীর দিচ্ছি- আল্লাহু আকবর । কোন সাজ সজ্জা বা আড়ম্বর ছাড়াই, একজন মানুষ ট্রান্সফর্ম হয়ে যাচ্ছে, এক নূতন মানুষে রূপান্তরিত হচ্ছে। এ ঘটনা গুলোকে অনেক সময় ‘ অবাস্তব মনে হয় । অথচ এই ঘটনাবলী আমাদের চোখের সামনেই ঘটছে! হ্যাঁ, মূর্খের সংখ্যা এদেশগুলোতেও আছে। হিংসা, ঘৃণা – মানুষের পশুত্বের প্রকাশ এখানেও হয়। একজন ছাত্রলীগের অস্ত্রধারী যেমন করে একজন বি এন পি বা শিবিরের সমর্থকের প্রতি সহিংস আক্রমণ চালায়, বা এর উল্টোটা, এমন ঘটনা এখানেও কিছু ঘটে না এমন নয়। একটা ঘটনা না বলে পারছি না।
কানাডার একটা শহরে ‘জাতিগত বিদ্বেষ’ এর উপরে একটা সোশ্যাল এক্সপেরিমেন্ট করছিল ইউনিভার্সিটির ছাত্ররা। একটা ছেলে ‘ডিশ ডাশা ( বাংলায় জুব্বা) ও টুপি পরে বাস টার্মিনালে দাঁড়িয়ে আছে, এশিয়ান, মধ্য প্রাচ্যের মানুষের মত চেহারা । তারই আরেক বন্ধু, সে শ্বেতাঙ্গ এবং আলোচ্য এক্সপেরিমেন্টে ভিলেনের ভূমিকায় অভিন্য় করছিল। সেও লাইনে দাঁড়িয়ে। আরও অনেক মানুষ লাইনে অপেক্ষা করছে, নানা বর্ণের, নানা বয়সের নারী পুরুষ। প্রথম থেকেই শ্বেতাঙ্গ ভিলেন, জুব্বা পড়া ছেলেটার বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করছে। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ করা ভাল, এর আগের সপ্তাহে এক ‘তথাকথিত মুসলিম ( সম্ভবতঃ মানসিক সমস্যার রোগী), গুলী করে অটোয়াতে যুদ্ধ স্মৃতি সংগ্রহশালার গার্ড- এক সৈনিককে মেরে ফেলেছে; সকল পত্রিকা, মিডিয়া। কানাডার – প্রাইম মিনিস্টার স্টিভেন হারপার ও তার মন্ত্রী বাহিনী, রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে, এই ঘটনাকে কানাডায় সন্ত্রাসী হামলা বলে চিহ্নিত করার সব রকমের প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কাজেই দেশের পরিস্থিতি খুব গরম, এন্টি মুসলিম সেন্টিমেন্ট প্রবল । এহেন পরিস্থিতিতে, জন সম্মুখে শ্বেতাঙ্গ ভিলেনের কটূক্তি, ‘মুসলিমের প্রতি সহানুভূতি জাগাতে ব্যর্থ হবে এমন ধারনা হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু না। একজন মধ্য বয়সী কানাডিয়ান ‘হস্তক্ষেপ করল। ‘ তাকে একা থাকতে দাও। একজনের দোষে সবাইকে অভিযুক্ত করা ঠিক না। সে যখন উত্তরোত্তর বিরক্ত করছে, এক পর্যায়ে এই লোকের ঘুসিতে তার নাক ফেটে যায়। ভিডিও টি এখানেঃ
https://www.youtube.com/watch?v=p9rFprD_Qf4
ইসলাম গ্রহণের কারনে, পরিবার – বাবা মা ভাই বোন, বন্ধু, চেনা বৃত্তের আওতা, অনেক সময় স্ত্রী বা স্বামী ছেড়ে বড় নিঃসঙ্গ হতে হচ্ছে অনেককে। তাদের ঐকান্তিক চেষ্টা, কুরআন শেখা, নামাজে হাঁটু গেড়ে বসা ( জন্মের পর থেকে এ কাজ তারা করেনি, চেয়ারে টেবিলে বসে অভ্যস্ত, উপমহাদেশের কারো জন্য এটা কোন জটিল কিছু নয়, কিন্তু এখানে এটা এক কঠিন পরীক্ষা – কারো কারো জন্য) । পাশের মহল্লার ‘আব্দুল্লাহ জন’ (John তার নাম, ইসলাম গ্রহণ করে আব্দুল্লাহ হয়েছে, সবাই তাকে আব্দুল্লাহ জন বলে ডাকে), এশার নামাজ পরে আমরা যখন ঘড়ে ফেরার জন্য তারাহুড়া করছি, সে আরও মনোযোগ দিয়ে নফল নামাজ দীর্ঘ করছে! অবাক হয়ে যাই নামাজে তার একাগ্রতা দেখে। আমাদের নামাজ তার তুলনায়, যেন তাড়াহুড়া করে শেষ করা এক রুটিন কর্ম, ঘাড়ের বোঝা নামানো। আর তার নামাজ দেখলে মনে হয়, কত ভালবেসে, কত যত্নের সাথে- একাগ্রতা আর নিষ্ঠার সাথে ‘প্রভূর সামনে সে দন্ডায়মান! শেখার আছে তার কাছে! মুসলমানের ঘড়ে জন্ম নিয়ে আমরা মুসলিম হয়েছি, কাজেই আমাদের চিন্তাতেই আসবে না, কতখানি ত্যাগ স্বীকার করতে হয় একজন প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষকে নূতন একটি ধর্ম গ্রহণ করার কারনে। একদিনে সে সংখ্যা গরিষ্ট থেকে সংখ্যালঘুদের কাতারে এসে গেল, ব্রাহ্মণ যেন রাতারাতি কৈবর্ত হয়ে গেল! এর যন্ত্রণা আমাদের অনেকের রাডারেই ধরা পড়বে না! এছাড়া, আমরা উপমহাদেশের মুসলিম, প্রথা/ সংস্কৃতির ব্যাগেজ নিয়ে এসেছি, প্রকৃত ইসলামের সাথে যা ‘ভেজাল’ হিসেবে মিশে গেছে, এরা সেই ‘ভেজালটুকু ধরিয়ে দিতে সাহায্য করছে। আমি এখন বাছাই করতে পারছি, আমার চিন্তা চেতনার কতটুকু শুদ্ধ ইসলাম, আর কতটুকু আমার কালচার বা প্রথা থেকে এসেছে! দেশে থাকলে যা সামাজিকতার নামে, ইসলামের অংশ হিসেবেই ভাবতাম। ভাল গুণ যে একেবারেই নেই, তা বলব না।
আমরা যে প্রবাসে এসেছি এটাও আল্লাহ্ পাকের ইচ্ছাতেই হয়নি তা কে বলবে? (আমি আত্মপক্ষ সমর্থন করছি, অনেকে ভাবছেন, হয়তো সেটাই সত্যি!)। তবে একজন আফরা যখন হিজাব পড়ে ডেনমার্কের রাস্তায় হাঁটেন, কিম্বা একজন সুমাইয়া যখন হিজাব পড়ে টরোণ্টো বিশ্ববিদ্যালয়ে যায়, এই দুর্যোগপূর্ণ সময়ে, সেটাও এক ধরনের জেহাদ এবং পাশাপাশি, এক ধরনের দাওয়াতও বটে। বিধর্মীরা এ অবস্থায় তাদের দেখছে, ভাবছে, চিন্তা করছে, তুলনা করছে! যেখানে নিজেদের শরীরের খাঁজ ভাঁজ দেখানোর চেষ্টায় এদেশের তরুণীরা ‘ক্রুসেডে লিপ্ত, আর সেখানে মুসলিম মহিলা ‘উদ্দেশ্য প্রণোদিত হয়ে, তার নিজের ‘সৌন্দর্যকে আড়াল করছে, ঢেকে রাখছে! কেন? এনিয়ে চিন্তা করে, গবেষণা করে, অনেকে ইসলাম গ্রহণ করছে! গল্প নয়, সত্যি।
দেশে ইসলামী জীবন ব্যবস্থা চালু রাখার জন্য, ইসলামী শাসন বা হুকুমত কায়েমের জন্য ‘মুসলিমদের জিহাদ যেমন জরুরী, এদেশে অমুসলিমদের দাওয়াত দেয়াও তেমন জরুরী। কোনটা বেশী জরুরী, কোনটা আগে বা কোনটা পরে, মুরগী আগে নাকি ডিম আগে- তা নিয়ে বিতর্ক করার সময় বা ইচ্ছে আমার নেই।
তবে এটুকু বলব, স্রোতের অনুকূলে ভেসে চলা কঠিন কিছু নয়, কচুরী পানার জন্যও তা সহজ। বাংলাদেশে, একজনের মুসলমান হয়ে চলার মধ্যে খুব বেশী গর্বের কিছু নেই, ( যেখানে ৯০ ভাগ মুসলমান, নাম মাত্র হলেও; তবে হ্যাঁ, ভাল মুসলিম বা পরহেজগার মুসলিম সৎ, আদর্শ মুসলিম হওয়ার মধ্যে অবশ্যই গর্ব করার আছে, তারা যে প্রতি মুহূর্তে পরীক্ষা দিয়ে চলছেন - বলা বাহূল্য। ) । কিন্তু স্রোতের বিপরীতে চলা খুব কঠিন কাজ, বিশেষ করে যেদেশে শতকরা ৯৫ জন অমুসলিম! এখানে একজন ভাল মুসলিম হয়ে চলার জন্য, ভেতরে ‘বস্তু না থাকলে, – কোন ভাবেই সম্ভব নয়। চারিদিকে এত প্রলোভন, রাস্তা এত ঢালু যে, একটু অসাবধান হলেই, গাড়ি খাদে তলিয়ে যাবে! এই চাপ সহ্য করেও যারা নিজেদের ধর্ম, সংস্কার, তাহজীব তমদ্দুন নিয়ে টিকে আছেন বিদেশ বিভূঁইয়ে, নিজেদের ঘনিষ্ট আত্মীয় পরিজন, বা গোত্রের প্রভাব ব্যাতিরেকেই, তাদেরকে দেশ ছেড়ে আসার জন্য আমি মন্দ বলি না, বরং স্যালুট করি তাদের এই বৈরী পরিবেশে টিকে থাকার ‘অধ্যবসায় দেখে। এভাবে তাঁরা টিকিয়ে রাখছেন শুধু নিজেদেরই নয়, পাঠানো কষ্টার্জিত ‘ডলারের মাধ্যমে তাঁরা টিকিয়ে রাখছেন অধূনা বাংলাদেশ নামের এক হত দরিদ্র ‘ তলাবিহীন ঝুড়িকেও !
পূণশ্চঃ একজনের আমল নামার জবাবদিহি তাকেই করতে হবে, আমরা কেউ যেন অপরপক্ষকে ছোট না ভাবি! শত্রুর দেশ (দারুল হরব) বা মিত্রের দেশের ফতোয়া ‘গ্লোবাল ভিলেজ’ র যুগে নূতন করে ভাবতে হবে। যেখানে যে আছি, যার যার দায়িত্ব ঠিক ভাবে পালন করলেই হল!
( কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ একজন প্রবাসী ব্লগার এর লেখা ‘পরিচয়’ এর সমর্থনে )
বিষয়: বিবিধ
১৫৪৭ বার পঠিত, ৫ টি মন্তব্য






































পাঠকের মন্তব্য:
দারুল হরব হবে সেই দেশ যে দেশ মুসলিমদের সাধারন কর্তব্যগুলি যথা নামাজ,রোজা,যাকাত এবং মুসলিম দের উপযুক্ত পোষাক পরিধানে বাধা দেয়। এই দৃষ্টিকোন থেকে পশ্চিমা দেশগুলির তুলনায় আমাদের দেশ বা মিসর দারুল হরব এর পর্যায়ে পরে। কারন আমাদের দেশে এখন শালিন পোষাক আর ইসলামি বই পড়া কে রাস্ট্রিয়ভাবে বাধা দেওয়া হয়।
কেন?
এনিয়ে চিন্তা করে, গবেষণা করে, অনেকে ইসলাম গ্রহণ করছে! গল্প নয়, সত্যি।"...... অসাধারণ ! সত্যিই অসাধারণ লিখেছেন .....
মন্তব্য করতে লগইন করুন