#বাচালতা_বর্জনীয় ও #চুপ_থাকার_ফযিলত (বাক-বাগ্মীতা ও কথা বলার শিষ্টাচার-৩
লিখেছেন লিখেছেন সামসুল আলম দোয়েল ২৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২০, ০২:২১:৪১ রাত
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম
বাচালতা ও অনর্থক কথার পরিণতি: বেশি কথা বলা ও অনর্থক কথা বলা একটি মানসিক রোগ। ব্যাপক অর্থবোধক সংক্ষিপ্ত কথা কিংবা কথায় বাহুল্য বর্জন ব্যক্তিত্ব ও প্রাজ্ঞতার পরিচয় বহন করে। রাসূলুল্লাহ সা. ব্যাপক অর্থবোধক সংক্ষিপ্ত কথা বলতেন। বাচালতা, কথায় বাড়াবাড়ি, অনর্থক-অপ্রয়োজনীয় কথা বলা, অহঙ্কারপূর্ণ শব্দমালা তথা কথায় দাম্ভিকতা ইসলামে অপছন্দীয় কাজ। যেমন হাদীসে এসেছে-
জাবির (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ তোমাদের যে ব্যক্তির চরিত্র ও আচরণ সর্বোত্তম তোমাদের মধ্যে সে-ই আমার নিকট সর্বাধিক প্রিয় এবং কিয়ামাত দিবসেও আমার খুবই নিকটে থাকবে। তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি আমার নিকট সবচেয়ে বেশি ঘৃণ্য সে ব্যক্তি কিয়ামাত দিবসে আমার নিকট হতে অনেক দূরে থাকবে, তারা হলো- বাচাল, কথা-বার্তায় ধৃষ্ট-নির্লজ্জ এবং অহংকারে মত্ত ব্যক্তিরা। সাহাবীগণ বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বাচাল ও ধৃষ্ট-দাম্ভিকদের তো আমরা জানি কিন্তু মুতাফাইহিকূন কারা? তিনি বললেনঃ অহংকারীরা।
ইমাম তিরিমিযী রহ. বলেন- ‘আস-সারসার যে লোক বেশি কথা বলে (বাচাল)। আল-মুতাশাদিক' , মানুষের সামনে যে লোক লম্বা লম্বা কথা বলে বেড়ায়, ধৃষ্টতাপূর্ণ ও অশালীন উক্তি করে, নির্লজ্জ ও দাম্ভিকতাপূর্ণ কথা বলে।
(তিরমিযী: ২০১৮)1
শা‘বী (রহ.) হতে বর্ণিত যে, মুগীরা ইবনু শু‘বাহ্ (রহ.)-এর কাতিব (একান্ত সচিব) বলেছেন, মু‘আবিয়া (রাঃ) মুগীরা ইবনু শু‘বাহ্ (রাঃ)-এর কাছে লিখে পাঠালেন যে, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর কাছ হতে আপনি যা শুনেছেন তার কিছু আমাকে লিখে জানান। তিনি তাঁর কাছে লিখলেন, আমি আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -কে বলতে শুনেছি, আল্লাহ তোমাদের তিনটি কাজ অপছন্দ করেন- (১) অনর্থক কথাবার্তা, (২) সম্পদ নষ্ট করা এবং (৩) অত্যধিক সওয়াল করা। (সহীহ বুখারী: ১৪০৭)2
সা‘দ ইবনু আবূ ওয়াক্কাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ কিয়ামত ঐ সময় পর্যন্ত সংঘটিত হবে না, যতক্ষণ না এমন একদল লোকের আবির্ভাব হবে, যারা নিজেদের রসনার সাহায্যে এমনভাবে ভক্ষণ করবে, যেভাবে গাভী তার রসনার সাহায্যে ভক্ষণ করে থাকে।(মুসনাদে আহমাদ)3
চাঁপাবাজ বাগ্মীদের পরিণতি:
আবদুল্লাহ ইবনু আমর (রাযিঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ সেসব বাকপটু-বাগ্মী লোকদেরকে আল্লাহ তা'আলা অবশ্যই ঘৃণা করেন, যারা গরুর জাবর কাটার ন্যায় কথা বলে। (তিরমিযী:২৮৫৩)4
তারা তো ঐ সমস্ত বাগ্মী যারা অসংযতভাবে বেশি কথা বলে এবং কথাকে এমনভাবে প্যাঁচায় যেমনভাবে গাভী জিহবা দ্বারা তার খাবার প্যাঁচায়। গরু যেমন সামান্য খাবার নিয়ে অনেক্ষণ ধরে জাবর কাটে তেমনি যারা সামান্য কথাকে লম্বা-চড়া করে দীর্ঘক্ষণ ধরে বকবক করতে থাকে তাদের আল্লাহ অপছন্দ করেন।
ভালো কথাবলা নতুবা চুপ থাকা:
জিহ্বাকে নিয়ন্ত্রণ করলে এবং চুপ থাকলে অনেক অন্যায় থেকে বেঁচে থাকা যায়। বেশির ভাগ সময় চুপ থাকা নবী-রসুলদের অভ্যাস ছিল। পৃথিবীতে মানুষে মানুষে যত ঝগড়া-ঝাটি হয়, মনোমালিন্য হয় এবং একে অপরের সঙ্গে সম্পর্ক নষ্ট হয় তার মূলে রয়েছে অনিয়ন্ত্রিত কথা এবং বাকশক্তির অপব্যবহার।
আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে আল্লাহ্ এবং শেষ দিনের প্রতি বিশ্বাস রাখে, সে যেন ভাল কথা বলে নতুবা চুপ থাকে। (বুখারী: ৬১১০)5
এই হাদীসের মাধ্যমে বুঝতে পারি উপকারী কথা ছাড়া কোন কথা বলা উচিত নয়। অর্থাৎ সেই কথা যার উপকারিতা স্পষ্ট। পক্ষান্তরে যে কথার উপকারিতা সম্বন্ধে সন্দেহ হয়, সে কথা বলা উচিত নয়।
আবদুল্লাহ ইবনু আমর (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে লোক চুপ থাকলো, সে নাজাত (মুক্তি) পেলো। (তিরমিযী: ২৫০১)6
মুহরিয ইবনে যুহায়র আসলামী থেকে বর্ণিত আছে, "চুপ থাকা হলো আলেমের সৌন্দর্য আর জাহেলের পর্দা।" (ফাইযুল কাদীর: ৫১৫৯) বাইহাকীর শু'আবুল ঈমান গ্রন্থে সুফিয়ান ইবনে উয়াইনাহ রহ. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন , বলা হয়ে থাকে: চুপ থাকা বিদ্বানের অলঙ্কার আর মূর্খদের পর্দা। (হা: ৪৬৯০) এর মানে হলো, বিদ্বানদের বৈশিষ্ট্য হলো তারা কথা কম বলে আর মূর্খরা তাদের জ্ঞানের বহর দেখানোর জন্য অনর্থক অতিরিক্ত কথা বলে তাদের মূর্খতাকে ঢাকতে চায়।
বেশি কথা মানে বেশি মিথ্যা আর অহঙ্কার, কেননা বেশি কথা বলতে দরকার বেশি তথ্য আর তত্ত্ব, মানুষ তাই বেশি কথা বলতে গিয়ে মিথ্যাচার করে বা বানিয়ে বলে। তাই নিরবতা অবলম্বন করলে অনেক পাপাচার থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।
আসলাম (রহঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদিন ‘উমার (রাঃ) আবূ বকর সিদ্দীক (রাঃ)-এর নিকট আসলেন, তখন আবূ বকর সিদ্দীক (রাঃ) নিজের জিহবা টানছিলেন। তখন ‘উমার (রাঃ) বললেনঃ থামুন, দেখি! আপনি কী করছেন? আল্লাহ আপনাকে ক্ষমা করুন। তখন আবূ বকর সিদ্দীক (রাঃ) বললেনঃ এ জিহবাই আমাকে ধ্বংসের স্থানসমূহে নিক্ষেপ করেছে। (মালিক)7
টিকা:
1. জামে আত্ তিরমিযী, অধ্যায়ঃ সদ্ব্যবহার ও পারস্পরিক সম্পর্ক বজায় রাখা (كتاب البر والصلة عن رسول الله ﷺ) হা: ২০১৮, অনুরূপ হাদীস বর্ণিত আছে আবূ সা‘লাবাহ্ আল খুশানী (রাঃ) হতে। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ কিয়ামতের দিন তোমাদের মধ্যে আমার কাছে সবচেয়ে প্রিয়তম ও আমার সবচেয়ে নিকটতম সেই ব্যক্তি হবে, যে তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে চরিত্রবান। আর আমার কাছে সবচেয়ে ঘৃণিত ও সবচেয়ে দূরতম সে ব্যক্তি হবে, যে তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে চরিত্রহীন, তারা হলো- যারা বেশি কথা বলে, অসতর্কভাবে যা-তা বলে এবং কথাবার্তায় নিজেকে বড় বলে প্রকাশ করে। (বাইহাকীর শু‘আবুল ঈমান: ৪৯৬৯, মিশকাত, শিষ্টাচার অধ্যায়: ৪৭৯৭)
(الثَّرْثَارُوْنَ) অনর্থক ও অন্যায়মূলক বিষয়ে বেশি কথা যারা বলে তাদের ثرثارون বলা হয়।
(الْمتَشَدِّقُوْنَ) সংযত ও সতর্ক না হয়ে যারা কথা বলে। (الْمُتَفَيْهِقُوْنَ) অহংকারবশত যারা কথা বলে। (দ্রষ্টব্য:মিরক্বাতুল মাফাতীহ; তুহফাতুল আহ্ওয়াযী ৫ম খন্ড, হাঃ ২০১৮)
আবূ উমামা রাদিয়াল্লাহু আনহু সূত্রে নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণিত। তিনি বলেছেনঃ লজ্জাশীলতা এবং রুদ্ধবাক হওয়া ঈমানের দু’টি শাখা। অশ্লীলতা (লজ্জাহীনতা) ও বাক্যবাগিশ হওয়া মুনাফেকীর দু’টি শাখা।
ইমাম তিরমিযী (রহঃ) বলেনঃ الْعِيُّ অর্থ স্বল্পবাক, রুদ্ধবাক। الْبَذَاءُ অর্থ অশ্লীল কথাবার্তা। الْبَيَانُ অর্থ বেশী কথা বলা, বাক্যবাগিশ হওয়া যেমন এই যে (আজকাল কার) বক্তারা বক্তৃতা দেয় আর কথাকে এত বিস্তৃত করে এবং ব্যক্তি বিশেষের প্রশংসায় এত পঞ্চমুখ হয়ে উঠে যে আল্লাহ তাতে সন্তুষ্ট থাকেন না। (দ্রষ্টব্য: তিরমিযী, অধ্যায়ঃ সৎ ব্যবহার ও সম্পর্ক রক্ষা (كتاب البر والصلة عن رسول الله ﷺ) হা: ২০২৭)
2. সহীহ বুখারী, অধ্যায়ঃ যাকাত (كتاب الزكاة), হা: ১৪০৭, সহীহ মুসলিম: ৫৯৩
3. মিশকাতুল মাসাবীহ, অধ্যায়: আদাব, হা: ৪৭৯৯
4. সহীহ তিরমিযী, অধ্যায়: শিষ্টাচার, হা: ২৮৫৩, আবূ দাঊদ: ৫০০৫, সিলসিলাতুস্ সহীহাহ্: ৮৭৮, মিশকাত: ৪৮০০)
5. হাদীসটির পূর্ণরূপ হচ্ছে- আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে আল্লাহ্ এবং শেষ দিনের প্রতি বিশ্বাস রাখে, সে যেন ভাল কথা বলে নতুবা চুপ থাকে। এবং যে ব্যক্তি আল্লাহ্ ও শেষ দিনের প্রতি বিশ্বাস রাখে, সে যেন তার প্রতিবেশীকে ক্লেশ না দেয়। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর ও আখিরাতের প্রতি বিশ্বাস রাখে, সে যেন তার মেহমানের সম্মান করে। ( সহীহ বুখারী, অধ্যায়ঃ সদয় হওয়া (كتاب الرقاق) হা: ৬১১০, সহীহ মুসলিম: ৪৭) হাদীসটি আরো ভিন্ন শব্দে ও বর্ধিতাকারে বুখারী, মুসলিম সহ অন্যান্য হাদীসের গ্রন্থে এসেছে।
6.দ্রষ্টব্য: হাদীসটির সনদ নিয়ে মুহাদ্দিসগণের মাঝে ভিন্নমুখী বক্তব্য আছে, তবে এই হাদীসটির অনেক শাহেদ বা ব্যাপক সনদ থাকার কারণে এটাকে শায়খ নাসিরুদ্দীন আলবানী তার সহীহাহতে এনেছেন। দেখুন সিলসিলাতুস সহীহাহ: ৫৩৫ (মিশকাতুল মাসাবীহ,শিষ্টাচার অধ্যায়, হা: ৪৮৩৬; আহমাদ: ৬৬১৬; তিরমিযী ২৫০১, সিলসিলাতুস্ সহীহাহ্: ৫৩৫, তাবারানীর মু'জামুল আওসাত:১৯৫৪)
7.মুওয়াত্তা মালিক: ৩৬২১, সহীহ আত্ তারগীব ওয়াত্ তারহীব :২৮৭৩। ইমাম গাযালী (রহিমাহুল্লাহ) বলেনঃ আবূ বকর সিদ্দীক (রাঃ) সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি নিজেকে অহেতুক কথা বলা থেকে বিরত রাখার জন্য মুখে পাথরকুচি রাখতেন এবং তিনি তার জিহ্বার দিকে ইঙ্গিত করে বলতেন- এটাই আমাকে ধ্বংসের মধ্যে প্রবেশ করিয়েছে। (মিরক্বাতুল মাফাতীহ) দ্রষ্টব্য মিশকাত:৪৮৬৯
সংকলন ও সম্পাদায়: সামসুল আলম
বিষয়: সাহিত্য
৭৩৭ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য






































পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন