একজন মারিয়া কনসিকাও
লিখেছেন লিখেছেন ইগলের চোখ ৩১ অক্টোবর, ২০১৬, ০৫:০৫:২৮ বিকাল

মানবতা যে এক বিশ্বজনীন আবেগ তা আবারও প্রমাণ করেছেন মানবহিতৈষী পর্তুগিজ নারী-মারিয়া কনসিকাও। যার ধ্যান-জ্ঞান, সচেতনার চিন্তার সবটুকু জুড়ে থাকে ঢাকার সুবিধাবঞ্চিত বস্তিবাসী শিশুদের জীবনের শুরু থেকেই দেশে-বিদেশে ব্যয়বহুল উন্নত শিক্ষা ও কর্মসংস্থান গড়ে দেয়ার নিরলস কর্মপ্রচেষ্টা। অনন্য মানবিকতাবোধে উজ্জীবিত এই মহিয়সী নারী এ জন্য বিসর্জন দিয়েছেন নিজের ব্যক্তিগত সুখ-শান্তি। প্রয়োজনীয় তহবিল গঠনে ব্যতিক্রমী ও কঠিন শ্রমসাধ্য
কর্মপ্রক্রিয়া অনুসরণ করে একে একে দুঃসাধ্য সাধন করে চলছেন। ১০ লাখ ডলারের তহবিল সংগ্রহের চেষ্টায় পরপর সাত দিনে সাতটি মহাদেশে সাতটি ম্যারাথন দৌড় শেষ করার কঠিন সংকল্প নেমেছিলেন। বৈরী আবহাওয়া বাধা পেরিয়ে সংকল্পে দৃঢ় মারিয়া শেষ পর্যন্ত আগের ৪৮ দিনের রেকর্ড ভঙ্গ করে ১০ দিন ২৩ ঘণ্টা ৩০ মিনিটের মাথায় ‘৭৭৭ চ্যালেঞ্জ’ খ্যাত এই লক্ষ্য অর্জন করে গড়েন নতুন রেকর্ড। প্রতিটি মহাদেশে ম্যারাথন ও আল্ট্রাম্যারাথন সম্পন্ন করার মোট সময়ের নতুন তিন রেকর্ডসহ এখন তিনি মোট ছয়টি বিশ্বরেকর্ডের মালিক। প্রথম পর্তুগিজ নারী হিসেবে জয় করেছেন এভারেস্ট। নিরলস শ্র্রমের স্বীকৃতিতে পর্তুগালে ‘উইমেন অব দ্য ইয়ারে’ ভূষিত হয়েছেন। তবে ৬ মাসের কঠিন সাধনার পরও ইংলিশ চ্যানেল পার হতে গিয়ে ব্যর্থ হয়েছেন। কিন্তু থেমে নেই অদম্য মারিয়া, দূর পরবাসে বাংলাদেশের হতদরিদ্র শিশুদের উন্নত জীবনের নিশ্চয়তা দিতে আরও কঠিনতর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার দৃঢ়তর সংকল্পে প্রতিনিয়ত দৃপ্ত পদক্ষেপে এগিয়ে চলছেন। এমিরেটস এয়ারলাইন্সের সাবেক বিমানবালা এই পর্তুগিজ নারী জয় করেছেন ঢাকার হতদরিদ্র শিশুদের হৃদয়। এমিরেটসের চাকরির সুবাদে ২০০৩ সালে প্রথম বাংলাদেশে আসা মারিয়া যাত্রাবিরতিতে ঢাকা শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের আশপাশে হাঁটার সময় স্বল্প বয়সী, হতদরিদ্র, বস্তিবাসী শিশুদের ভিক্ষা করতে দেখে মর্মাহত হয়েছিলেন। পরবর্তী ঢাকার কয়েকটি বস্তি পরিদর্শনে মানবতার চূড়ান্ত বিপর্যয় দর্শন তাকে এতোটাই বিপর্যস্ত করেছিল যে, বস্তিবাসী শিশুদের উন্নত শিক্ষা ও পরিবারগুলোর কর্মসংস্থান করে তাদের জীবনকে স্বাচ্ছন্দ্যময় করতে নিজের উপার্জিত টাকায় তাদের সেবা করতে নেমে পড়েন। নিজের বেতনের টাকায় ২০০৫ সালে প্রথমে ঢাকা প্রজেক্ট নাম দিয়ে মহাখালীর কড়াইল বস্তি থেকে ৪০টি দরিদ্র পরিবারকে বিমানবন্দরের পূর্ব পাশে দক্ষিণখানের গাওয়াইর এলাকায় ভাড়া বাসায় পুনর্বাসিত করেন। তাদের পরিবহন খরচসহ ৬ মাস থাকা-খাওয়া থেকে শুরু করে সব ধরনের খরচ বহন করেন মারিয়া। এর মধ্যে মহিলাদের সেলাই মেশিন, বিউটি পার্লারসহ বিভিন্ন প্রশিক্ষণ দিয়ে কর্মসংস্থান করে দেয়া হয়। পুরুষদের দেয়া হয় ড্রাইভিংসহ বেশকিছু প্রশিক্ষণ। আর তাদের সন্তানদের উন্নত শিক্ষার জন্য খোলা হয় স্কুল। গাওয়াইরে ৩৯ শিশু নিয়ে ২০০৫ সালে শুরু হয় প্রথম শিক্ষা কার্যক্রম। তখন থেকেই খাতা-কলম, ব্যাগ, টিফিন, চিকিৎসা, ওষুধ, চাল-ডালসহ শিশুদের যাবতীয় ব্যয়ভার তিনিই বহন করে আসছেন। পরের বছরই বিভিন্ন ক্লাসে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ২০০ ছাড়িয়ে যায়। ২০০৭ সালেই ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা পৌঁছে প্রায় ৫০০ জনে। ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার পর থেকে মারিয়া পরিবারের সদস্য, বন্ধু-বান্ধব ও এয়ারলাইন্সের আর্থিক সহায়তা পেয়ে আসছিলেন। কিন্তু ২০১৩ সালে অর্থসংকটে বন্ধ হয়ে যায় স্কুলের কার্যক্রম। এক বছর বন্ধ থাকে কার্যক্রম। ২০১৪ সালে নিজের পালক মায়ের নামে মারিয়া ক্রিস্টিনা ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করে আবারও খুঁজে আনেন তার প্রাণপ্রিয় সুবিধাবঞ্চিত শিশু-কিশোরদের, তবে একটু ভিন্নভাবে। ঢাকায় নির্ভরযোগ্য ভালমানের স্কুল-কলেজ সম্পূর্ণ নিজের খরচে তাদেরকে ভর্তি করান। সারা বছর তাদের শিক্ষার যাবতীয় ব্যয়ভার বহন করছে তার ফাউন্ডেশন।বাংলাদেশের সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের উন্নত শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের জন্য বার বার তহবিল সংকটে পড়ছেন মারিয়া। নিজের সর্বস্ব দিয়েও কুলাতে না পেরে একের পর এক কঠিন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে সংগ্রহ করছেন তহবিল। পর্তুগিজ এই নারীর অনন্য উদ্যোগ ইতিমধ্যে বিভিন্ন গণমাধ্যমের শিরোনাম হয়েছে। মারিয়ার অনন্য মানবিকতাবোধে অভিভূত হয়ে পর্তুগালের পুরুষদের ফ্যাশন, সংস্কৃতি ও লাইফস্টাইল ভিত্তিক সাময়িকী জি কিউ কর্তৃপক্ষ তাদের ‘ম্যান অব দ্য ইয়ার’ পুরস্কার প্রদানের ধারাবাহিকতার ব্যত্যয় ঘটিয়ে এবার মারিয়াকে ‘উইম্যান অব দ্যা ইয়ার’ ঘোষণা দিয়েছে। ভিনদেশি এই মহিয়সী নারীর অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত আমাদের দেশীয় সমাজসেবকদের অনুপ্রাণিত করবে স্বদেশের বিপন্ন মানবতার প্রতি সহমর্মীতার হাত বাড়াতে, এটাই সকলের প্রত্যাশা।
বিষয়: বিবিধ
১১৭২ বার পঠিত, ৩ টি মন্তব্য






































পাঠকের মন্তব্য:
ভালো লাগলো / অনেক ধন্যবাদ / পিলাচ
মন্তব্য করতে লগইন করুন